‘কলঙ্কিত বিজয়ের পথে শেখ হাসিনা : গার্ডিয়ান পত্রিকা

ক্রাইমবার্তা রিপোটঃ  বিভিন্ন কারণেই বাংলাদেশের এবারের নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্বের নজর রয়েছে। গত কয়েকদিনে বাংলাদেশ নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রখ্যাত সংবাদ মাধ্যমে বিশেষ প্রতিবেদন কিংবা মতামত ও বিশ্লেষণ ছাপা হয়েছে। সেখান থেকেই চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো।
বৃটেনের বিখ্যাত গার্ডিয়ান পত্রিকার শিরোনাম ‘শেখ হাসিনা হেডস ফর টেইন্টেড ভিক্টরি’ অর্থাৎ ‘কলঙ্কিত বিজয়ের পথে শেখ হাসিনা।’ প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই পুনঃনির্বাচিত হবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে বিরোধী শিবির বলছে, রক্তক্ষয়ী এই নির্বাচনী প্রচারণা ছিল গত ৪৭ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি নিয়ন্ত্রিত। দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হলেও, সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ বিস্তর।
নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত হয়েছে ঢাকা ট্রিবিউন পত্রিকার প্রকাশক কাজি আনিস আহমেদের মতামত নিবন্ধ। ‘বাংলাদেশের বিকল্প: কর্তৃত্ববাদ কিংবা চরমপন্থা’ শিরোনামের এই নিবন্ধে বলা হয়, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসতে চায় দলটির উন্নয়নের রেকর্ড ও ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তির ওপর নির্ভর করে।

তবে টানা দুইবার ক্ষমতায় থাকায় দলটির বিপক্ষে যাবে মানুষের মধ্যে বিরাজ করা ক্ষমতাসীন-বিরোধী প্রভাব। গত বছর হওয়া ছাত্র আন্দোলন কঠোর হস্তে দমন ও বিরোধী মতের ওপর দমনপীড়নের ফলে এই মনোভাব আরও তীব্র হয়েছে। ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতাসীন সরকার রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা ও গ্রেপ্তার, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের মাধ্যমে বিরোধী দলকে ধ্বংস করেছে। তবে আনিস আহমেদ, যার বড় ভাই শাসক দলের আইনপ্রণেতা ও নির্বাচনে লড়ছেন বলে তিনি নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন, তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন যে, আওয়ামী লীগই হবে ভোটারদের জন্য মন্দের ভালো।
বার্তাসংস্থা এপির প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার সরকার টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসার পথে। উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সমর্থন বাড়িয়েছেন হাসিনা। কিন্তু তার সমালোচকরা প্রশ্ন তুলছেন, এই গণতন্ত্রের বিনিময়ে এই উন্নয়ন কিনা।
এতে বলা হয়, খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে ড. কামাল হোসেন এখন হাসিনার প্রধান চ্যালেঞ্জার। তিনি বাংলাদেশের বর্ধনশীল মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করেছেন। এছাড়া পশ্চিমা কূটনীতিকরা পুরোপুরি নিশ্চিত নন যে, হাসিনার আমলে হওয়া উন্নয়ন তার কর্তৃত্বপরায়ণ শাসনের নায্যতা প্রতিপাদন করে কিনা। এতে আরও বলা হয়, প্রশাসনের ওপর হাসিনার স্পষ্ট নিয়ন্ত্রণ থাকায়, সন্দেহ জাগছে যে, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কিনা। প্রতিবেদনের শেষে বলা হয়, হাসিনার সাহসিকতার যে প্রতিচ্ছবি তাতে কলঙ্ক লেগেছে ঘরোয়া সমালোচকদের প্রতি তার অসহিষ্ণুতা থেকে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স নির্বাচন নিয়ে একাধিক প্রতিবেদন ছেপেছে। একটি বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদনের শিরোনাম: ‘নির্বাচনের আগে বিরোধী দল বলছে ‘ত্রাসের রাজত্ব’ চলছে’। এতে নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে বিএনপির হিমশিম খাওয়ার প্রসঙ্গ তুলে ধরতে বিএনপি নেতা আবদুল মঈন খানের উদাহরণ দেওয়া হয়। তিনি এখন পর্যন্ত নিজের নির্বাচনী এলাকায় একটি জনসভাও করতে পারেন নি। এতে বলা হয়, এই পরমাণু বিজ্ঞানীর হাজার হাজার পোস্টার তার নির্বাচনী দপ্তরেই পড়ে আছে। কারণ তার নেতাকর্মীরা এসব লাগাতে ভয় পাচ্ছেন। অপরদিকে দেশজুড়ে অসংখ্য স্থানে শেখ হাসিনার ছবি সম্বলিত পোস্টার।
তবে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম রয়টার্স প্রতিবেদককে কিছু ছবি দেখিয়ে বলেন, বিএনপির গুন্ডারা বিভিন্ন দোকানপাট ভাঙছে। প্রতিবেদনে নির্দলীয় থিংকট্যাঙ্ক সেন্টার ফর গর্ভনমেন্ট স্টাডিজের করা ফেসবুক জরিপের কথা তুলে ধরা হয় যেখানে ৮০ ভাগের মতো অংশগ্রহণকারী বিরোধী দলকে সমর্থনের পক্ষে রায় দিয়েছেন। তবে সেপ্টেম্বরে করা মার্কিন প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইন্সটিটিউটের একটি জরিপে বলা হয়েছে, ৬২ শতাংশ মানুষই মনে করেন দেশ সঠিক পথে রয়েছে।
রয়টার্সের জরিপে নোয়াখালিতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমেদের লড়াইয়ের কথাও তুলে ধরা হয়। এছাড়া সাধারণ মানুষের বক্তব্যও তুলে ধরা হয়। মানুষ বলছেন, বিরোধী দল প্রচারণা চালাচ্ছে না বা চালাতে পারছে না। ফলে তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না কাকে ভোট দেবেন। এছাড়া প্রতিবেদনে নির্বাচন কমিশনের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের বিষয়টিকেও ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
রয়টার্সের আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়, সহিংস ও রক্তক্ষয়ী প্রচারণা শেষে ভোটের দিকে তাকিয়ে বাংলাদেশ।
মার্কিন আরেক প্রভাবশালী পত্রিকা ওয়ালস্ট্রিট জার্নালে ভারতীয় কলামিস্ট সদানন্দ ধুমের লেখা মতামত নিবন্ধের শিরোনাম: ‘বাংলাদেশের সামনে বিকল্প বেশ বাজে’। এতে ড. কামাল হোসেনের ইমেইল সাক্ষাৎকারে নেওয়া মন্তব্য ছিল। তিনি বলেছেন, ‘এই নির্বাচন গণতন্ত্রের শেষ প্রতিরক্ষা ব্যুহ।’ তিনি আরও বলেন, এই সরকার দেশের সমস্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করে ও দেশকে একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়। অপরদিকে ফোনে নেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় এই সরকারের উন্নয়নকে মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের সঙ্গে তুলনা করেছেন। নিবন্ধে সরকারের উন্নয়নের পরিসংখ্যান যেমন দেওয়া হয়েছে, তেমনি সরকারের হাতে দমনপীড়নের ফিরিস্তিও দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, দেশের সবচেয়ে প্রথিতযশা কিছু নাগরিক, যেমন, প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস, ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম ও ফটোসাংবাদিক ড. শহীদুল আলম সরকারের রোষে পড়েছেন।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম ফোর্বসে প্রকাশিত প্রতিবেদনের শিরোনামে বাংলাদেশের নির্বাচনী লড়াইকে চার্লস ডারউইনের বিখ্যাত তত্ত্ব ‘সার্ভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট’-এর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্তিত্বের লড়াই চলছে। প্রত্যুষ রায়ের লেখা নিবন্ধে বলা হয়, শেখ হাসিনার শাসনে বিভিন্ন খাতে উন্নয়ন হয়েছে। ভারতের তুলনায় বিভিন্ন উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ভালো। তবে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিই এই ইতিবাচক গতিধারার প্রতি প্রতিবন্ধক।
আল জাজিরার প্রতিবেদনের শিরোনাম: ‘হাসিনার দশ বছর: গণতন্ত্র বাদ দিয়ে উন্নয়ন’ (টেন ইয়ার্স অব হাসিনা: ডেভেলপমেন্ট মাইনাস ডেমোক্রেসি)। এতে অর্থনীতিবিদ খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের মন্তব্য ছিল। তিনি বলেন, ‘ব্যাংকিং সেক্টরের ভয়াবহ অবস্থা সঠিকভাবে মোকাবিলা করা হয়নি। বেসিক ব্যাংকে ৮০ শতাংশ বাজে ঋণ থাকার পরও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এখনও রাষ্ট্রায়ত্ত অনেক ব্যাংকে বাজে ঋণ আছে। এটা ছিল স্রেফ লুট।’ তবে দেশের আইটি খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বেসিক-এর প্রধান সৈয়দ আলমাস কবির বলছেন, স্থানীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রতি নজর ছিল সরকারের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল আল জাজিরাকে বলেছেন, ‘দেশের জিডিপি বেড়েছে, এটি সত্য। কিন্তু আপনি যদি আয় ও সম্পদ বৈষম্যের দিকে তাকান, তাহলে দেখবেন বিশ্বাসযোগ্য গবেষণা ও উপাত্ত বলছে, তা খুবই বেড়েছে।’ তার মতে, শাসক দল যার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, তা হলো গণতন্ত্র বাদে উন্নয়ন। তার ভাষ্য, ‘আপনি যদি আমাদের সংবিধান ও স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস পড়েন, কোথাও কি বলা আছে যে, আপনি উন্নয়নের ফল পাবেন যদি আপনি আপনার গণতান্ত্রিক অধিকার পরিত্যাগ করেন! সরকারকে এ কথা বলার অধিকার কে দিয়েছে যে, আমরা আপনাদেরকে উন্নয়ন দিয়েছি, সুতরাং গণতন্ত্র নিয়ে চিন্তা করবেন না’?
জাপান-ভিত্তিক ম্যাগাজিন ডিপ্লোম্যাটে প্রকাশিত নিবন্ধের বিষয়বস্তু ও শিরোনাম বেশ চমকপ্রদ। এই নিবন্ধ মূলত হিরো আলমকে নিয়ে। শিরোনাম করা হয়েছে: ‘বাংলাদেশের প্রাপ্য যেই হিরো।’এতে হিরো আলমকে আখ্যা দেওয়া হয়েছে ‘ট্রল ক্যান্ডিডেট’ হিসেবে। সেখানে হিরো আলমের সঙ্গে হওয়া লেখকের কথোপকথনের অংশবিশেষও তুলে দেওয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতার শিক্ষক ফাহমিদুল হক যুক্তি দেখান, হিরো আলমের এই রাজনৈতিক উত্থানের সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের উত্থানের সাদৃশ্য রয়েছে।
বার্তা সংস্থা এএফপি জাতীয় ঐক্যাফ্রন্টের প্রধান ড. কামাল হোসেনের সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছে। এছাড়া বিবিসি নিউজ ও রেডিও থেকে শেখ হাসিনা ও ড. কামাল হোসেন উভয়েরই সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। বিবিসির সাংবাদিক মাহফুজ সাদিকের টুইট থেকে জানা যায়, শেখ হাসিনা দাবি করেছেন যে, তিনি দেশে উন্নয়ন এনেছেন। তবে কামাল হোসেন বলেছেন, এই উন্নয়ন এসেছে গণতন্ত্র বিকিয়ে দিয়ে।
এছাড়া কথিত অপপ্রচার রোধ করতে সরকারের ইন্টারনেটের গতি কমিয়ে দেওয়ার সংবাদও গুরুত্ব সহকারে ছাপা হয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে

Check Also

যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার

নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।