ক্রাইমবার্তা রিপোটঃ বাংলাদেশে ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাজ্যের বিশ্বখ্যাত ইকোনমিস্ট ম্যাগাজিন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ৩ জানুয়ারি প্রকাশিত এ প্রতিবেদনে নির্বাচনের বিভিন্ন অনিয়ম তুলে ধরে বলা হয়েছে একচ্ছত্র ক্ষমতাই ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে।
প্রতিবেদনে প্রশ্ন রাখা হয়েছে ২৯৯টি আসনের মধ্যে ২৮৮টিতে জয়ের অর্থ কি এই দাঁড়ায় আওয়ামী লীগ সবচেয়ে জনপ্রিয় দলে পরিণত হচ্ছে! দুর্ভাগ্যের বিষয় সেটি জানার আর কোনো উপায় নেই।
নির্বাচনে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ তুলে ধরে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে এ নির্বাচনে মাঠ এতটাই অসমতল ছিল, ভোটাভুটি এতটাই ত্রুটিপূর্ণ ও ভোটগণনা এতটাই অস্বচ্ছ ছিল যে, খোদ দলের অনেক সমর্থকও এই ফলাফল নিয়ে সন্দিহান।
ছোটখাটো কিছু মিত্রসহ দলটি মোট আসনের ৯৬ শতাংশ লাভ করেছে। ক্ষমতাসীন জোট ২০১৪ সালে যতটা আসন পেয়েছিল, এবার পেয়েছে তার চেয়েও অধিক আসন। সেবার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির নির্বাচন বয়কটের কারণে ভোটার উপস্থিতি একেবারেই কমে যায়। অর্ধেকেরও বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় পায় ক্ষমতাসীন জোট।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে মতামত জরিপ ও নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকদের মতে, এ ধরনের ভয়াবহ জালিয়াতি ছাড়াও শেখ হাসিনার দল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেত। স্বাধীনতা সংগ্রামে আওয়ামী লীগের সম্পৃক্ততা, আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক ও বিগত সময়ের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তুলে ধরে দলটির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।
এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিভিন্ন নীতি বিদেশেও বিশেষ করে ভারতে প্রশংসিত হয়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় বাংলাদেশের কিছুসংখ্যক বুদ্ধিজীবী আর কিছু বিদেশী কূটনীতিক প্রত্যাশা করেছিলেন এমনকি খুব করে চেয়েছিলেন যে বিএনপি জিতুক।
আওয়ামী লীগের চেয়ে কম হলেও বিএনপিরও ঐতিহাসিকভাবে সমর্থকদের শক্ত ঘাঁটি থাকার কথা বলা হয়েছে। ২০০১ থেকে ২০০৬ ক্ষমতায় থাকাকালে সরকারের বিভিন্ন দুর্বলতা তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ১০ বছরে আওয়ামী লীগ সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে দেশ শাসনের মাধ্যমে দেশের সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে করায়ত্ত করেছে। এ নিয়ে দলটির অনেক সমর্থকের মধ্যেও সমালোচনা জন্ম নিয়েছে। জবাবদিহির আওতায় না থাকা পুলিশ ও সরকারি আইনজীবী ও কৌঁসুলিরা প্রায়ই বিএনপি সদস্যদের গ্রেফতার ও মামলা করে তাদেরকে হয়রানি করেছেন।
প্রতিবেদনে সরকারি ছাত্র সংগঠন কর্তৃক প্রতিপক্ষের প্রতি সহিংসতা, সম্প্রতি নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের প্রতি তাদের নৃশংস প্রতিক্রিয়া, আন্দোলনের কারণে সরকারের ঘাবড়ে যাওয়া এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সীমিত করে আইন প্রণয়নের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
এ ধরনের চাপের কারণে অনেকেই আশঙ্কা করছিলেন যে, বিএনপি হয়তো ২০১৪ সালের মতো ফের নির্বাচন বয়কট করতে পারে। তবে অক্টোবরে অনেককে অবাক করে দিয়ে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ছাড় দেয়। সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা উদারমনা খ্যাত ও আওয়ামী লীগেরই সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বৃহত্তর জোটে যোগ দেয়। নির্বাচনের সময় ব্যাপক ভয়ভীতি প্রদর্শন ও হয়রানি সত্ত্বেও এই জোট মাটি কামড়ে ছিল। এর মধ্যে বিএনপির ওয়েবসাইট বন্ধ করে দেয়া হয়, বিএনপিকে সমাবেশ করতে দেয়া হয়নি। এ ছাড়া দলটির প্রায় ১০ হাজার কর্মী আটক হন।
তবে বিএনপি নির্বাচনে থাকায় স্থানীয় পর্যবেক্ষক ও বিদেশী কূটনীতিকেরা তখন সম্ভাব্য ফল নিয়ে জল্পনা-কল্পনা শুরু করেন। তারা ভেবেছিলেন, নির্বাচনী ফল হাসিনার অনুকূলে যাবে। তবে শক্তিশালী বিরোধী দল তাকে হয়তো কিছুটা হলেও সংযত রাখবে। এক বুদ্ধিজীবী বলেন, যদি আওয়ামী লীগ দু-তৃতীয়াংশের কম আসন পেয়ে সরকার গঠন করে, তাহলে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে তা সহায়ক হবে। অন্তত আমাদেরকে ক্ষত উপশমের পথে নিয়ে যাবে।
কিন্তু সেই পথে যাওয়া আর সম্ভব হচ্ছে না। দেশজুড়ে প্রায় ৪০ হাজার ভোটকেন্দ্রে ভোটাভুটি শুরু হতে না হতেই, কিছু ব্যালট বাক্স সন্দেহজনকভাবে ভরে গেছে। ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ঘুরে দেখা গেল আওয়ামী লীগের অসংখ্য ব্যানার আর পোস্টারের বিপরীতে বিএনপির কোনো পোস্টার দেখতে পাওয়া যায়নি বললেই চলে। প্রতিটি বুথে আওয়ামী লীগের বিপরীতে কোনো বিরোধী এজেন্ট পাওয়া যায়নি।
আওয়ামী লীগের আধিপত্য আছে যেসব এলাকায়, সেখানে ভোট খুব দ্রুতই শেষ হয়ে যায়। ভোটদাতাদের সারিও ছিল কম। ভোটদানে তেমন ঝামেলাও পোহাতে হয়নি।
কিন্তু ঢাকা-১৫ আসনের মতো প্রতিদ্বন্দ্বিতাপর্ণ এলাকায় দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। মনিপুর হাইস্কুলে হাজার হাজার ক্ষুব্ধ নারী-পুরুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্কুলের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। অনেকে শেষ পর্যন্ত রাগে-ক্ষোভে চলেও গেছেন; কারণ পুলিশ ও আওয়ামী লীগের কর্মীরা খুবই সামান্য কিছু ভোটারকে একটি দরজা দিয়ে যেতে দিচ্ছিলেন। অথচ ভেতরে ৩৬টি ব্যালট বাক্স ছিল। দুপুরের মধ্যে দেখা গেল, একটি কক্ষে মাত্র ৪১ জন ভোটার ভোট দিতে পেরেছিলেন। অথচ এখানে ভোট দেয়ার জন্য নিবন্ধিত ছিলেন এক হাজার জন।
সারা দেশ থেকে একই ধরনের প্রতিবেদন আসতে শুরু করল যে, বিরোধী দলের এজেন্টদের হুমকি দেয়া হয়েছে কিংবা মারধর দেয়া হয়েছে। অনেক ভোটারকে ঢুকতে দেয়া হয়নি। বুথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ‘মধ্যাহ্নভোজে’র জন্য কিংবা ব্যালট শেষ হয়ে গেছে এ যুক্তিতে। নির্বাচনের দিন সহিংসতায় ১৯ জন মারা গেছেন।
প্রত্যাশিতভাবেই সরকার মনোনীত নির্বাচন কমিশন দাবি করেছে, ভোটাভুটি হয়েছে শান্তিপূর্ণভাবে। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক হিসেবে লেবেল লাগানো এক অদ্ভুত গোষ্ঠীও সন্তোষ প্রকাশ করে। আঞ্চলিক দুই শক্তি চীন ও ভারত এই ফলাফল মেনে নিয়ে ক্ষমতাসীন দলকে অভিনন্দন জানায়।
শেখ হাসিনা নিজেও অনেক ঘটনা উড়িয়ে দিয়েছেন। তার বক্তব্য, এমন অনেক ঘটনাও ঘটেছে যে, বিরোধী দলের হাতে আমাদের দলের কর্মীরা মারা গেছেন। তার নিজের আসনে জয়ের অনুপাত ছিল ১০০০:১-এরও বেশি। কিছু কেন্দ্রে বিরোধী দলের প্রার্থীরা একটি ভোটও পাননি, নিজেদের ভোটও নয়।
কাজ যখন হয়েই গেছে, সরকারি মন্ত্রীরা ফের উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির কাজে নেমে পড়ার কথা বলছেন। পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আছে রাষ্ট্র। বিদেশে আছে ক্ষমতাধর বন্ধু। আর বিরোধী দলের অস্তিত্ব সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে। ফলে তারা এখন হয়তো ভালো করে ঘুমাতে পারবেন। তবে ঢাকার এক শঙ্কিত শিক্ষক প্রসঙ্গত বলেন, ‘তারা অর্থাৎ ক্ষমতাসীন দল যেটা বুঝতে পারছে না সেটা হলো, তাদের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হলো তাদেরই একচ্ছত্র ক্ষমতা।’