টানা ১০ বছর অ্যাটর্নি জেনারেলের পদে থেকে রেকর্ড গড়লেন মাহবুবে আলম। আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে ২০০৯ সালে এ পদে নিয়োগ পান তিনি। এ সময়ে বেশ কিছু মামলায় নিজের সফলতারও প্রমাণ রেখেছেন রাষ্ট্রের এই প্রধান আইন কর্মকর্তা। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে দীর্ঘ পথচলার অভিজ্ঞতা ও সফলতার আলোকে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি ও বিচার বিভাগের দুর্নীতি রোধে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন তিনি বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম মুন্সীগঞ্জের লৌহজং থানার হলুদিয়া ইউনিয়নে ১৯৪৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ওহাজউদ্দিন আহমেদ এবং মা মতিজান বিবি। আট ভাইবোনের মধ্যে মাহবুবে আলম পরিবারের চতুর্থ সন্তান।
১৯৬৮ সালে মাহবুবে আলম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বিএ অনার্স সম্পন্ন করেন। ১৯৬৯ সালে লোক প্রশাসন বিভাগ থেকে এমএ পাস করেন। এরপর ১৯৭২ সালের সিটি ল’ কলেজ থেকে এলএলবি সম্পন্ন করেন তিনি।
১৯৭৩ সালে তিনি আইনজীবী হিসেবে আদালতে প্রাকটিস (এনরোলমেন্ট) শুরু করেন। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি থেকে হাইকোর্টের আইনজীবী হিসেবে মামলা পরিচালনা (এনরোলমেন্ট)করেন।১৯৯৮ সালে তিনি অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিযুক্ত হন। আর সর্বশেষ ২০০৯ সালের ১৩ জানুয়ারি অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিয়োগ পান তিনি।
পথচলার দীর্ঘ ১০ বছরে কোন কোন মামলায় আশান্বিত সফলতা পেয়েছেন?
মাহবুবে আলম: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যা ও জেলহত্যা মামলা পরিচালনার সুযোগ পেয়েছিলাম। এছাড়া, একাত্তরের মানবতাবিরোধীদের মামলা, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের বাড়ি উদ্ধারের মামলা পরিচালনা করেছি। পাশাপাশি সরকারের বেহাত হওয়া বহু সম্পত্তি উদ্ধারের মামলা এবং মামলা করে চাকরি ফিরে পাওয়ার বিরুদ্ধেও প্রচুর মামলা পরিচালনা করেছি।
বিভিন্ন মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে বারবার হুমকি সত্ত্বেও নিজেকে কীভাবে সামলিয়েছেন?
মাহবুবে আলম: এসব বিষয়ে কখনও কোনও অনুভূতি আমার হয়নি। আমার মনে হয়, এ ধরনের জায়গায় থাকলে হুমকি আসবেই। তাছাড়া, মানুষের মৃত্যু তো হঠাৎ সড়ক দুর্ঘটনা, ভূমিকম্পে কিংবা লঞ্চ ডুবিতেও হতে পারে। তাই মৃত্যুর ভয়ে সবসময় আতঙ্কিত থাকলে কখনও তো কাজই করা যাবে না। তবে এসব হুমকির ফলে আমার নিজের স্বাধীনতা অনেকটা খর্ব হয়ে গেছে। রমনা পার্কের কাছেই থাকি। অথচ সন্ত্রাসীদের ভয়ে জীবনের নিরাপত্তার জন্য আমি একটি দিনও রমনা পার্কে হাঁটতে পারলাম না। এত বছর ধরে রমনা পার্কের পাশে থেকেও হাঁটতে পারলাম না। কোনও হোটেলে বা কোনও অনুষ্ঠানে যেতে পারি না। কেননা, সন্ত্রাসীরা কখন কোথায় ওঁত পেতে থাকে, তার কোনও ঠিক নেই।
আপনার এখনও মনে পড়ে, এ ধরনের কোনও মামলা পরিচালনার অভিজ্ঞতা যদি বলতেন?
মাহবুবে আলম: এমন অনেক মামলাই রয়েছে। তবে একবার একজন জজ নানারকম মামলা করে তার চাকুরি ফেরত পেতে চেয়েছিলেন। ওই জজ মন্ত্রণালয় থেকেও আদেশ এনেছিলেন— যেন তার বিরুদ্ধে চলমান মামলাটি তুলে নেওয়া হয়। কিন্তু তবুও আমি মামলাটি প্রত্যাহার করিনি। বরং সেই মামলা পরিচালনা করে আমি জয়লাভ করেছি।
আইনের অঙ্গনে নিজের অপূর্ণতা সম্পর্কে বলুন…
মাহবুবে আলম: দু’টি মামলায় এমনটি ঘটেছে। এর মধ্যে একটি ছিল— জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর মামলা। তার ফাঁসি হওয়া উচিৎ ছিল, কিন্তু সেটা হয়নি। এ মামলায় ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন থেকে কিছু কাগজ দাখিল করা উচিৎ ছিল, কিন্তু তা তারা দেয়নি। সেই কাগজগুলো জোগাড় করার জন্য আমি নিজেই বরিশাল ও পিরোজপুর গিয়েছিলাম। তবুও সেই কাগজগুলোর সন্ধান পাওয়া যায়নি।
এছাড়া, নানারকম আইনি কারণ দেখিয়ে দু’টি মিল (মসলিন কটন মিল এবং আলিম জুট মিল) সরকারের হাত ছাড়া হয়ে যায়। এতে করে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি পানির দামে বিক্রি হয়ে গেছে।
অ্যাটর্নি জেনারেল পদে ১০ বছর অতিবাহিত হলেও নতুন সরকার আপনাকে এ বহাল রাখতে চান। এ বিষয়ে আপনার কিছু বলার আছে?
মাহবুবে আলম: আইনের অঙ্গনে আমার থেকে যারা জুনিয়র আছেন, তাদেরও তো আশা-আকাঙ্ক্ষা রয়েছে অ্যাটর্নি জেনারেল হওয়ার। কেননা, আমি মনে করি এ পদের জন্য এখনও অনেক যোগ্য ব্যক্তি আছেন।
আগামী দিনগুলোতে বিচার বিভাগে কী ধরনের ভূমিকা রখেতে চান?
মাহবুবে আলম: সবচেয়ে বড় বিষয়টি হলো বিচার বিভাগকে দুর্নীতিমুক্ত করা। বিচার বিভাগ যেভাবে চলছে, এভাবে চলতে থাকলে রাষ্ট্র অকার্যকর হয়ে যাবে। বিচার বিভাগ হলো রাষ্ট্রের তিনটি স্তম্ভের একটি। তাই বিচার বিভাগ যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে যায়, তাহলে কোনও কিছুই আর টিকবে না।
এর আগেও প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বিচার বিভাগের দুর্নীতি নিয়ে আপনি মন্তব্য করেছিলেন। এরপর বিচারাঙ্গনের দুর্নীতি রোধে কোনও কার্যকর ভূমিকা দেখেছেন কিনা?
মাহবুবে আলম: আমার বক্তব্যটা ছিল একটি মেসেজ। ওই বক্তব্যের জের ধরে দুর্নীতি রোধে কিছু পরিবর্তন এসেছে। প্রধান বিচারপতি বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছেন। তবে এসব পদক্ষেপে সবকিছু হবে না। এর থেকেও কঠিন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
বিচার বিভাগের দুর্নীতি রোধে আপনার পরামর্শ কী?
মাহবুবে আলম: বিচার বিভাগে দুর্নীতির সঙ্গে যারা যুক্ত আছেন, তাদের অনতিবিলম্বে বের করে দিতে হবে।
অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলুন…
মাহবুবে আলম: সেদিনের অভিজ্ঞতা ছিল শঙ্কার। কারণ, অ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলামের সময় আমি ছিলাম অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল। তাই অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর চিন্তা করেছি, মাহমুদুল ইসলামের মতো বিজ্ঞ, প্রাজ্ঞ, সৎ এবং কর্তব্য নিষ্ঠ একজন ব্যক্তি অ্যাটর্নি জেনারেলের পদটি যে পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, সেখানে আমি হয়তো সৎ ও কর্তব্য নিষ্ঠ হতে পারলাম, কিন্তু তার মতো জ্ঞান তো আমার নেই। এক সময় ইন্টারমিডিয়েট (এইচএসসি) পরীক্ষায় মাহমুদুল ইসলাম তৃতীয় স্থান অর্জন করেছিলেন। আর প্রথম হয়েছিলেন ড. কামাল হোসেন এবং দ্বিতীয় হয়েছিলেন মোকাম্মেল হক। তাই ভাবতাম, মাহমুদুল ইসলামের মতো একজন মেধাবীর কাছে আমি কিছুই না। অনেক বিচারককেও বলেছি—অ্যাটর্নি জেনারেল থাকাবস্থায় মাহমুদুল ইসলাম আপনাদের যেভাবে সহযোগিতা করেছেন, আমার ক্ষেত্রে সে ধরনের আশা করলে আপনারা আশাহত হবেন। কেননা, মাহমুদুল ইসলামের মতো অ্যাটর্নি জেনারেল এর আগে আমি কোর্টে দেখিনি।
আওয়ামী লীগ থেকে এবার মনোনয়ন ফরম কিনেছিলেন। পরবর্তীতে এ ধরনের সুযোগ এলে পুনরায় মনোনয়ন চাইবেন কিনা?
মাহবুবে আলম: অবশ্যই। আমার জন্মস্থান ও ওই এলাকার জনগণের ভালো করার জন্য আমি যদি কিছুই না করতে পারি, তাহলে আমার এত পড়াশোনা আর এত উচ্চপদে থেকে কী লাভ হলো? তাদের সেবা করতে পারলেই আমার জীবনে পূর্ণতা আসবে।