বাংলাদেশে নির্বাচন-যুদ্ধে জয়ী দল এখন ক্ষমতার গদিতে বসে আছে এবং তার চারদিকে বাংলাদেশের জনগণ। এখানে রাজনীতি বলতে সাধারণভাবে বোঝায়প্রকাশ্য সংসদীয় রাজনীতি। কোনো অন্তরালের রাজনীতি নেই উল্লেখযোগ্য। জনগণের মধ্যে তাদের কোনো প্রভাবও নেই। কমিউনিস্টদেরও রাজনৈতিক প্রভাব প্রায় শূন্যের কোঠায়।
কাজেই রাজনীতি বলতে শুধু বোঝায় সংসদীয় বুর্জোয়া রাজনীতি, যার দক্ষিণ অংশে আছে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামীর মতো পার্টি এবং বাম অংশে আছে সিপিবি, বাসদ ইত্যাদি বামপন্থী নামে পরিচিত বিভিন্ন দল। যেহেতু এরা সংসদীয় দল, এ কারণে এরা নির্বাচনকেন্দ্রিক।
এরা সবাই রাজনীতি করে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা অর্জনের উদ্দেশ্যে। নির্বাচনই এদের অবলম্বন। কাজেই নির্বাচন না থাকলে এদের কোনো গুরুত্ব থাকে না।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি এবং ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের নামে যেহেতু বাস্তবত নির্বাচনকে ক্ষমতা অর্জনের পদ্ধতি হিসেবে উচ্ছেদ করা হয়েছে, এজন্য আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য সংসদীয় রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরবর্তী নির্বাচন যেহেতু পাঁচ বছর পর, সে কারণে এদের এখন আর করার কিছু নেই।
বাস্তবত অকার্যকর অবস্থায় বিএনপি, ঐক্যফ্রন্ট ইত্যাদি নতুন নির্বাচন দাবি করছে। কিন্তু নতুন নির্বাচন যে আর কোনোমতেই সম্ভব নয়, এটা বোকা বুদ্ধিতেও বোধগম্য। কাজেই বিরোধী দলগুলোর নতুন নির্বাচনের দাবি ফাঁকা আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই নয়।
বাংলাদেশে শুধু কারচুপির নির্বাচনে পরাজিত হয়েই এই বিরোধী দলগুলোর এ অবস্থা হয়নি। এদের অবস্থা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নির্যাতনের কারণেই যথেষ্ট শক্তিশালী হতে পারেনি। সভা-সমিতি-মিছিল, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অন্যান্য পথ বাধাগ্রস্ত থাকায় এবং জনগণের স্বাধীনতা পুলিশের মাধ্যমে চরমভাবে খর্ব হয়ে থাকায় সংগঠন এখানে ঠিকমতো দানা বাঁধতে পারেনি।
এই পরিস্থিতিতেও কমিউনিস্ট ও বামপন্থীরা অন্তরালের রাজনীতি সংগঠিত করতেও ব্যর্থ হয়েছে। কাজেই নির্বাচনকে বাদ দিয়ে অন্য কোনো ইস্যু নিয়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা বিরোধীদের বিশেষ নেই। এখন তাদের কার্যকলাপ মূলত ঘরোয়া আলোচনা সভা এবং বক্তৃতা-বিবৃতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
বাংলাদেশে প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া রাজনীতি ছাড়া অন্য রাজনীতি অর্থাৎ শ্রমিক শ্রেণীর রাজনীতি, এমনকি বুর্জোয়া উদারনৈতিক রাজনীতি করতেও কিছু না থাকার অনেক আর্থ-সামাজিক কারণ আছে।
কিন্তু কারণ যাই থাক, শ্রমিক-কৃষক, মধ্যবিত্তের মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থকে রাজনীতির ভিত্তি হিসেবে দাঁড় করিয়ে কোনো রাজনীতি বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত শক্তিশালীভাবে দাঁড়ায়নি। সে ধরনের কোনো রাজনৈতিক শক্তির অস্তিত্ব থাকলে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে অবস্থা এখন দেখা যাচ্ছে, সেটা এভাবে দেখা যেত না।
একটু লক্ষ করলেই দেখা যেত যে, বিগত নির্বাচনে এবং তার আগের নির্বাচনগুলোতেও জনগণের মৌলিক সমস্যা নিয়ে কোনো প্রচার-প্রচারণা, তর্ক-বিতর্ক ইত্যাদি নির্বাচনী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ছিল না। সেসব প্রচারণার মূল দিক ছিল পরস্পরের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ।
নির্বাচন কীভাবে করতে হবে, কীভাবে করলে তা দুর্নীতিমুক্ত ও স্বচ্ছ হবে, এ সবই ছিল নির্বাচনী প্রচারণার প্রধান শুধু নয়, প্রায় একমাত্র দিক। অবস্থা দেখে মনে হয়, নির্বাচনের সময়ে জনগণকে এসব দল ভোটার ছাড়া অন্য কিছু মনে করে না।
ভোট পাওয়ার জন্য জনগণের কোনো দাবি-দাওয়া এদের থাকে না। নির্বাচনী প্রচারণার মাধ্যমে এরা নিজেদের দ্বন্দ্ব, ঝগড়াঝাঁটি ইত্যাদি শুধু জনগণের দরজার সামনে স্তূপীকৃত করে মাত্র।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ উন্নয়নের আওয়াজ তুলে নির্বাচনের মূল প্রচারণা চালিয়েছে। কিন্তু উন্নয়ন বলতে এরা কী বোঝায় সেটা এদের প্রচার থেকেই স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। উন্নয়ন বলতে এরা বোঝায় রাস্তাঘাট, ঢাকা শহরসহ অন্যান্য শহরে বড় বড় ভবন, ব্যবসার বিস্তৃতি, মৌলিক কোনো শিল্পের পরিবর্তে গার্মেন্ট শিল্পের মতো দরজির কারখানা ইত্যাদি। দেশের উন্নয়নের সঙ্গে যে জনগণের জীবনের কোনো সম্পর্ক আছে সেটা এদের কারও নির্বাচনী প্রচারণায় দেখা যায় না।
এ কারণে জনগনের জীবনে উপযুক্ত খাদ্যের অভাব, পুষ্টির অভাব, বাসস্থানের অভাব, শিক্ষার অভাব, সর্বোপরি চিকিৎসার অভাব দূর করার কোনো কর্মসূচি এদের প্রচারণায় নেই। এদের অবস্থা দেখে মনে হয় উন্নয়ন এক নৈর্ব্যক্তিক ব্যাপার। এদের কথা হল, এরা ‘বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি’ থেকে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত করেছে!
কিন্তু এই মধ্য আয় কার পকেটে বাড়ছে এ নিয়ে তাদের কোনো বক্তব্য নেই। এর অন্য এক দিক হল, এ নিয়ে প্রগতিশীল বলে পরিচিত রাজনৈতিক দলগুলোর অধিকাংশেরও কোনো উচ্চবাচ্য নেই। সবাই প্রায় নীরব। এই নীরবতাই আওয়ামী লীগের শক্তির একটা বড় উৎস।
শিক্ষাব্যবস্থা নামে একটা ব্যবস্থা বাংলাদেশে আছে। কিন্তু এ ব্যবস্থার মাধ্যমে শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে অশিক্ষা-কুশিক্ষার নানা প্রচার হয়ে থাকে এবং ওই প্রচারের দ্বারাই ছাত্র-ছাত্রীদের মানসিক ভুবন তৈরি হয়। প্রাথমিক, মাধ্যমিক স্তরে সাধারণভাবে শিক্ষার ব্যবস্থা এমন যে, পরীক্ষায় একজন খুব ভালো নম্বর পেলেও তার কোনো প্রকৃত শিক্ষা হয় না।
কারণ সিলেবাস বা পাঠক্রমের মধ্যে শিক্ষার উপাদান থাকে অল্পই। ব্যবসায়ীরাই এমনভাবে দেশ শাসন করছে যাতে শিল্পক্ষেত্রেও বিদ্যাচর্চা এবং জ্ঞানার্জনের চেয়ে ব্যবসার প্রাধান্যই সর্বত্র দেখা যায়। এক্ষেত্রে পরীক্ষার বিষয়টি উল্লেখ করতে হয়। পরীক্ষার পদ্ধতি এমন দাঁড়িয়েছে, যা ছাত্রদের কোচিংনির্ভর করেছে।
কোচিংয়ের নামে শিক্ষকরা ব্যবসা করছে। খাতা দেখে যাতে শিক্ষকরা অতিরিক্ত উপার্জন করতে পারেন, এজন্য পঞ্চম শ্রেণীর পরীক্ষাকে ‘জাতীয়’ পর্যায়ের পরীক্ষায় পরিণত করা হয়েছে! এরপর অষ্টম শ্রেণীর পরীক্ষা তো আছেই।
এসবের মাধ্যমে ছাত্রদের প্রকৃত শিক্ষা প্রদানের পরিবর্তে তাদেরকে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করাই হয়ে দাঁড়িয়েছে শিক্ষাব্যবস্থার মূল কাজ। এর মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রীদের প্রকৃত কোনো শিক্ষা হচ্ছে কি না, এটা এখন আর শিক্ষা বিভাগ যে সরকারি মন্ত্রণালয়ের বিবেচনার বিষয় নয়।
বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই যে, সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার এই বেহাল অবস্থার কারণে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোয় মধ্যবিত্ত এবং উচ্চশ্রেণীর লোকরা নিজেদের সন্তানকে শিক্ষা দিয়ে থাকেন। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ার এটাও এক বড় কারণ।
বাসস্থানের কথায় যদি আসা যায়, তাহলে দেখা যাবে জনগণের, বিশেষ করে শহরের জনগণের আবাসন বিষয়ে সরকারের কোনো পরিকল্পনা তো নেই-ই, এমনকি বিরোধী দলগুলোও এ নিয়ে কোনো কথাবার্তা বলে না, দাবি তোলে না। কাজেই তাদের সাধারণ রাজনীতি থেকে নিয়ে নির্বাচনী রাজনীতিতে বাসস্থানের বিষয়ে বিশেষ কিছু শোনা যায় না।
অথচ শহরে, বিশেষত ঢাকায় লাখ লাখ মানুষ এখন বস্তিতে অমানবিক জীবনযাপন করছেন, প্রতিনিয়ত তাদের, বিশেষত তাদের শিশুসন্তানদের স্বাস্থ্য হুমকির মুখে। এই বস্তিগুলোয় বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা নেই, স্বাস্থ্য রক্ষায় স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থা নেই। বস্তিবাসী শিশু ও তরুণদের শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই বললেই চলে।
জনগণের অন্য মূল সমস্যার মধ্যে আছে চিকিৎসা। এদিকে তাকালে দেখা যাবে, দুনিয়াতে এবং দেশেও যে চিকিৎসা ব্যবস্থা আছে, সেটা এই গরিবদের আয়ত্তের বাইরে। বাংলাদেশে এখন সাধারণভাবে চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই চিকিৎসা এত ব্যয়বহুল যে, সাধারণ গরিবদের তা সাধ্যের বাইরে।
এই চিকিৎসা লাভের জন্য গ্রামের গরিবরা অনেকে নিজেদের জমিজমা, গরু-ছাগল বিক্রি করেন এবং নিঃস্ব হন। বাংলাদেশে এখন গরিবদের যে নিঃস্বকরণ হচ্ছে, তার অন্যতম কারণ হচ্ছে চিকিৎসার জন্য তাদের দ্বারা জমিজমা, গরু-ছাগল বিক্রি। এ অবস্থায় বিপুলসংখ্যক গ্রামীণ মানুষ এবং শহরের বস্তিবাসী বিনা চিকিৎসাতেই মৃত্যুবরণ করেন।
এখানে কয়েকটি মূল সমস্যার উল্লেখ করা হলেও বাংলাদেশে জনগণের সমস্যার শেষ নেই। কিন্তু এসবের কোনো দিকেই দক্ষিণ ও বামপন্থী সংসদীয় বুর্জোয়া দলগুলোর কোনো দৃষ্টি নেই। নিজেদেরকে যারা কমিউনিস্ট বলে পরিচয় দিয়ে সংসদীয় ব্যবস্থার বাইরে রাজনীতি করেন, তাদেরও এ ক্ষেত্রে কোনো কাজ নেই।
কাজেই ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর রাজনীতি ক্ষেত্রে এখন জনগণকে বিধ্বস্ত অবস্থায়ই দেখা যাচ্ছে। জনগণের মধ্যে রাজনীতি করে তাদেরকে সংগঠিত না করার কারণেই আওয়ামী লীগ যেভাবে নির্বাচন করেছে, সেটা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়েছে। তারা নিজেদের বিজয় নিয়ে গালভরা নানা কথা বলতে অসুবিধা বোধ করছে না এবং নিজেদের বিজয় উৎসব তারা পালন করছে।
এর দ্বারা নতুন করে প্রমাণিত হয়েছে যে, জনগণের মধ্যে যতই রোষ, ক্ষোভ, বিক্ষোভ থাকুক, সংগঠন ছাড়া, জনগণের সংগঠিত শক্তি ছাড়া জনগণ শূন্য। এই শূন্যতা পূরণ করার চিন্তাভাবনাই এখন প্রকৃত দেশপ্রেমিক ও শ্রমজীবী জনগণের জন্য যারা কাজ করছেন, তাদের প্রধান করণীয় কাজ।
২১.০১.২০১৯
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল