ক্রাইমবার্তা রিপোটঃ ভোট জালিয়াতি ও অনিয়মের অভিযোগ এনে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীরা। নির্বাচনের পরপরই ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে পুনঃনির্বাচনের দাবি জানিয়েছিল বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর বৃহত্তর এ প্ল্যাটফরম। এই দাবিতে নির্বাচন কমিশনে স্মারকলিপি দেয়ার পাশাপাশি কূটনীতিকদের কাছে সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরেছেন। বিএনপিসহ ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশনা অনুযায়ী নির্বাচনের দিন ও আগে-পরে সংঘটিত অনিয়ম, হামলা-মামলা, গ্রেপ্তার-হয়রানি, হতাহতের ঘটনাসহ ৮টি বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত নিয়ে ছবি-অডিও-ভিডিওর সমন্বয়ে সিডিসহ কেন্দ্রীয় দপ্তরে প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন ধানের শীষের প্রায় পৌনে দুইশ’ প্রার্থী। পাশাপাশি নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়েরের প্রস্তুতিও প্রায় শেষ করেছেন।
এখন কেন্দ্রের নির্দেশনা পেলে প্রার্থীরা একযোগে মামলা দায়ের করবেন। তবে কবে নাগাদ ট্রাইব্যুনালে মামলাগুলো দায়ের করা হবে সে ব্যাপারে পরিষ্কার কিছুই বলতে পারছেন না নেতারা। এদিকে নির্বাচনের পরপরই মামলার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ফ্রন্টের নেতারা। কিন্তু এখনো সে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি।
এখন তারা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নির্দেশনার অপেক্ষায় রয়েছেন। বিএনপির নীতিনির্ধারক ফোরামের দুই সদস্যসহ ধানের শীষের বেশ কয়েকজন প্রার্থী আলাপে এমন তথ্য জানিয়েছেন। তবে বেশ কয়েকজন নেতা জানিয়েছেন, মূলত রিটার্নিং কর্মকর্তাদের কাছ থেকে কেন্দ্রভিত্তিক ভোটের ফলাফলের কাগজপত্র হাতে না পাওয়ায় মামলার উদ্যোগটি আটকে আছে। এ ছাড়া আলাদাভাবে তিনটি কমিটি গঠন করে মামলা-হামলা- গ্রেপ্তারের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করছে বিএনপি।
নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে মামলার ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির দুই সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। অন্যদিকে বিএনপির দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জানান, নির্বাচনী অনিয়ম ও মামলা-হামলার ঘটনার তথ্য-উপাত্ত নিয়ে ইতিমধ্যে পৌনে দুইশ’ আসনের প্রতিবেদন কেন্দ্রীয় দপ্তরে জমা হয়েছে। আশাকরি বাকি আসনগুলোর প্রতিবেদনও দুয়েকদিনের মধ্যে জমা পড়বে। ট্রাইব্যুনালে মামলার ব্যাপারে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে দলীয় ফোরামে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি। সিদ্ধান্ত হলে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়া হবে। তবে গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা-৭ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী মোস্তফা মোহসীন মন্টু বলেন, ট্রাইব্যুনালে মামলার জন্য বেশিরভাগ প্রার্থীই ইতিমধ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সেরেছেন। কিছু বিষয় এখন বাকি আছে। আমরা এসব নিয়ে আলোচনা করছি। চলতি সপ্তাহেই একযোগে মামলাগুলো দায়ের করা হবে।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, আমরা এখন পর্যন্ত রিটার্নিং কর্মকর্তাদের কাছ থেকে কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফলের কাগজপত্র হাতে পাইনি। এসব কাগজপত্রের জন্য অপেক্ষা করছি। কাগজপত্র পেলেই মামলার উদ্যোগ নেয়া হবে। আগামী ৩০শে জানুয়ারি ট্রাইব্যুনালে মামলার শেষদিন। বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিলে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, আগামী ৩০শে জানুয়ারির মধ্যে এসব কাগজপত্র যদি না দেয় তাহলে প্রমাণিত হবে দেশে আইন-আদালত বলতে কিছু নেই।
বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম-৫ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীরপ্রতীক জানান, ২০দলীয় জোটের প্রধান শরিক দল বিএনপির নির্দেশনা অনুযায়ী আমার নির্বাচনী আসনের সংশ্লিষ্ট তথ্য-উপাত্ত নিয়ে ৮ই জানুয়ারি একটি প্রতিবেদন ও সিডি জমা দিয়েছি। নির্বাচনে অনিয়মের চিত্র তুলে ধরে আমি টকশোতে কথা বলেছি, আমার কলাম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিয়মিত লিখছি। এখন আগামী দিনের পথচলা কী রকম হবে তা নিয়ে নির্দেশনার জন্য আমরা আমাদের ২০দলীয় জোটের প্রধান শরিক বিএনপির দিকনির্দেশনার অপেক্ষায় আছি। ধানের শীষের সঙ্গে ছিলাম, আছি, থাকবো।
জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীর ও খুলনা-৫ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী মিয়া গোলাম পরওয়ার জানিয়েছেন, তার নির্বাচনী আসনের ভোট কারচুপির তথ্য-প্রমাণসহ একটি প্রতিবেদন তিনি জমা দিয়েছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। সেই সঙ্গে অডিও-ভিডিওর একটি সিডিও জমা দেয়া হয়েছে। বিএনপির খুলনা বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ও যশোর সদর আসনে ধানের শীষের প্রার্থী অনিন্দ্য ইসলাম অমিত জানান, নির্বাচনের পর তিনি নেতাকর্মীদের জামিন তৎপরতা নিয়ে বেশি ব্যস্ত ছিলেন। পরে কেন্দ্রের নির্দেশনা অনুযায়ী নানা তথ্য-উপাত্ত নিয়ে গত সপ্তাহে ১১ পৃষ্ঠার একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন তিনি। সেই সঙ্গে ছবি, অডিও-ভিডিও ক্লিপিংসহ একটি পেনড্রাইভ ও মামলার এফআইআর-রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে অভিযোগের কপিগুলোর সংযুক্তি দিয়েছেন। অমিত জানান, ট্রাইব্যুনালে মামলার ব্যাপারে প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। এখন কেন্দ্র থেকে নির্দেশনা পেলে মামলাটি দায়ের করবো।
যে ৮ বিষয়ের ভিত্তিতে প্রতিবেদন
ধানের শীষের প্রার্থীদের আটটি বিষয়ের ভিত্তিতে প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশনা দিয়েছিল বিএনপি। সে নির্দেশনার ভিত্তিতে প্রার্থীরা নির্বাচনের দিন ও আগে-পরে হামলা, মামলা, গ্রেপ্তার, হয়রানি, হতাহত এবং ভোটকেন্দ্রে অনিয়ম ও কারচুপির তথ্য, লিখিত বর্ণনা, অডিও-ভিডিওসহ প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। কেন্দ্রীয় দপ্তর সূত্র জানায়, কেন্দ্রের নির্দেশ অনুযায়ী নির্বাচনে সহিংসতা, অনিয়ম, ভোট কারচুপিসহ ৮টি বিষয়ের তথ্য দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এই প্রতিবেদন। বিষয়গুলো হচ্ছে- ১. ভোটের আগের রাত ও ভোটের দিন ভোটকেন্দ্রে সংঘটিত ভোট জালিয়াতি; ২. প্রার্থীর নিজের ও পরিবারের অবরুদ্ধ থাকা বা হামলায় আহত ও সহায়-সম্পদের ক্ষতির তথ্য ও ছবি; ৩. নির্বাচনের দিন ধানের শীষের পোলিং এজেন্ট, প্রার্থীর সমন্বয়কারী, সমর্থক ও নেতাকর্মীদের সরকারি বাহিনী ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী কর্তৃক ভয়ভীতি প্রদর্শন, অন্যায় আচরণ, মারধর ও কেন্দ্র থেকে জোর করে বের করে দেয়া এবং গ্রেপ্তার; ৪. ভোট কেন্দ্রে প্রকৃত ভোটের চেয়ে প্রদর্শিত ভোট সংখ্যা অধিক বা প্রায় সমসংখ্যক হয়ে থাকলে কেন্দ্রের নাম সহ প্রকৃত হিসাব।
৫. নির্বাচনের আগে-পরের সহিংসতায় সরকারি বাহিনী ও ক্ষমতাসীন দলের আক্রমণে ধানের শীষের নেতাকর্মী, সমর্থকসহ যারা নিহত, আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের নাম-পরিচয়, ঠিকানা এবং আক্রান্তের ছবিসহ ঘটনার বিবরণ; ৬. নির্বাচনের আগে-পরে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট যেকোনো ধরনের অপরাধের আইনানুগ প্রতিকার লাভের জন্য থানা বা আদালতে জিডি-মামলা করা হয়ে থাকলে বা সংশ্লিষ্ট কর্র্তৃপক্ষ কর্তৃক জিডি-মামলা গ্রহণে প্রত্যাখ্যাত হয়ে থাকলে তার কপি; ৭. তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনের আগে-পরে গ্রেপ্তার অভিযানে দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকসহ গ্রেপ্তারকৃতদের নাম- ঠিকানা ও পরিচয় এবং ৮. নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন বা অন্য যেকোনো ধরনের অভিযোগের বিষয়ে রিটার্নিং অফিসার বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করে থাকলে তার ফটোকপি। নেতারা জানিয়েছেন, প্রতিবেদনগুলোর ভিত্তিতে একটি চূড়ান্ত প্রতিবেদন ও একটি তথ্যচিত্র তৈরি করা হবে। যা পরে সংবাদ সম্মেলন করে গণমাধ্যম ও বিদেশি কূটনীতিকদের কাছেও তা তুলে ধরা হবে।
তথ্য সংগ্রহে বিএনপির তিন কমিটি গঠন
দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সারা দেশে হামলা-মামলা ও লুটপাটের তথ্য সংগ্রহে আলাদা তিনটি কমিটি গঠন করেছে বিএনপি। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশনা অনুযায়ী ইতিমধ্যে কমিটিগুলো তাদের কাজ শুরু করে দিয়েছেন। সারা দেশে মামলা-হামলা ও গ্রেপ্তারের তথ্য সংগ্রহ ৬ সদস্য বিশিষ্ট কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব পেয়েছেন দলের যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল। মামলা- গ্রেপ্তারের তথ্য সংগ্রহের পাশাপাশি আইনগত সুবিধার বিষয়টি দেখবে এই কমিটি। অন্যদিকে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতা, আহত-নিহতের সংখ্যা, বাড়িঘর ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ, দলের কার্যালয় ভাঙচুর সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহে ৬ সদস্যবিশিষ্ট আরেকটি কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব পেয়েছেন দলের প্রচার সম্পাদক শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানী। দলের স্বনির্ভরবিষয়ক সম্পাদক শিরীন সুলতানাকে আহ্বায়ক করে গঠিত কমিটি তথ্য সংগ্রহ করবে নারী প্রার্থী ও নেতা-কর্মী-সমর্থকদের ওপর হামলা-মামলা বিষয়ে।