ভুইফোঁড়’ আন্তর্জাতিক সংস্থার পর্যবেক্ষকও নতুন নির্বাচন চান: নির্বাচন নিয়ে রয়টার্সের প্রতিবেদন প্রকাশ

ক্রাইমবার্তা রিপোটঃ     বাংলাদেশের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের অংশগ্রহণ নিয়ে ভোটের আগে অনেক পরস্পরবিরোধী কথাবার্তা শোনা গিয়েছিল। এখন পর্যবেক্ষণে যুক্ত হয়ে অনুতপ্ত হওয়ার কথা জানিয়েছেন সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশন নামে অননুমোদিত একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধান ও তাদের একজন কানাডীয় স্বেচ্ছাসেবী। নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে নতুন করে ভোট হওয়া উচিত বলে মনে করেন তারা।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে ‘ভুইফোড়’ ফাউন্ডেশনটির প্রধান মোহাম্মদ আব্দুস সালাম বলেছেন, নির্বাচনের আগের রাতে ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা ব্যালট বাক্স ভরে রাখেন এবং ভোটারদের ভয়ভীতি দেখিয়েছেন। প্রিসাইডিং অফিসার ও ভোটারদের কাছ থেকে এমন অভিযোগ শোনার পর তার এখন মনে হচ্ছে, আবার নতুন করে নির্বাচন হওয়ার দরকার।

ঢাকার মিরপুরের একটি ভবনে এই ফাউন্ডেশনের প্রধান অফিসের ঠিকানা। এর সভাপতির দায়িত্বে থাকা সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের সাবেক বিচারপতি ৭৫ বছর বয়সী আব্দুস সালাম বলেন, এখন আমি সবকিছু জানতে পেরেছি। বলতে দ্বিধা নেই যে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি। ফাউন্ডেশনের হয়ে কাজ করা কানাডীয় নারী পর্যবেক্ষক তানিয়া ফস্টার জানালেন, তার কাছে এখন মনে হচ্ছে নির্বাচন পর্যবেক্ষণে অংশ না নিলেই বোধ হয় ভালো হতো।

নির্বাচন চলাকালীন অনিয়মের জন্য ইতোমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের তরফ থেকে সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছে বাংলাদেশ। পশ্চিমা দেশগুলোর বড় বড় ব্র্যান্ডের তৈরি পোশাকের গুরুত্বপূর্ণ রফতানিকারক হচ্ছে বাংলাদেশ। গার্মেন্ট পণ্য রফতানিতে চীনের পরেই দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে দেশটি।

গত সপ্তাহে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ বলেছে, ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে ৫০ আসনে জরিপ চালিয়ে ৪৭টিতেই অনিয়ম দেখতে পেয়েছেন তারা। এতে জাল ভোট, জোর করে সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভরা, কেন্দ্রে বিরোধী দলীয় এজেন্ট ও ভোটারদের ঢুকতে বাধা দেয়ার অভিযোগ রয়েছে।

বার্লিনভিত্তিক দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটির বাংলাদেশ শাখা জানায়, তাদের জরিপ করা সব এলাকাগুলোতে নির্বাচনী প্রচারে কেবল ক্ষমতাসীন দলটিই সক্রিয় ছিল। কখনো কখনো স্থানীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও সরকারি সম্পদের সহায়তা নেয়া হয়েছে।

তবে বিশ্বাসযোগ্যতার অভাবের কথা বলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের তদন্ত নাকচ করে দিয়েছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম সংস্থাটিকে বিরোধী দল বিএনপির ‘পুতুল’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

আওয়ামী লীগ ও দলটির জোট সদস্যরা ৯৫ শতাংশ আসন নিশ্চিত করার পর বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট জালিয়াতির অভিযোগ তুলে নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে। তখন থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন ভোট জালিয়াতি ও ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগের তদন্তের দাবি জানিয়ে আসছে।

নির্বাচন সামনে রেখে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অসন্তোষ জানিয়ে বলেছে, প্রয়োজনীয় সময়সীমার মধ্যে ভিসা ইস্যু না করায় ভোট পর্যবেক্ষণের পরিকল্পনা বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে মার্কিন তহবিলের বেশকিছু পর্যবেক্ষক। ভিসা বিলম্বের অভিযোগ অস্বীকার করে বাংলাদেশ সরকার বলেছে, তারা যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেছে।

কানাডা, ভারত, নেপাল ও শ্রীলংকা থেকে পর্যবেক্ষক এনেছিল সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশন। নির্বাচনের দিন ও তার পরে নির্বাচনের স্বচ্ছতার কথা বলেছে সংস্থাটি।

নির্বাচনের বিজয় ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা পর নতুন বছরের প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের বাসভবনে সাংবাদিক ও নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের সামনে বক্তৃতা দেন। তখন তিনি বলেন, আপনারা আমাদের দেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষণে আসার মাধ্যমে গণতন্ত্র কীভাবে কাজ করে তা প্রদর্শনের একটা ভালো সুযোগ দিয়েছেন। মাইক্রোফোন যখন কক্ষের ভেতর ঘুরছিল, অন্যদের সঙ্গে সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষকরা নির্বাচনে বিজয়ের জন্য শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছা জানান। সৌদিভিত্তিক সংস্থা ইসলামিক কো-অপারেশনের পর্যবেক্ষকরাও তখন উপস্থিত ছিলেন।

ফাউন্ডেশনের প্রতিনিধি কানাডীয় নারী তানিয়া ফস্টার তখন সবার আগে কথা বলেন। তিনি নির্বাচনকে গণতান্ত্রিক ও সুষ্ঠু বলে উল্লেখ করেন। আমি মনে করছি, বাংলাদেশে কানাডার মতোই নির্বাচন হয়েছে।

মহাজোট নেতাদের সংশ্লিষ্টতা
ফাউন্ডেশনের নামের প্রথমাংশ ও লোগো দেখতে সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর রিজিওনাল কো-অপারেশেনের (সার্ক) মতো। তবে এ দুটির মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। ফাউন্ডেশনের মহাসচিব আবেদ আলী রয়টার্সকে বলেন, সার্কের কাছে অনুমোদন পেতে তারা আবেদন করেছেন। দ্রুতই তারা অনুমোদন পাবেন বলে আশা করছেন।

কিন্তু কাঠমান্ডুভিত্তিক সার্কের একজন মুখপাত্র বলেন, তিনি কখনোই আবেদ আলী কিংবা এই ধরনের কোনো ফাউন্ডেশনের নাম শোনেননি। এ ধরনের কোনো সংস্থাকে স্বীকৃতি দেয়নি সার্ক। কাজেই এ ফাউন্ডেশনের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই।

জানা গেছে, সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা কমিটিতে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির দু’জন সংসদ সদস্য রয়েছেন। এছাড়া প্যানেলে বিএনপি আমলের এক মন্ত্রীরও নাম দেখা যায়। তবে এতে বর্তমানের বিরোধীদলীয় কোনো সদস্য নেই।

রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা আছে এমন সংস্থাকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের সুযোগ দিতে বাংলাদেশের আইনে বারণ আছে। নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমেদ বলেন, আবেদ আলীর গ্রুপের সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক দলের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তার জানা ছিল না।

অপরদিকে ফাউন্ডেশনের বোর্ড সদস্য হিসেবে আওয়ামী লীগ ও জাপা সদস্যদের বিষয়ে জানতে চাইলে আবেদ আলী বলেন, তারা কেবল আমাদের মানবিক কার্যক্রমে সহায়তা করছেন। আমি পরিষ্কার বলতে চাই, কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ নেই।

রাজধানী ঢাকার মিরপুরের একটি ভবনের নিচতলায় ধুলোয় ঢাকা দুটি কক্ষে ফাউন্ডেশনের মূল কার্যালয়। সংস্থাটির সভাপতি আব্দুস সালাম বলেন, তাদের পর্যবেক্ষকরা মাত্র কয়েকটি কেন্দ্র পর্যবেক্ষণ করেছেন। কাজেই এতে নির্বাচন যে অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে, তা পরিষ্কার মূল্যায়ন করা যায় না।

তিনি বলেন, কয়েকজন প্রিসাইডিং অফিসার তাকে জানিয়েছেন ব্যালট বাক্স ভরতে তাদের বাধ্য করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমি সত্য বলতে চাই। কোনো রাজনৈতিক স্বার্থ পেতে আমি এসব বলছি না। তবে নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের সংগঠিত করতে সরাসরি জড়িত ছিলেন না বলেও জানান তিনি।

অবশ্য সভাপতির কথা নাকচ করে দিয়ে মহাসচিব আবেদ আলী বলেন, কে কী বলছে, তার ওপর ভিত্তি করে কি আপনি কিছু লিখতে পারেন?

কানাডার সাচকাচাওয়ান প্রাদেশিক সরকারের নীতি বিশ্লেষক তানিয়া ফস্টার এ বিষয়ে বলেন, তার দেশে বসবাস করা বাংলাদেশিদের কাছ থেকে তিনি শুনতে পান যে সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশন বিদেশি পর্যবেক্ষক খুঁজছে। এটাকে একটা মজার অভিজ্ঞতা হিসেবে বিবেচনা করে পর্যবেক্ষক হওয়ার যোগ্যতা জানতে চান তিনি।

তিনি বলেন, এরপর আমি ফাউন্ডেশন ও নির্বাচন কমিশনে আবেদন করলাম। তার আমাকে যাচাই করে পর্যবেক্ষক হিসেবে কাজ করার প্রস্তাব দিয়েছে। তার মেয়ে ক্লয় ফস্টারও পর্যবেক্ষক প্যানেলে ছিল। তবে এর আগে কোনো জাতীয় নির্বাচনে তারা আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক হিসেবে কাজ করেননি।

ফাউন্ডেশনের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্টতা ও সার্কের সঙ্গে যে এটির কোনো সম্পর্ক নেই, সে বিষয়ে তিনি কিছু জানতেন না। এটাকে চমৎকার কিছু বলে মনে হয়নি তার কাছে। খুব সাধাসিধা মনে হয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের প্রতিবেদন যে খুবই মূল্য বহন করছে- সে সম্পর্কেও আমার ধারণা নেই। আমরা কেবল ঢাকার ৯টি কেন্দ্র পর্যবেক্ষণ করেছি। অথচ আবেদ আলী জানিয়েছেন, ওই নারীর কানাডায় নির্বাচন পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতা রয়েছে। কোনো সংস্থার পক্ষেই সব নির্বাচন কেন্দ্র পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব না।

এ কথা সত্য যে ফাউন্ডেশনের সব পর্যবেক্ষকরা নিজেদের অংশগ্রহণ নিয়ে অনুশোচনা করেননি। কলকাতার গৌতম ঘোষ, নেপালের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির হাকিমুল্লাহ মুসলিম ও নাজির মিয়া বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু বলে প্রথমে তারা যে বিবৃতি দিয়েছিলেন, এখনও তাতে অটল আছেন।
নাজির মিয়া বলেন, আমরা সহিংসতার ঘটনা শুনেছি, কিন্তু নিজেদের চোখে দেখিনি। অন্যত্র কী ঘটছে- তা নিয়ে আমরা মন্তব্য করতে পারব না। আর গৌতম ঘোষ অতি সুন্দর নির্বাচন হওয়ার কথা বলেছেন

Check Also

তালায় ইউপি পরিষদ কক্ষে দুই সাংবাদিকের উপর হামলা, প্রতিবাদে মানববন্ধন

তালা প্রতিনিধি তালার ইসলামকাটি ইউনিয়ন পরিষদে সাংবাদিক আক্তারুল ইসলাম ও আতাউর রহমানের ওপর সন্ত্রাসী রমজান আলী …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।