ক্রাইমবার্তাডেক্সঃ কর্মজীবনে ছিলেন জেলা প্রশাসক অফিসের পিয়ন। যা বেতন পেতেন তা দিয়ে কোন রকমে সংসার চালানোই ছিল কঠিন। কিন্তু হঠাৎ করে সেই পিয়নই চার হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। আর এসব অভিযোগের সত্যতাও পেয়েছে খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত দল। তিনি হলেন বাগেরহাট ডিসি (জেলা প্রশাসক) অফিসের সাবেক পিয়ন (এমএলএসএস) আবদুল মান্নান তালুকদার।
তার দুর্নীতি আর প্রতারণার বিষয়ে তদন্ত শুরু হলে পরিবারসহ দীর্ঘদিন গাঢাকা দিয়েছিলেন তিনি। তবে গতকাল বৃহস্পতিবার তাকে বাগেরহাটের ব্যবসায়িক অফিসে দেখা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের খুলনা শাখার কর্মকর্তারা জানান, দুর্নীতি দমন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তার প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালানোর পর আবদুল মান্নান তালুকদার পরিবারসহ দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন।
জানা যায় যে, ভুঁইফোঁড় রিয়েল এস্টেট ও ঋণদান সমিতি খুলে এসব টাকা কামিয়েছেন তিনি। সাধারণ মানুষকে দ্বিগুণ মুনাফার লোভ দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়েছেন তিনি। ঋণ দেওয়ার কথা বলে নিজে ও নিজের পরিবারের সদস্যদের নামেও কিনেছেন জমি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক তদন্ত প্রতিবেদন এসব তথ্য উঠে এসেছে। এরপরই দুর্নীতি দমন কশিনও আব্দুল মান্নানের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তদন্তে নামছে বলে জানা গেছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আবদুল মান্নান তালুকদার মানুষের কাছ থেকে অবৈধভাবে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত দল। এরমধ্যে আবদুল মান্নান নিজের নামে শুধু জমিই কিনেছেন ১৪৫ কোটি ২৩ লাখ টাকার। এছাড়া ৬৬ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন তার মালিকানাধীন ছয়টি প্রতিষ্ঠানে। প্রায় ২ হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে এই পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। উচ্চ মুনাফার লোভ দেখিয়ে খুলনা, নড়াইল, পিরোজপুর, সাতক্ষীরা ও যশোর জেলার বিভিন্ন এলাকার সাধারণ লোকদের কাছ থেকে এই আমানত সংগ্রহ করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, নিউ বসুন্ধরা রিয়েল এস্টেট নামে একটি কোম্পানি খোলেন আব্দুল মান্নান। তার এই প্রতিষ্ঠানে প্রায় দুই হাজার গ্রাহক বিনিয়োগ করেন। তার প্রতিষ্ঠান সাধারণ মানুষ ও গ্রাহকদেরকে উচ্চ মুনাফার প্রলোভন দেখাতো। একইসাথে সাধারণ ধর্মভীরু মানুষকে আকৃষ্ট করতে ইসলামি শরিয়া মোতাবেক পরিচালিত ব্যাংকিংয়ের মতো লভ্যাংশ দেওয়ারও প্রস্তাব দিত।
প্রতিবেদনে জানা গেছে, চার বছরে অর্থ দ্বিগুণ হবে বলে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করা হয়েছে। আর দ্বিগুণ লাভের লোভে পড়ে ব্যাংক থেকে টাকা তুলেও তার প্রতিষ্ঠানে রাখেন অনেকে।
এছাড়া পিয়ন আবদুল মান্নানের মালিকানাধীন নিউ বসুন্ধরা সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি নামের আরেক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও একই ধরনের অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগের সত্যতাও পেয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এ দুইটিসহ মান্নানের মালিকানাধীন অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও নতুন করে তদন্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিসেস বিভাগের উদ্যোগে শিগগিরই এ তদন্ত শুরু হবে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের খুলনা অফিস তদন্ত করেছে। এরপরই প্রতিষ্ঠানটির অবৈধ কার্যক্রমের বিষয়ে স্থানীয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবগত করা হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক ওই প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে জনগণকে সতর্ক করে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। আবদুল মান্নান তালুকদারের প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে এখন আরও গভীর অনুসন্ধান চলছে।
জানা গেছে, বাগেরহাট জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের নেজারত শাখার সাবেক উমেদার (এমএলএসএস) আবদুল মান্নান তালুকদার দীর্ঘ ২৬ বছর চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী (পিয়ন) ছিলেন। ২০১০ সালে তিনি স্বেচ্ছায় অবসরে যান। এরপর থেকেই তার এ ব্যবসার মাধ্যমে তিনি কোটিপতি বনে যান। তার অর্থের পরিমাণ দেখে তদন্ত কর্মকর্তারাও ভড়কে যান।