ক্রাইমবার্তা রিপোটঃ এক কন্যা আর দুই পুত্রকে নিয়ে সুখের সংসার সামছুদ্দিন আলম ডালিম ও পুতুল দম্পতির। একটি দুর্ঘটনায় সেই পরিবার আজ এলোমেলো। দুই সন্তানকে হারিয়ে ওই পরিবারে চলছে শোকের মাতম। কন্যা ও পুত্রকে হারিয়ে পাগলপ্রায় বাবা-মা।
সোমবার স্কুল থেকে বাবার মোটরসাইকেলে করে বাড়ি ফেরার পথে ট্রাকচাপায় নিহত হয়েছে শিশু দুটি। ওই ঘটনায় বাবা ডালিম নিজেও গুরুতর আহত হয়েছেন।
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের বাঘৈর পোড়াহাটির শেষ মাথায় ৭ তলা বাড়ির দ্বিতীয়তলার পরিবার নিয়ে থাকেন সামসুদ্দিন আলম ডালিম। বাকি তলার ফ্লাটগুলো ভাড়া দিয়েছেন। আর্থিকভাবে বেশ সচ্ছল ওই পরিবার।
মঙ্গলবার ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, এক রুমে শুয়ে আছেন আহত ডালিম। দুই হাতে ব্যান্ডেজ। পাশের রুমে ডুকরে কাঁদছেন স্ত্রী পুতুল। আত্মীয়স্বজনরা তাদের সান্ত্বনা দিচ্ছেন। ছোট ছেলে রাফসান (৪) বাবার পাশে বসে আপন মনে খেলা করছেন। কিছুক্ষণ পরপর তাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন বাবা ডালিম।
একপর্যায়ে কিছুটা শান্ত হন তিনি। এ সময় সোমবারের ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ৩ সন্তানের মধ্যে সবার বড় ছিল মেয়ে আফরিন (১১)। মেঝ ছেলে আফসার (৯) ও ছোট ছেলে রাফসান (৪)। হাসনাবাদ এলাকার কসমোপলিটন ল্যাবরেটরি স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী ছিল আফরিন আর আফসার ওই স্কুলেই দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র ছিল।
তিনি বলেন, সকাল সাড়ে ৭টার দিকে তারা স্কুলে চলে যায়। ফিরে ১২টার দিকে। প্রাইভেট গাড়িতে করে তারা স্কুলে যাতায়াত করত। এ জন্য একজন চালকও রেখেছি। সোমবার ছিল স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত থাকি। বাচ্চাদের স্কুলে খুবএকটা যাওয়া হয় না। তাই আগের দিন চিন্তা করেছি, আমি নিজেই ওদের স্কুলে নিয়ে যাব এবং নিয়ে আসব। এতে ওদের সময় দেয়া হবে, ওরা খুশি হবে। কে জানত, এই খুশিই আমার মানিকদের জন্য কাল হবে?
ডালিম আরও বলেন, সকাল ৮টায় মোটরসাইকেলে চড়িয়ে ওদের নিয়ে আমি স্কুলে চলে যাই। প্রায় ৩ ঘণ্টা স্কুলের মাঠে অবস্থান করে বাচ্চাদের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা দেখি। এর মধ্যে মেয়ে সুই-সুতা প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়। ১১টায় ওদের নিয়ে মোটরসাইকেলে করে স্কুল থেকে বাসার উদ্দেশে রওনা দেই। বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলাম। হঠাৎ পেছন থেকে প্রচণ্ড জোড়ে ধাক্কা দেয় একটি রডবোঝাই ট্রাক। মোটরসাইকেলটি ট্রাকের সামনে আটকে যায়। ওই অবস্থায় ট্রাকের চালক অনেকটা দূর পর্যন্ত মোটরসাইকেলসহ আমাদের টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায়। এরই মধ্যে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। কয়েক মিনিট পর জ্ঞান ফেরার পর দেখি আমার দুই মানিক ট্রাকের নিচে পিষ্ট হয়ে গেছে। বিভৎস অবস্থা। বলেই তিনি কান্না জুড়ে দেন।
কান্না থামিয়ে তিনি বলেন, ট্রাকটি ধাক্কা দেয়ার পরও যদি ব্রেক কষত তাহলে হয়তো ওরা বেঁচে যেত। কিন্তু চালক তা করেনি। আমি এর বিচার চাই। আমার মতো আর কোনো বাবা-মার সন্তানকে যেন এভাবে প্রাণ দিতে না হয়।
ডালিমের ভায়রা ভাই আজিম জানান, মিটফোর্ড হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে সোমবার সন্ধ্যায় আলিয়াপাড়া পঞ্চায়েত কবরস্থানে ভাইবোনকে দাফন করা হয়েছে।
এ ঘটনায় মঙ্গলবার দুপুরে ডালিম বাদী হয়ে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা করেছেন। এতে ট্রাকচালক ও হেলপারকে আসামি করা হয়েছে।
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ওসি মোহাম্মদ শাহজামান বলেন, এ ঘটনায় হত্যা মামলা হয়েছে। ইতিমধ্যে ট্রাকচালক, হেলপার ও মালিককে শনাক্ত করা গেছে। দুর্ঘটনার পর ট্রাকটি নিয়ে চলে যায় চালক। এরপর মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান এলাকায় সড়কের পাশে ট্রাকটি রেখে চালক ও হেলপার পালিয়ে যায়। ট্রাকটি উদ্ধার করে থানায় আনা হয়েছে। আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে।
তিনি আরও বলেন, ঘাতক ট্রাকটি ছিল ৫ টন ধারণক্ষমতার। কিন্তু এতে প্রায় ১৫ টন রডবোঝাই করা হয়েছিল। এসব বিষয়গুলো আমরা তদন্ত করব।
এদিকে মঙ্গলবার সকালে কসমোপলিটন ল্যাবরেটরি স্কুলের শিক্ষার্থী তাদের দুই সহপাঠীর ‘হত্যা’র বিচার চেয়ে স্কুলের সামনে বিক্ষোভ করে। এ সময় আশপাশের কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও তাদের সঙ্গে যোগ দেয়।
পরে খবর পেয়ে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ওসির নেতৃত্বে একদল পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে বিচারের আশ্বাস দিলে তারা ক্লাসে ফিরে যায়।