ক্রাইমবার্তা রিপোটঃ বাংলাদেশে বিরোধী দল বিএনপি সাম্প্রতিক অতীতে তাদের ভারত-বিরোধিতার পুরনো লাইন ত্যাগ করার নানা ইঙ্গিত দিলেও ভারতের দিক থেকে তেমন সদর্থক কোনও সাড়া পায়নি। ফলে ৩০শে ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর বিএনপি আবার ভারত-বিরোধিতার দিকে ঝুঁকতে পারে বলেও আভাস মিলেছে, ইতিমধ্যেই সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশীদের হত্যার বিরুদ্ধেও তারা সরব হয়েছে। বিবিসি বাংলা এই খবর প্রকাশ করে।
কিন্তু বিএনপি নেতাদের চেষ্টা সত্ত্বেও কেন তারা শেষ পর্যন্ত ভারতকে একেবারেই পাশে পায়নি?
বস্তুত বাংলাদেশে এবারের সাধারণ নির্বাচনের বেশ কয়েকমাস আগে থেকেই বিএনপি নেতারা যেভাবে দিল্লি সফর করছিলেন ও নানা ধরনের ‘ফিলার’ পাঠাচ্ছিলেন তাতে এটা পরিষ্কার ছিল যে তারা ভারতের সাথে সম্পর্ক নতুন করে শুরু করতে চান।
গত বছর ভারতে এসে বিএনপি নেতারা দেখা করেছিলেন মূলত ক্ষমতাসীন বিজেপির বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা (যাদের অন্যতম দলের সাধারণ সম্পাদক রাম মাধব) এবং দিল্লির বিভিন্ন থিঙ্কট্যাঙ্কের প্রতিনিধিদের সাথে।
তারা অনেকেই বলছেন, নির্বাচনে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগকে খোলাখুলি সমর্থন না-করে ভারত অন্তত একটা নিরপেক্ষতা বজায় রাখুক, বস্তুত সেটাই ছিল দিল্লির কাছে বিএনপির অনুরোধ। সম্ভবত সে কারণেই তিস্তা চুক্তির মতো ইস্যুকেও তারা নির্বাচনে একেবারেই ব্যবহার করেনি।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভারতের ভূমিকায় এমন কিছুই দেখা যায়নি যা বিএনপিকে বিন্দুমাত্র খুশি করতে পারে।
ভারতে এসে বিএনপি-র প্রতিনিধিরা যাদের সাথে দেখা করেছিলেন তাদের অন্যতম বিজেপির পলিসি রিসার্চ সেলের সিনিয়র সদস্য অনির্বাণ গাঙ্গুলি। ড: গাঙ্গুলির মতে, জামাতের সাথে বিএনপির সম্পর্কই আসলে এই সমস্যার মূলে।
তিনি বিবিসিকে বলছিলেন, ‘কথাটা হল বিএনপি তাদের ভারত-বিরোধী অবস্থান বদলাবে কি বদলাবে না, সেটা কিন্তু গৌণ’। তিনি বলেন, ‘প্রধান ব্যাপারটা হল জামাতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক তারা আগে পরিষ্কার করুক। ওটা নিয়ে তারা লুকোচুরি খেলেই যাচ্ছে!’
‘বাকি সবই অন্য কথা। বিএনপি কী ভাবল না-ভাবল তাতে ভারতের বিশেষ কিছু এসেও যায় না’।
‘কিন্তু যে রাজাকারদের বিএনপি আজীবন তোষামোদ করে এসেছে তাদের প্রতি অবস্থান পরিষ্কার না-করলে ভারতেরও যে বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক রাখা সম্ভব নয়, এটা তো বুঝতে হবে!’
বিএনপি নেতারা প্রায়ই ভারতের নীতি-নির্ধারকদের উদ্দেশে পরামর্শ দিয়ে থাকেন, বাংলাদেশে তাদের সব ডিম একটাই ঝুড়িতে (অর্থাৎ আওয়ামী লীগ) রাখাটা কোনও বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
তার জবাবে অনির্বাণ গাঙ্গুলি কটাক্ষ করে এমন কথাও বলছেন, ‘যারা নিজেদের সব ডিম জামাতের ঝুড়িতে রেখে বসে আছে, তাদের মুখে অন্তত এ ধরনের কথা মানায় না!’ ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মুচকুন্দ দুবে ঢাকাতেও ভারতীয় হাই কমিশনার হিসেবে বহু বছর দায়িত্ব পালন করেছেন।
তিনিও বিবিসিকে বলছিলেন, ‘বিএনপির এ ধরনের আউটরিচ কিন্তু নতুন কিছু নয় – গত পাঁচ-দশ বছর ধরেই তারা এই চেষ্টা চালাচ্ছে’।
‘ভারতের ভেতর তাদের হয়ে যারা লবিইং করতে পারেন বলে বিএনপি-র ধারণা, তাদের সঙ্গে এসে দলের নেতারা দেখাও করছেন’।
‘কিন্তু সমস্যা হল, মানুষ তো মুখের কথায় নয় – বরং পুরনো অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই চলে।’
‘আমরা কী করে ভুলি খালেদা জিয়ার আমলে দুদেশের সম্পর্ক একেবারে থমকে গিয়েছিল?’
তিনি আরও জানাচ্ছেন, ভারতের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর বদ্ধমূল ধারণা চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বিএনপি আমলে যে দশ ট্রাক অস্ত্র পাচার করার চেষ্টা হয়েছিল তাতে আইএসআই তথা পাকিস্তান সরকারে প্রত্যক্ষ যোগসাজস ছিল।
তবু ঘটনা হল, ঠিক সোয়া ছ’বছর আগে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া যখন তার শেষ ভারত সফরে এসেছিলেন তখন দিল্লিও বলেছিল ‘অতীতে যা হওয়ার হয়ে গেছে – দুপক্ষের কেউই আর গাড়ির রিয়ার ভিউ মিররে তাকাবে না, অর্থাৎ পেছনে না-ফিরে এগোতে চাইবে সামনের দিকেই’।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন মুখপাত্র সৈয়দ আকবরউদ্দিনের ওই মন্তব্য অবশ্য অর্থহীন প্রতিপন্ন হয়ে যায় কয়েক মাসের ভেতরই, যখন রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রণব মুখার্জির প্রথম ঢাকা সফরে খালেদা জিয়া তার সঙ্গে দেখা করতে অস্বীকার করেন।
তখন থেকেই বিএনপির সাথে ভারতের সম্পর্কে আবার অস্বস্তির শুরু – যাতে ছায়া ফেলতে শুরু করে তিক্ত ইতিহাস।
ঢাকার ভারতীয় দূতাবাসে বহু বছর কাজ করে আসা নিরাপত্তা বিশ্লেষক শান্তনু মুখার্জির কথায়, ‘প্রথম সমস্যা হল বিএনপি-র পাকিস্তানপন্থী ভূমিকা। ভারতের চেয়ে তারা যে পাকিস্তানের অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ, সেটা তো সহজেই বোঝা যায়’।
‘তা ছাড়া খালেদা জিয়ার আমলে ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলে আসামের আলফা কিংবা মণিপুর-নাগাল্যান্ডের জঙ্গীরাও বাংলাদেশে আশ্রয়-পশ্রয় পেয়েছে বলে ভারতের কাছে প্রমাণ আছে, আর সেটাও ছিল আমাদের জন্য খুবই বিপজ্জনক’।
সাম্প্রতিক নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী এবং কামাল হোসেনের দলের সাথে বিএনপি-র গাঁটছড়াও ভারত ভালভাবে নেয়নি, সে কথাও বলছিলেন শান্তনু মুখার্জি।
‘দেখুন, কামাল হোসেনের মতো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি, ভারতের বন্ধুকেও যেভাবে বিএনপি জোটে টানল এবং তিনি একরকম ঘুরিয়ে জামাতের হাত ধরলেন সেটাতেও ভারত খুবই হতাশ হয়েছে’।
‘পরে তিনি হয়তো জামাতের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক অস্বীকারও করেছেন, তবে ততক্ষণে যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে’।
‘হ্যাঁ, পলিটিক্যাল কনভেনিয়েন্স বা রাজনীতির স্বার্থে এসব হয়তো চলে – কিন্তু ভারতের সার্বভৌমত্ব বা নিরাপত্তার নিরিখে আমি তো বলব বিএনপির পাশে না-দাঁড়িয়ে ভারত একেবারে ঠিক করেছে’, বলছেন শান্তনু মুখার্জি।
দিল্লিতে অনেকেই আবার মনে করেন, বিএনপি-র নেতৃত্বে যতদিন তারেক রহমান আছেন ততক্ষণ ভারতের পক্ষে কিছুতেই দলটিকে বিশ্বাস করা সম্ভব নয়’।
রাজধানীর নামী থিঙ্কট্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিস অ্যান্ড অ্যানালিসিসের সিনিয়র ফেলো স্ম্রুতি পট্টনায়ক এ প্রসঙ্গে বলেন, আপত্তিটা ঠিক ব্যক্তি তারেক রহমানকে নিয়ে নয়, বরং আইএসআই ও জামাতের সাথে তার কথিত ‘যোগসাজস’ নিয়ে।
“২০০১ সালেই কিন্তু ভারত তারেকের সঙ্গে এনগেজমেন্ট চেয়েছিল, কিন্তু তাতে তখন সাড়া মেলেনি। এখনও ভারত ও তারেক রহমান দুদিক থেকেই পরস্পরের প্রতি একটা সন্দেহ ও অবিশ্বাস রয়ে গেছে।”
‘আর বিএনপিও যতক্ষণ না ক্ষমতায় এসে প্রমাণ করতে পারছে যে তাদের ভারত-বিরোধী অবস্থান সত্যিই পাল্টে গেছে ততক্ষণ সেটা থাকবে বলেও আমার বিশ্বাস’, জানাচ্ছেন ড: পট্টনায়ক।
রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তারেক রহমান যে এখনও ভারতের আস্থা অর্জন করতে পারেননি, সেই ইঙ্গিত ছিল বিজেপি নেতা অনির্বাণ গাঙ্গুলির কথাতেও।
ড: গাঙ্গুলি বলছিলেন, ‘তারেক রহমান নেতা হিসেবে এখনও পর্যন্ত নিজেকে প্রমাণ করতে পারলেন কোথায়? তিনি তো তার নিজের দলের ভেতরের ব্যাপার-স্যাপারই সামাল দিতে পারছেন না!’
মুচকুন্দ দুবে আবার বলছিলেন, বিএনপি ও ভারতের মধ্যেকার সম্পর্কে একটা মানসিকতার সমস্যাও রয়ে গেছে।
তিনি উদাহরণ দিয়ে বলছেন, তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও খালেদা জিয়ার আমলে সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রিয়াজ রহমান পর্যন্ত শেখ হাসিনার সবশেষ ভারত সফরের পর ঢাকার পত্রিকায় নিবন্ধ লিখে মন্তব্য করেছিলেন ওই সফরে ‘ভারতেরই সব সুবিধে হয়ে গেল’।
‘যেন বাংলাদেশ সরকারের কাজই হওয়া উচিত ভারতের অসুবিধা করা – যেমনটা পাকিস্তান চায়!’
‘আর বিএনপির এই ধরনের মনোভাব না-পাল্টালে তাদের প্রতি ভারতের দৃষ্টিভঙ্গীও কখনওই বদলাবে না’, বলেই দুবে-সহ দিল্লির অনেক বিশেষজ্ঞর ধারণা।