আবু সাইদ বিশ্বাসঃ ক্রাইমর্বাতা রির্পোট: সাতক্ষীরা: মজুরি বৈষ্যমের মধ্য দিয়ে সাতক্ষীরায় বোরোর আবাদ শুরু হয়েছে। জেলাতে বোরো আবাদে পুরুষের পাশা পাশি এখন নারীরা ব্যস্ত সময় পার করছে। গত কয়েক বছরে এ জেলাতে কৃষিতে নারীর সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি পেলেও বাড়িনি তাদের মজুরি। ফলে শ্রম আইন ও মজুরি বৈষ্যমের কারণে নারীদের মধ্যে ক্ষোভ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আমরাও বেটাদের মতোই রোদে পুড়ে সমান কাজ করি। কিন্তু মজুরি বেলায় আমাদের কম দেয়। আমরা এ নিয়ে কোনো কথা কইতে গেলেই মাহজন রাগ করে। কাজ থেকে বাদ দিয়া দেয়। এক দেশে দুই নিয়ম ক্যান। আমরা গরিব বইলাই কি এই অবিচার’- ক্ষেভের সঙ্গে কথাগুলো বলছিল সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার নারী কৃষিশ্রমিক উষা রাণী। তিনি আরো জানান,কর্মক্ষেত্রে পুরুষদের সব সময়ই অগ্রাধিকার দেয়া হয়। এমনকি পুরুষ শ্রমিকরা কাজে ফাঁকি দিলেও মালিক তাদের কিছু বলে না। কিন্তু নারী শ্রমিকদের বেলায় বিষয়টি সম্পূর্ণ উল্টো। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে একই ধরনের কাজ করা সত্ত্বেও নারী শ্রমিকদের মজুরি প্রদানের ক্ষেত্রে ঠকানো হয়। একজন পুরুষ শ্রমিককে যদি দৈনিক কাজের জন্য ৫০০ টাকা দেয়া হয় তাহলে একজন নারী শ্রমিককে দেয়া হয় ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। এমন অভিযোগ অরো অনেকের।
তবে একই উপজেলার নগরঘাটা এলাকার রবিউল ইসলাম জানান, চলতি মৌসুমে তার জমিতে ১০ থেকে ১২ জন শ্রমিক কাজ করছে। সাতক্ষীরার ভাষায় তাদেরকে জন বলে। তার ভাষায় ১২ জন জনের মধ্যে ১০ জনই নারী। কারণ হিসাবে তিনি জানালেন নারী জনের মজুরি কম। সারা দিন পুরুষকে ৫শ টাকা দিলে নারীদের সাড়ে ৩শ টাকা দিলে হয়। তার কথায় সব নারীরা পুরুষের মত কাজ করতে পারে না। তবে নারী শ্রমিকরা জানান, পুরুষের মত সবাই সমান কাজ করতে না পারলেও যেসব নারীরা পুরুষেরমত বা তাদের চেয়ে বেশি কাজ করতে পারে তাদেরতে পুরুষের মত মজুরি দেয়া হয়না।
দিন দিন উপকুলীয় এ জেলাটিতে কৃষিতে পুরুষের চাইতে নারী শ্রমিকের চাহিদা বাড়ছে। তুালনা মূলক নারী শ্রমিকের পারিশ্রমিক কম থাকায় মাহজনরা নারী শ্রমিকের শ্রম নিতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর মতে ২০১১ সালের জরিপে সাতক্ষীরা জেলা মোট জনসংখ্যা ছিল ১৯ লক্ষ ৮৫ হাজার ৯৫৯ জন। এর মধ্যে নারীর সংখ্যা ১০ লক্ষ ৩ হাজার ১৮২ জন এবং পুরুষের সংখ্যা ৯ লক্ষ ৮২ হাজার ৭৭৭ জন। জেলা পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতে বর্তমানে জেলাতে পুরুষ ও মহিলার সংখ্যা ২৩ লাখের কাছা কাছি। পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা বেশি। জেলাতে প্রায় ৪ লক্ষ নারী বছরের বিভিন্ন সময়ে শ্রম বিক্রি করেন। আর দুই লক্ষ নারী সারা বছরই শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। প্রায় ৪ লক্ষাধীক নারী স্বামীর গৃহে কাজ করেন। ২ লক্ষাধীক নারী লেখাপড়ার কাজে কর্মরত। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে এমন চিত্র উঠে এসেছে জেলাটিতে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৫ সালের তথ্য মতে, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে গত দুই বছরে মাসিক মজুরি বা বেতন বেড়েছে ৪৯ টাকা। এ ক্ষেত্রে পুরুষ শ্রমিকদের বেতন বা মজুরি সামান্য বৃদ্ধি পেলেও নারীদের ক্ষেত্রে তা হয়নি। দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই নারী। কিন্তু সেই নারীরা কর্মক্ষেত্রে নানাভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। তারা পুরুষদের তুলনায় মজুরি কম পাচ্ছে। জেলাতে নারী শ্রমিকদের বেশিরভাগই নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে আগত। ফলে তাদের সামাজিক অবস্থা মালিকের সঙ্গে দরকষাকষির পর্যায়ে থাকে না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, যে নারী শ্রমিক সে নিজেই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। ফলে তার ওপর নির্ভর করে পুরো পরিবারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা। একদিন কাজ করতে না পারলে তার পরিবার না খেয়ে থাকে।
কয়েক জন নারীর শ্রমিকের সাথে কথা হয়। তারা জানান, সমাজে নারী হল-অবহেলা, বৈষম্য আর নির্যাতনের শিকার ভাগ্য বিড়ম্বিত এক জীবন। যে জীবনে সংকট নিত্যদিনের, নেই সমাধান।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত বাংলাদেশ শ্রমশক্তি বিষয়ক এক জরিপ বলছে, কৃষি অর্থনীতিতে গ্রামীণ নারীর অবদান ৬৪.৪ শতাংশ এবং পুরুষর অবদান ৫২.৮ শতাংশ। বিবিএসের অপর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এক দশকের ব্যবধানে দেশের কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে ১০২ শতাংশ। সেখানে পুরুষের অংশগ্রহণ কমেছে ২ শতাংশ। ২০০০ সালে দেশের কৃষিতে নারী শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৩৮ লাখ। ২০১০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ কোটি ৫ লাখে। বর্তমানে তা প্রায় দেড় কোটি ছাড়িয়ে গেছে।
প্রতিবেদন বলছে, ১০ বছরের মধ্যে প্রায় ৭০ লাখ নারী কৃষিতে যুক্ত হয়েছেন। কৃষির বিভিন্ন পর্যায়ে শ্রমবিভাজনের কারণে নারী শ্রমিকের চাহিদা বেড়েছে। বেশিরভাগ পুরুষ পেশা পরিবর্তন করে অ-কৃষিকাজে নিয়োজিত হচ্ছেন, কিংবা গ্রাম ছেড়ে শহরে পাড়ি জমাচ্ছেন ।
জেলা খামারবাড়ি সূত্র মতে চলতি মৌসুমে জেলাতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭৪ হাজার ৭৩৩ হেক্টর জমিতে।
সাতক্ষীরা সদরে ২৩ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে। যা থেকে ধানের উৎপাদন ধরা হয়েছে ৯৬ হাজার ৩৮৮মেঃটন। কলারোয়া উপজেলাতে আবাদ হয়েছে ১২ হাজার ৭৭১ হেক্টর জমিতে। সব ঠিক থাকলে ধান উৎপান হবে ৫০ হাজার ৬৮৫ মেঃটন। তালাতে আবারে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৮ হাজার ৭১৭ হেক্টর জমিতে । যার উৎপাদিত ধানের লক্ষ্য মাত্রা ধরা হয়েছে ৭৭হাজার ২৮১ মেঃটন। দেবহাটাতে আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ হাজার ৮৬০ হেক্টর এবং ধান উৎপাদনের লক্ষ্য মাত্রা ধরা হয়েছে ২৪ হাজার ৩৮২ মেঃটন। কালিগঞ্জ উপজেলাতে আবাদের লক্ষ্য মাত্রা ধরা হয়েছে ৫ হাজার ২৯০ হেক্টর জমিতে যা থেকে উৎপাদিত ধানের পরিমান ধরা হয়েছে ২১ হাজার ৩৬০ মেঃটন। আশাশুনিতে আবাদ হয়েছে ৬ হাজার ৪৬৫ হেক্টর জমিতে যা থেকে উৎপাদিত হবে ২৭ হাজার ১৪৪মেঃটন। অন্যদিকে লোনা অধ্যুষিত শ্যামনগর উপজেলাতে বোরোর আবাদ ধরা হয়েছে ২ হাজার ৩০ হেক্টর জমিতে যা থেকে উৎপাদিত ধানের পরিমান ধরা হয়েছে ৮ হাজার ১৯০ মেঃটন।
তবে গতকাল ৩ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত আবাদ হয়েছে ৫৯ হাজার ২৭৫ হেক্টর জমিতে। অল্প কয়েক দিনের মধ্যে আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে জেলা খামারবাড়ি সূত্র জানায়।
এদিকে জেলায় বোরো মৌসুমে মাঠে নারী শ্রমিকের সংখ্যা চোখে পড়ার মত। অনেক ক্ষেতে পুরুষ মহিলা সমান সংখ্য আর অনেক ক্ষেতে পুরুষের চাইতে নারী শ্রমিকের সংখ্যা বেশি।
সরেজমিনে পাওয়া তথ্যসূত্র বলছে, শুধু ধান রোপন নয়, , ধান শুকানো, ধান মাড়াই, সবজি আবাদ, গরু-ছাগল পালনসহ বিভিন্ন ধরনের কাজে সম্পৃক্ত এখানকার নারী। পুরুষের অনুপস্থিতিতে নারী প্রধান পরিবারের ব্যক্তি নারী প্রধানত কৃষি কাজের মাধ্যমেই জীবিকা নির্বাহ করছেন। শুধু উৎপাদন নয়, একাধারে ফসল উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বাজারজাতকরণের সঙ্গে জড়িত নারীরা। খাঁটুনি বেশি, কাজে ফাঁকির সুযোগ নেই, আবার কাজের সময়সীমাও বেশি- অথচ মজুরি কম। কৃষিতে নারীর অবদানের কোন স্বীকৃতিও এখনো নেই।
তালার ফসলের মাঠে নারী কৃষকের দেখা মেলে। অন্যান্য স্থানে সবজি আবাদ, গরু-ছাগল পালন, মৎস্য খামার পরিচালনা, হাঁস-মুরগি পালন, ফসলের ক্ষেত নিড়ানি, মাঠের ফসল ঘরে তোলা ইত্যাদি কাজে অসংখ্য নারীকে দেখা যায়।
সদরের ভোমরা এলাকায় বসবাসরত নারী কৃষক গোপী রাণী বলেন, পুরুষের চেয়ে আমরা বেশি কাজ করি। কাজে ফাঁকি দেই না। বিড়ি-সিগারেট টানতে আমাদের সময় অপচয় হয় না। সময় ধরে কাজে আসতে হয়, যেতে হয়। তবুও আমাদের মজুরি কম। মালিক বলে, আমরা নারী, আমরা পুরুষের মত কাজ পারি না।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থার (বিআইডিএস) গবেষণায় বলা হয়েছে, গ্রামীন ৪১ শতাংশ নারী চাষাবাদের সঙ্গে জড়িত। কৃষি তথ্য মতে ফসল উৎপাদনের ২১টি ধাপের ১৭টিতেই নারীর সরাসরি অংশগ্রহণ রয়েছে।
একই এলাকার কৃষি নালীদের দাবী জাতীয় কৃষি নীতিমালায় নারী কৃষকের সুস্পষ্ট সংজ্ঞা সংযুক্ত করে ‘কৃষক’ হিসেবে নারীদের কৃষি উপকরণ সেবা প্রাপ্তিতে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দিতে হবে। তাদের কাছে কৃষি সংক্রান্তসব তথ্য পৌঁছাতে হবে। প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি বাজার ব্যবস্থায় গ্রামীণ নারীর অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করতে যথাযথ সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এখ্যাতে সংশ্লিষ্টরা বলছে, নারীদের কাজের সঠিক মূল্যায়ন করতে পারলে দেশের গ্রামীণ অর্থনীতি অনেক খানিক চাঙ্গা হবে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক অরবিন্দ বিশ্বাস জানান,কৃষিতে নারী শ্রমিকদের সম্পৃক্ততা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাদের কাজকে কোন রকমে খাটে করে মুল্যায়নের সুযোগ নেই। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে নারী শ্রমিকদের মজুরি বৈষ্যমের ব্যাপারে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে। এছাড়া এবছর জেলাতে বোরো আবাদেও লক্ষ্য মাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলেও তিনি আশাবাদী।
সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক জানান, এসএম মোস্তফা কামাল জানান, সরকারের গৃহীত নানা মুখি বাস্তব পদক্ষপের কারণে নারী বৈষম্য অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। জেলা মহিলা অধিদপ্তর, সমাজ সেবা, যুবউন্নয়ন, বিনেপোতা টিটিসি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রসহ বিভিন্ন এনজিও নারীদের অধীকার নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে। বিশেষ করে নারী বৈষম্য কমাতে সকলের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনা দরকার। বাল্য বিবাহ বন্ধ হলে নারী নির্যতন হ্রাস পাবে। এজন্য সকলের সহযোগীতা দরকার। আর নারীদের কাজকে খাটো করে না দেখে তাদের মূল্যায়ন করা দরকার আমাদের সকলের।
–আবু সাইদ বিশ্বাসঃসাতক্ষীরা ০৩/০১/১৯
Check Also
সাতক্ষীরা আলিয়া কামিল মাদ্রাসার হিফজুল কুরআন বিভাগের ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে আলোচনা সভা, দস্তরবন্দি, সম্মাননা প্রদান ও মিলন মেলা অনুষ্ঠিত
আব্দুল করিম,নিজস্ব প্রতিনিধি : সাতক্ষীরা আলিয়া কামিল মাদ্রাসার হিফজুল কুরআন বিভাগের ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে …