ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোটঃ একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচনের ফলাফল চ্যালেঞ্জ করেছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ৭৪ জন প্রার্থী। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও বিএনপির ধানের শীষের প্রার্থী তারা। বৃহস্পতিবার একদিনেই হাইকোর্টের নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে জমা পড়েছে ৫৬টি আবেদন। জমার শেষ দিনে হাইকোর্টের নির্বাচনী আবেদন শাখায় ছিল ভিড়। হিমশিম খেতে হয়েছে শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের। এসব আবেদনের শুনানি হবে নির্বাচনী আবেদনের এখতিয়ার পাওয়া হাইকোর্টের ৬টি একক বেঞ্চে।
আবেদনকারীরা বিজয়ী প্রতিদ্বন্দ্বীর ফল বাতিল এবং সংশ্লিষ্ট সংসদীয় আসনের পুরো নির্বাচন বাতিল চেয়েছেন। আবেদনে নির্বাচনের আগের রাতে বেশির ভাগ কেন্দ্রে ব্যালটবাক্স ভরে রাখা, বিএনপির পোলিং এজেন্ট ভয়ভীতি দেখিয়ে ভোট কেন্দ্রে দায়িত্ব পালনে বাধা, ভোটারদের ভয় দেখানো, প্রকাশ্যে ব্যালট পেপারে নৌকায় সিল মারতে বাধ্য করাসহ নানা অভিযোগ এনেছেন প্রার্থীরা।
নির্বাচনী আবেদন একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় করতে হয়।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ (আরপিও) এর ৫১ (২) ধারায় বলা হয়েছে আবেদনকারী নির্বাচিত প্রার্থীর জয় বাতিল, আবেদনকারী বা অপর কোনো প্রার্থীকে জয়ী ঘোষণা এবং পুরো নির্বাচন বাতিল চাইতে হবে। ওই প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই আবেদন করা হয়।
আরপিও’র বিধান অনুযায়ী নির্বাচনের পর প্রকাশিত ফলাফলের প্রজ্ঞাপন জারির ৪৫ দিনের মধ্যে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে আপত্তি বা ফলাফল চ্যালেঞ্জ করতে হবে। সে হিসেবে আজ শুক্রবার আবেদন দাখিলের শেষ দিন। কিন্তু সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ার কারণে বৃহস্পতিবারই ছিল আবেদনের শেষ সময়সীমা। তবে আইনজীবীরা জানিয়েছেন তামাদির কারণ দেখিয়ে পরেও আবেদন করার সুযোগ রয়েছে।
একেকজন আবেদনকারীকে ১০টি করে পৃথক আবেদন জমা দিতে হয়েছে। বিবাদী করা হয়েছে নির্বাচন কমিশন, নিজ নিজ আসনের প্রার্থীদের। এসব প্রার্থীদের বিবাদী করে তাদের প্রতি নোটিশ প্রদান এবং সাক্ষীদের তলবের আরজি রয়েছে আবেদনে।
সূত্র জানিয়েছে, গত ২৯শে জানুয়ারি প্রথম ঢাকা-৬ আসনের জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ধানের শীষের প্রার্থী ও গণফোরামের অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে আবেদন করেন। দ্বিতীয় আবেদনটি গত ৪ঠা ফেব্রুয়ারি গণফোরামের অপর প্রার্থী মানিকগঞ্জ-৩ আসনের মফিজুল হক খান কামাল দায়ের করেন। তৃতীয় আবেদনটি ৬ই ফেব্রুয়ারিতে কুড়িগ্রাম-২ আসনের মেজর জেনারেল (অব.) আ আ ম স আমিনের। ৭ই ফেব্রুয়ারি করেন চট্টগ্রাম-১৫ আসনের মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী। এরপর গত ১২ই ফেব্রুয়ারি ঝিনাইদহ-৪ আসনের সাইফুল ইসলাম ফিরোজ আবেদন করলে দুই দিনে ১৪টি আবেদন জমা পড়ে। বৃহস্পতিবার শেষ দিনে ৫৬ জন আবেদন করেন হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায়।
মাগুরা-২ আসনের ধানের শীষের প্রার্থী ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী নিতাই রায় চৌধুরী সংশ্লিষ্ট শাখায় আবেদনে স্বাক্ষর করতে আসেন। স্বাক্ষর করতে করতে তিনি মানবজমিনকে বলেন, ৩০শে ডিসেম্বর দেশে কোনো নির্বাচন হয়নি। এ নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক চরিত্র ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। আমরা এখন স্যাটেলাইট রাষ্ট্রের নাগরিক। আমরা জালিয়াতির এ নির্বাচন বাতিলের দাবি করছি।
ঢাকার প্রার্থীদের মামলার দায়িত্ব পাওয়া আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেছেন, ‘প্রতিটি নির্বাচনী আসনে ক্ষমতাসীন দলের প্রাার্থীরা যে বিশাল ব্যবধানে জয়ী হয়েছে, সে সম্পর্কে কতগুলো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ যেগুলো আমরা আমাদের প্রার্থীদের কাছে থেকে পেয়েছি, সেগুলো আমরা আবেদনে উল্লেখ করেছি।’ উদাহরণ হিসেবে একটি মামলার অভিযোগের বিবরণ দিয়ে এই আইনজীবী বলেন, ‘ঝিনাইদহ ৪ আসনে বিএনপি প্রার্থীর অভিযোগ করেছেন যে একটি কেন্দ্রে মোট ভোটার ২২৬২ জন। সেখানে ভোট পড়েছে ২২৫১টি। সেখানে ভোটার তালিকা থাকা ২৫ জন এরই মধ্যে মারা গেলেও রিটার্নিং অফিসারের হিসেবে দেখা গেছে ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হননি ভোটার তালিকায় থাকা মাত্র ১১ ব্যক্তি। তাহলে ১৪ জন মৃত ব্যক্তি কি ভোট দিয়েছেন? কে কবে মারা গেছে সেটা আমরা আবেদনে উপস্থাপন করেছি।’
৭৪ জন আবেদনকারী হলেন-অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, ঢাকা-৬, মফিজুল ইসলাম খান কামাল (মানিকগঞ্জ-৩), মেজর জেনারেল (অব.) আ আ ম স আমিন (কুড়িগ্রাম-২), আব্দুল মোমেন চৌধুরী (চট্টগ্রাম-১৫), সাইফুল ইসলাম ফিরোজ (ঝিনাইদহ-৪), আবুল কালাম আজাদ সিদ্দিকী (টাঙ্গাইল-৭), অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন (বরিশাল-৩), রুমানা মাহমুদ (সিরাজগঞ্জ-২), জহির উদ্দিন স্বপন (বরিশাল-১), শাহ রিয়াজুল হান্নান (গাজীপুর-৪), নাসের রহমান (মৌলভীবাজার-৩), আব্দুল হাই (মন্সিগঞ্জ-৩), হাফিজ ইব্রাহিম (ভোলা-২), রুহুল আমিন দুলাল (পিরোজপুর-৩), ডা. দেওয়ান মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন (ঢাকা-১৯), হাফিজ উদ্দিন আহমেদ (ভোলা-৩), তাসভীর উল আলম (কুড়িগ্রাম-৩), মো. সাইফুল ইসলাম (রংপুর-৬), মো. সাদেক রিয়াজ (দিনাজপুর-২), মোস্তফা মহসীন মন্টু (ঢাকা-৭), নজরুল ইসলাম আজাদ (নারায়ণগঞ্জ-২), মইনুল ইসলাম খান শান্ত (মানিকগঞ্জ-২), ইরফান ইবনে আমান অমি (ঢাকা-২), নবিউল্লাহ নবী (ঢাকা-৫), আশরাফ উদ্দিন (নরসিংদী-৫), মো. আমিরুল ইসলাম খান (সিরাগঞ্জ-৫), শহিদুল ইসলাম (টাঙ্গাইল-১), ফরহাদ হোসেন আজাদ (পঞ্চগড়-২), মো. হাসান রাজিব প্রধান (লালমনিরহাট-১), মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী (চট্টগ্রাম-১৬), মো. আকতারুজ্জামান মিয়া (দিনাজপুর-৪), মো. শাহজাহান মিয়া (চাাঁপাইনবাবগঞ্চ-১), মিজানুর রহমান (সুনামগঞ্জ-৫), জি কে গউছ (হবিগঞ্জ-৩), মজিবুর রহমান চৌধুরী (মৌলভীবাজার-৪), ফারুক আলম সরকার (গাইবান্ধা-৫), শফি আহমেদ চৌধুরী (সিলেট-৩), মো. আনোয়রুল হক (নেত্রকোনা-২), শাহ মো. ওয়ারেস আলী (জামালপুর-৫), নিতাই রায় চৌধুরী (মাগুরা-২), অনিন্দ্য ইসলাম অমিত (যশোর-৩), মো. আবু সুফিয়ান (চট্টগ্রাম-৮), মাসুদ অরুণ (মেহেরপুর-১), আমিন উর রশিদ (কুমিল্লা-৬), ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন (নোয়াখালী-১), শহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া (খাগড়াছড়ি), সাব্বির আহমেদ (রংপুর-৩), মুন্সী রফিকুল আলম (ফেনী-১), জয়নাল আবদীন ফারুক (নোয়াখালী-২), সাচিং প্রু (বান্দরবান) শেখ ফরিদ আহমেদ মানিক (চাঁদপুর-৩), আবুল খায়ের ভূঁইয়া (লক্ষ্মীপুর-২), জাকির হোসেন সরকার (কুষ্টিয়া-৩), রকিবুল ইসলাম (খুলনা-৩), শ্যামা ওবায়েদ ইসলাম (ফরিদপুর-২), আনিসুর রহমান (মাদারীপুর-৩), আজিজুল বারি হেলাল (খুলনা-৪), শাহ মো. আবু জাফর (ফরিদপুর-১), মো. শরিফুজ্জামান (চুয়াডাঙ্গা-১), হাবিবুল ইসলাম হাবিব (সাতক্ষীরা-১), আলী নেওয়াজ মো. খৈয়ুম (রাজবাড়ী-১)।
মেহেরপুর-১ আসনের ধানের শীষের প্রার্থী মাসুদ অরুণের আইনজীবী ব্যারিস্টার এ কে এম এহসানুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, ওই আসনে ১০৬টি কেন্দ্রের মধ্যে ৫৩টি কেন্দ্রে পোলিং এজেন্টদের কেন্দ্রে যেতে দেয়া হয়নি। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী নির্বাচনের ভোটগ্রহণ থেকে শুরু করে ফল গণনা পর্যন্ত পোলিং এজেন্টদের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক। পোলিং এজেন্টদের উপস্থিতি নিশ্চিত করার দায়িত্ব প্রিজাইডং কর্মকর্তার। মেহেরপুর-১ আসনের প্রিজাইডিং কর্মকর্তা তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন। তার ব্যর্থতায় ৫৩টি কেন্দ্রে ধানের শীষের প্রার্থীর কোনো পোলিং এজেন্ট যেতে পারেননি। অথচ এসব কেন্দ্রে এজেন্ট দিয়েছিলেন প্রার্থী। এতে নির্বাচনের ফল প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
গত ১লা জানুয়ারি একাদশ জাতীয় সংসদের প্রজ্ঞাপন প্রকাশের পর প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন হাইকোর্টের ৬টি একক বেঞ্চকে নির্বাচনী আবেদন নিষ্পত্তির এখতিয়ার দেন। নির্বাচনী আবেদন নিষ্পত্তির জন্য বিচারপতি সৌমেন্দ্র সরকার, বিচারপতি মো. রেজাউল হাসান, বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হক, বিচারপতি মো. খসরুজ্জামান, বিচারপতি মাহমুদুল হক ও বিচারপতি কাশেফা হোসেনের একক বেঞ্চকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। একক বেঞ্চের এখতিয়ার সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট একক বেঞ্চের কার্য-তালিকায় এখতিয়ার বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে ‘২০০১ ইং সনের গণপ্রতিনিধিত্ব (সংশোধন) অধ্যাদেশ দ্বারা সংশোধিত ১৯৭২ইং সনের গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ মোতাবেক “নির্বাচনী” আবেদনপত্র; যেসব বিষয় এই বেঞ্চে স্থানান্তরিত হইবে তার আবেদনপত্র গ্রহন করিবেন।’