ক্রাইমবার্তা রিপোর্টঃ আবারো আলোচনায় জামায়াতে ইসলামী। সম্প্রতি একজন শীর্ষ নেতার পদত্যাগের পর সর্বত্র তুমুল আলোচনা চলছে দলটিকে নিয়ে। আলোচনা হচ্ছে বিএনপির সাথে জামায়াতে ইসলামীর জোট, ’৭১ সালের ভূমিকা ও নতুন একটি উদারপন্থী দল গঠন নিয়েও। জামায়াত নির্বাচন কেন্দ্রিক অবস্থান থেকে সরে গিয়ে সামাজিক ও ধর্মীয় কাজে মনোনিবেশ করতে যাচ্ছে বলেও আলোচনায় উঠে এসেছে। তবে বর্তমান সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তের কথা প্রকাশ্যে জানালেও অন্যান্য বিষয় নিয়ে এখনো পুরোপুরি অবস্থান পরিষ্কার করেনি জামায়াত।
গত ১২ ফেব্রুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ বৈঠক থেকে বর্তমান সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নেয় দলটি। গত ১০ বছরে বিভিন্ন নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ তুলে এ সিদ্ধান্তের কথা জানায় তারা। জানা গেছে, ওই বৈঠকে জামায়াত পুরোপুরি রাজনীতি থেকে সরে গিয়ে সামাজিক ও ধর্মীয় কাজে মনোনিবেশ করবে নাকি শুধুমাত্র বর্তমান সরকারের আমলে আর কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়। তবে আপাতত বর্তমান সরকারের আমলে আর কোনো নির্বাচনে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানা গেছে।
জানা যায়, জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্রের ৬ ধারার স্থায়ী কর্মসূচি অংশের ৪ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে-‘গণতান্ত্রিক পন্থায় সরকার পরিবর্তন এবং সমাজের সর্বস্তরে-সৎ ও চরিত্রবান লোকের নেতৃত্ব কায়েমের চেষ্টা করবে জামায়াত’। এ অনুচ্ছেদ অনুসারে রাজনৈতিক কাজে অংশ নিয়ে থাকে জামায়াত। দলটির স্থায়ী কর্মসূচি রয়েছে মোট চারটি। এর প্রথম তিনটিতে দাওয়াত, প্রশিক্ষণ, সামাজিক সংশোধন, নৈতিক পুনর্গঠন, সাংস্কৃতিক পরিবর্তন সাধন এবং দুঃস্থ মানবতার সেবা করার বিষয়গুলো রয়েছে।
এদিকে জামায়াতে ইসলামী বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ছেড়ে দিচ্ছে বলে সরকার ও বিভিন্ন মাধ্যমে আলোচনা হলেও এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কোনো ঘোষণা দেয়নি জামায়াত। জানা গেছে, বর্তমান সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ায় নির্বাচনকেন্দ্রিক এ জোটের কার্যক্রম এখন অনেকটা শিথিল হয়ে পড়েছে। সেজন্য এ কেন্দ্রিক কোনো কার্যক্রমে আপাতত অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। তবে তারা বিএনপি জোট থেকে বের হয়ে যাওয়ার কোনো ঘোষণা দেবে না বলে জানা গেছে।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি হঠাৎ করেই জামায়াত ছাড়ার ঘোষণা দেন দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। জামায়াতে ইসলামীর আমিরের কাছে দেয়া লিখিত এক পদত্যাগপত্রে তিনি জামায়াতের ’৭১ সালের ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাওয়ার পরামর্শ দেন। এ ছাড়া দলে সংস্কার আনার কথাও জানান তিনি। জামায়াত তার আকস্মিক পদত্যাগে ব্যথিত হলেও ’৭১ সালের ভূমিকার বিষয়ে ক্ষমা চাওয়ার এখনো কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি। তবে এ বিষয়টি নিয়ে দলের নবীন-প্রবীণদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা চলছে বলে জানা যায়। ক্ষমা চাওয়ায় লাভ-ক্ষতির বিষয়টি নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণও চলছে। দলের তরুণ নেতাদের অনেকে মনে করেন ’৭১ সালে জামায়াতের ভূমিকা নিয়ে দীর্ঘ দিন থেকে নেগেটিভ আলোচনা চলছে। বিশেষ করে সরকার এ বিষয়টি নিয়ে একশ্রেণীর ব্যক্তিদের মনে এক ধরনের ক্ষোভ ও বিতৃষ্ণা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। এ কারণে দলটির নেতাকর্মী থেকে শুরু করে দেশের অনেক জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি ইসলামী দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক হলেও তারা প্রকাশ্যে কোনো অবস্থান নিতে পারেন না। এমনকি সক্রিয়ভাবে কোনো ভূমিকাও রাখতে পারেন না। যা দলটির অগ্রগতিতে বাধা সৃষ্টি করছে।
এ বিষয়ে দলটির একজন শীর্ষ নেতা জানিয়েছেন, ’৭১ সালের জামায়াত আর বর্তমান জামায়াত এক নয়। বর্তমান জামায়াতের বেশির ভাগ সদস্যই নতুন। এ দল এখন অনেক বেশি উদারপন্থী ও আধুনিক ইসলামী দল। জামায়াত ভেতরে ভেতরে অনেক বদলে গেছে। এ জন্য জামায়াতের গঠনতন্ত্রে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি স্থান পেয়েছে। গঠনতন্ত্রের ভূমিকায় বলা হয়েছে- ‘বাংলাদেশের জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম জাতি রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ করেছে’। এ ছাড়া গঠনতন্ত্রে একজন সদস্যের (রুকন) দায়িত্ব ও কর্তব্য অধ্যয়ের ৯ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- ‘দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকবেন’।
এদিকে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের পর দলটির মহানগরী নেতা ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি মজিবুর রহমান মঞ্জুকে দলের সদস্য পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। জামায়াত বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে না জানালেও মজিবুর রহমান মঞ্জু তার ফেসবুক পেজে বিষয়টি তুলে ধরেছেন। এর আগে মজিবুর রহমান মঞ্জু তার ফেসবুক পেজে জামায়াতের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দীর্ঘ একটি পোস্ট দেন। এতে তিনি বিভিন্ন সময় দলকে সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছেন বলেও জানিয়েছেন।
মূলত দুইজন শীর্ষস্থানীয় নেতার এ ধরনের সংস্কারের দাবির কারণে রাজনৈতিক মহলে জামায়াত বিলুপ্ত করে আরেকটি নতুন দল গঠনের বিষয়ে আলোচনা চলছে। দলটির কিছু নেতা তুরস্ক, মিসরের ইসলামিক দলগুলোর আদলে নাম পরিবর্তন করে আধুনিক উদারপন্থী দল গঠনের দাবি করলেও আপাতত এ ধরনের কোনো দল গঠন হচ্ছে না বলে জানা গেছে। কেউ এ ধরনের তৎপরতা চালালে তার ডাকে সাড়া না দিতেও দলটির পক্ষ থেকে তৃণমূল নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান হয়েছে। এ ছাড়া জামায়াতের আমির মকবুল আহমাদ পদত্যাগ করতে যাচ্ছেন বলে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচারণা চললেও তা ভিত্তিহীন বলে জানিয়েছে দলটি।