অাবু সাইদ বিশ্বাসঃ ভারত ফিরেঃ
পুরনো একটি তত্ত্ব আছে যে, যখন একটি জীবের বিকাশ ঘটে, তখন তা তার পূর্বসূরীরা যেসব ধাপের মধ্য দিয়ে বিবর্তিত হয়েছে তাই অনুসরণ করে। ঐতিহ্যগতভাবে, অর্থনৈতিকভাবে উন্নয়নমূলক কাজও হয়েছে একই ভাবে। যখন একটি দেশ প্রথমে কৃষিভিত্তিক দারিদ্র্য থেকে শিল্পায়নের দিকে ধাবিত হয়, তখন তারা শুরুতে হালকা জিনিস কারখানায় তৈরির মধ্য দিয়ে শুরু করে, যেমন বস্ত্রশিল্প। তারপর তারা অধিক জটিল মানের পণ্য উৎপাদনের দিকে ধাবিত হয়। চূড়ান্তভাবে তারা তাদের নিজস্ব ধরণের প্রযুক্তি উদ্ভাবনের চেষ্টা করে। এভাবেই একটি উন্নয়নশীল দেশের উন্নয়ন ধাবিত হয় এমন একটি ধারার দিকে, যার মধ্য দিয়ে উন্নয়ন প্রক্রিয়া অগ্রসর হয়েছে।
দৃশ্যত সুনির্দিষ্টভাবে এমনটাই বর্ণনা করা হয় দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ানের অভিজ্ঞতার আলোকে, যারা তুলনামূলকভাবে সম্প্রতি উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় পৌঁছেছে। এই পথটিই অনুসরণ করেছে চীনও।
এসব দেশ যখন ধনী হয়েছে এবং তাদের বেতন বৃদ্ধি পেয়েছে, তখন নিম্ন বেতনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নিম্ন প্রযুক্তির শিল্প কারখানা স্থানান্তর হয়েছে এমন দেশে, যেখানে শ্রমিকের মজুরি সস্তা।
সম্প্রতি এমন অবস্থার সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগীদের একটি হলো বাংলাদেশ। দক্ষিণ এশিয়ার এ দেশটির রপ্তানি বিষয়ক রাজস্বের শতকরা ৮০ ভাগের বেশি আসে গার্মেন্ট শিল্প থেকে, যা জাতীয় প্রবৃদ্ধির প্রায় এক পঞ্চমাংশ। ২০১৭ সালে চীনের পরই বিশ্বে সবচেয়ে বেশি তৈরি পোশাকের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সরবরাহকারী ছিল বাংলাদেশ। যা, মোট বাজারের শতকরা ৬.৫ ভাগ। ব্যাপক বড় অর্থনীতির দেশ হওয়া সত্ত্বেও এক্ষেত্রে প্রতিবেশী ভারতকে পিছনে ফেলেছে বাংলাদেশ।
এই অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথ তৈরি হয়েছে বাস্তবেই মানবিক ও সামাজিক মূল্যের বিনিময়ে এতে কোনো সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের শ্রমিকরা নির্মম কর্মপরিবেশে দুর্ভোগ পোহান এবং এখানে বহু শিল্প দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২০১৩ সালের একটি ভয়াবহ কারখানা ধস উল্লেখযোগ্য, সেখানে কমপক্ষে এক হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। কিন্তু সর্বোপরি, প্রমাণিত শিল্পায়ন কৌশল দৃশ্যত কাজ করবে বলেই মনে হচ্ছে। মাথাপিছু প্রকৃত জাতীয় প্রবৃদ্ধি দ্বিগুন হয়েছে এই নতুন শতাব্দীতে এসে। বাংলাদেশ মনে হচ্ছে প্রতিবেশী ভারতের মতো একই রকম বহুগুন প্রবৃদ্ধির পথে রয়েছে।
অন্যদিকে ভারত কারখানা উৎপাদনের দিক দিয়ে সাধারণত কম পারফরম করেছে। দেশটির খুব কমই উল্লেখ করার মতো বিষয় আছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তাদের এখন রয়েছে বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহৎ অটো কারখানা। এর বেশির ভাগ কারখানা গুজরাটে। তারা তাদের স্মার্টফোন উৎপাদন বৃদ্ধি করেছে। কিন্তু সার্বিকভাবে অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বে এর উৎপাদন কমে গেছে।
এটা বলা যায় না যে, ভারতের নেতারা এমন সব কারখানায় উৎপাদনকে অবজ্ঞা করছেন। বাস্তবে তারা শিল্পায়নে বড় ধরনের প্রচেষ্টার আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিদেশী উৎপাদনকারীদের দিকে নজর দিয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার কার্যকারিতা সীমিত। বেশির ভাগ পর্যবেক্ষক একমত যে, অবকাঠামোর অভাব এবং নিয়মকানুনের লালফিতার মাত্রারিক্ততায় ভারতে এমন সব উৎপাদনে জটিলতার কারণ।
কারখানায় উৎপাদন নিয়ে লড়াই করা সত্ত্বেও ভারতে দ্রুত অগ্রগতি হচ্ছে। এমন কি সাম্প্রতিক সময়ে তা বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি দ্রুত গতিতে হচ্ছে। এর কারণ হলো, সার্ভিস বিষয়ক শিল্পে অগ্রগতি। ভারতের বিখ্যাত আউটসোর্সিং কোম্পানিগুলো হলো একটি আইসবার্গের মাত্র একটি কোণাÑ সেই আইসবার্গ হলো সফওয়্যার, ফাইন্যান্স, অনলাইন সার্ভিস, পর্যটন, লজিস্টিক, মিডিয়া, স্বাস্থ্যসেবা ও অন্যানা সেবা। এসব মিলে ভারতের চিত্তাকর্ষক প্রবৃদ্ধিতে সবচেয়ে বড় চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করছে। কেউ কেউ বলেন যে, ভারত একটি উন্নয়নের মডেল আবিষ্কার করেছে, যা পুরো কারখানার উৎপাদনকে লাফিয়ে বাড়তে সাহায্য করতে পারে। এর মধ্য দিয়ে তারা সরাসরি কৃষিভিত্তিক দারিদ্র্য থেকে শিল্প-পরবর্তী অর্থনীতির দিকে সরাসরি ধাবিত হয়েছে।
এটা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কারণ, একটি বিষয় সবাই জানেন যে, প্রযুক্তির অগ্রগতি হলে দারিদ্র্যের প্রথাগত পথ দূরে সরে যায়। অটোমেশন বস্ত্র শিল্পকে কম শ্রমনিবিড় করছে। একটি বিষয় হলো, এর অর্থ হচ্ছে, গরিব দেশগুলো গার্মেন্ট শিল্পে গণহারে শহরমুখী কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে আর সক্ষম হবে না। কিন্তু অধিক পরিমাণে বিরক্তিকর হলেও, এর ফলে এই শিল্প ফিরে যেতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের মতো ধনী দেশে, যেখানে শ্রম খরচ বেশি। কিন্তু সেখানে পুজি বা মূলধন তুলনামূলকভাবে সস্তা বা সহজে প্রাপ্য। এমন বিপরীতমুখি প্রবণতা এরই মধ্যে ঘটে থাকতে পারে।
অন্য কথায়, অকালে শিল্পায়নবিরোধীতার ঝুঁকিতে রয়েছে উন্নয়নশীল বিশ্ব। যদি ধনী বিশ্বের রোবটের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ হেরে যায়, তাহলে তাতে অভুল লক্ষণ হবে। ইথিওপিয়ার মতো দেশগুলোর জন্য অশুভ লক্ষণের প্রকাশ হবে ঘটাবে তা। এসব দেশ দ্রুত সমৃদ্ধি অর্জনের আশা করছে। এমন হলে তাতে ভারতের সার্ভিসকেন্দ্রীক উন্নয়ন মডেল হয়ে উঠবে একমাত্র উপযুক্ত পথ।
কিছু অর্থনীতিবিদ যুক্তি দেখান যে, ঐতিহ্যগত যে পথ রয়েছে তাকে বন্ধ করেনি অটোমেশন। তারা আরো বলেন, এখনও দরিদ্র দেশগুলোতে প্রচুর কাজ রয়েছে কর্মঠ মানুষের জন্য। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে অধিক মূল্যবান শিল্পকারখানা, যেমন অটো ও ইলেক্ট্রনিকস-এর দিকে বেশি নজর দিয়েছে।
তাই বাংলাদেশ ও ভারতের নেতাদের যদিও অভিন্ন লক্ষ্য আছে, তবু দেশ দুটির উন্নয়নের মডেলের ভিন্নতা একটি আগ্রহদ্দীপক বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ার এই দুটি দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির গতিপথ অনুসরণ করছে আফ্রিকার দেশগুলো। তাদের এ বিষয়ে নিবিড় নজর রাখা উচিত। যদি বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি দ্রুততর হয়, তাহলে এটা বলে দেবে যে, টেক্সটাইল দিয়ে শুরু হওয়া ম্যানুফ্যাকচারিং এখনও শিল্পায়নের টিকেট হয়ে আছে। কিন্তু যদি বাংলাদেশ পশ্চাৎমুখী হয় এবং ভারতের প্রবৃদ্ধি বা অগ্রগতি টেকসই হয় তাহলে এতে বুঝে নিতে হবে দরিদ্র দেশগুলোকে প্রথমে নজর দেয়া উচিত সার্ভিস সেক্টরে।
(অনলাইন বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডে প্রকাশিত লেখার অনুবাদ)