মিশরে ফাঁসি কার্যকরের আগে ৯ তরুণের হৃদয়বিদারক চিঠি

ক্রাইমবার্তা  রিপোটঃ    মিশরে এক আইনজীবী হত্যার দায় চাপিয়ে মুসলিম ব্রাদারহুডের ৯ তরুণের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে।
গত ২০ ফেব্রুয়ারি এই ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এরপর থেকেই অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তিরা এই দণ্ড কার্যকরে তীব্র নিন্দা জানিয়ে আসছে।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়ব এরদোয়ান এই ইস্যুতে মিশরের স্বৈরশাসক প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল সিসিকে রীতিমতো একহাত নিয়েছেন।
অ্যামনেস্টি বলেছে, ফাঁসি কার্যকরের আগে ওই তরুণদের কারাগারে দীর্ঘ তিন বছরের বেশি সময় ধরে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়।
কোমল শরীরে লাগাতার শাস্তি প্রয়োগের পর ওইদিন ভোরের প্রথম তিন ঘণ্টার মধ্যেই তাদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এর মধ্যদিয়েই শেষ হয়ে যায় ৯ তরুণের জীবন-সফর।

আর তারা একত্রে আরোহন করে বেদনার কফিনে, রেখে যায় কেনানার ভূমিতে মৃত্যুদণ্ডের জন্য প্রত্যয়িত ফতোয়া কর্তৃপক্ষ, রাজনীতি ও বিচার বিভাগের মুখে একটি বিশাল প্রশ্ন।
নিহত যুবকদের বসবাস ছিল মিশরের বিভিন্ন অঞ্চলে। এমনকি তাদের শিক্ষা অর্জনের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনও ছিল আলাদা। কিন্তু, শেষযাত্রা হলো একসঙ্গে, মিশরের গোরস্থানে।
দেশটির সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল হিশাম বারাকাতকে হত্যার অভিযোগ আনা হয় এই ৯ তরুণের বিরুদ্ধে। সিসি সরকারের আজ্ঞাবহ এই অ্যাটর্নি জেনারেল ২০১৫ সালে কর্মস্থলে যাওয়ার সময় এক গাড়িবহরে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় প্রাণ হারান।
সিসির হীন আক্রোশের নির্মম শিকার নয় তরুণ হলেন— আহমাদ ত্বহা ওয়াহদান, আবুল কাসিম আহমাদ, আহমাদ জামাল হিজাযী, মাহমুদ আল-আহমাদী, আবু বকর আস-সাইয়্যেদ, আব্দুর রহমান সুলাইমান, আহমাদ মুহাম্মাদ আহমাদ মাহরুস সাইয়্যেদ ও ইসলাম মুহাম্মাদ।
এই নয়জন আরও সে সকল দশক সংখ্যার মধ্যে যুক্ত হলেন, সিসির পাঁচ বছরে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া ১ হাজার ৫৬ জনের মধ্যে যাদের রায় কার্যকর করা হয়েছে। তারা রাবেয়া ও তাহরির স্কয়ারে নৃশংস গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া শতশত অভিযুক্ত নিরীহ মিশরীর পক্ষে তাদের জীবনের যাত্রা বন্ধ করার চূড়ান্ত বিচারে ১৯ জন বিচারপতির প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবার আগে তারা প্রত্যেকেই নিজের পরিবারের কাছে লিখেছেন নিজেদের অন্তিম অনুভূতির কথা। আল-জাজিরা সে চিঠিগুলো প্রকাশ করে, যা পড়ে হৃদয় ভিজে যেতে বাধ্য এবং প্রাণোদ্দীপক এসব চিঠি পড়ে কেঁদেছেন অসংখ্য মানুষ।
৯ তরুণের একজন আহমদ ত্বহা ওয়াহদান। তিনি মুসলিম ব্রাদারহুডের গাইডেন্স ব্যুরোর সদস্য মোহাম্মদ ত্বহা ওয়াহদানের ছেলে। তিনি মৃত্যুদণ্ডের আগ মুহূর্তে চিঠি লিখেছেন তার মেয়েকে উদ্দেশ্য করে।
নিচের ডানপাশে ৯ তরুণের একজন আহমদ ত্বহা, উপরে তার স্ত্রী এবং মাঝখানে ও বামে তাদের মেয়ে লায়লা।
তিনি লিখেছেন, ‘আম্মুজান, তুমি আমার ভালোবাসা, আমার কলিজার টুকরো। কখনো ভেব না যে, তোমার বাবা অপরাধ করেছেন। তোমার বাবা তোমার নিরাপত্তা চেয়েছেন। কেয়ার করে এমন রাষ্ট্র তৈরি করতে চেয়েছেন। বড় কারাগারে থাকেন, এটা চাননি। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও মা। পৃথিবী থেকে বিদায়ের আগে একবারের জন্যও তোমাকে বুকের মাঝখানটায় চেপে ধরতে পারলাম না। তোমার কোমল পবিত্র কপালে চুমু খেতে পারলাম না। তবে, জান্নাতের দরজায় সাক্ষাতের অপেক্ষায় থাকব, মামণি। সেখানে কোনো বিদায় ও বিচ্ছিন্নতা নেই। আম্মুজান, আমার ভালোবাসা সব সময় তোমার সঙ্গে থাকবে।’
অ্যাটর্নি জেনারেল হিশাম বারাকাত নিহত হওয়ার পর যখন ত্বহা বন্দি হন, তার স্ত্রী ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা। তিনি কারান্তরীণ হবার এক মাস পর স্ত্রী একটি ফুটফুটে কন্যাসন্তানের জন্ম দেন। কন্যার সঙ্গে এই ক’বছরে তার দেখা হয়েছে সাকুল্যে দু’বার। একবার কোর্টে বিচার চলাকালীন কন্যার মা কন্যাকে উঁচু করে দেখান। তিনি তখন কাঠগড়ায়।
আরেকবার কোর্টেই, মেয়ের যখন দাঁত গজাচ্ছে, স্ত্রী মেয়েকে দেখিয়ে ইশারায় বোঝান, মেয়ের দাঁত গজাচ্ছে।
আহমদ ত্বহা আনন্দিত হয়ে জেলের শিকের ভেতর থেকে হাত দিয়ে লাভ বানিয়ে দেখান। বন্দি থেকেও কী নিদারুণ আনন্দ তখন ঝরে পড়ছিল তার চেহারা থেকে, সাংবাদিকদের তোলা সেই ছবি দেখলেই বোঝা যায়।

৯ তরুণের প্রতিটা চিঠিই এমন হৃদয়বিদারক। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়ব এরদোগান সিসিকে অমানুষ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
শনিবার সিএনএনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘সিসির মতো অমানুষের সঙ্গে তিনি কখনোই আলোচনায় বসবেন না।’
ব্রাদারহুডের এই তরুণদের হত্যার তীব্র নিন্দা জানিয়ে এরদোগান আরও বলেন, ‘মিশর সরকার-প্রধান হয়তো বলতে চাইবে আদালত তাদের (৯ তরুণ) সাজা দিয়েছে। কিন্তু, দেশটিতে আদালত, বিচারবিভাগ ও নির্বাচন সব অর্থহীন। একজনের হুকুমে চলে। দেশটিতে একনায়কতন্ত্র ও সর্বাত্মকবাদ চলছে। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই। সেই সঙ্গে মুসলিম ব্রাদারহুডের সব রাজবন্দির মুক্তির দাবি জানাই।’

Check Also

সাতক্ষীরায় পুত্রবধূর হাতে নির্যাতিত সেই স্কুলশিক্ষক মারা গেছেন

ক্রাইমবাতা রিপোট, সাতক্ষীরা:   ছেলে ও পুত্রবধূর হাতে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতনের শিকার সাতক্ষীরা সদর উপজেলার বাঁশতলা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।