ক্রাইমবার্তা রিপোটঃ রোহিঙ্গা সংকটে জর্জরিত বাংলাদেশ জাতিসংঘকে সাফ জানিয়ে দিয়েছে আর একজন মিয়ানমার নাগরিককেও আশ্রয় দেয়া সম্ভব নয়। বন্ধ সীমান্ত আর খোলা হবে না। ঢাকার তরফে গত বৃহস্পতিবার নিউ ইয়র্কে এমন ‘কঠিন অবস্থান’ ব্যক্ত করার সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নড়েচড়ে বসেছে। পরদিন জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিকের নিয়মিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। প্রশ্নকর্তার বক্তব্যটি ছিল এরকম “শোনা গেছে নিরাপত্তা পরিষদে গতকাল বাংলাদেশ বলেছে তাদের পক্ষে আর একজন মিয়ানমার শরণার্থীকেও আশ্রয় দেয়া সম্ভব নয়।
এ বিষয়ে আপনি কি অবহিত? এর সত্যিকারের প্রভাব বা প্রতিক্রিয়াই কী হবে? এ সিদ্ধান্তের বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়েছে কি?” জবাবে মুখপাত্র বলেন, “এ নিয়ে বাংলাদেশ জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরকে কিছু বলেছে কি-না সে বিষয়ে আমি খোঁজ নেবো। আপনারা যেমনটি জানেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি বাংলাদেশ অভাবনীয় সমর্থন এবং উদারতা দেখিয়েছে। আমি যেটা বলতে চাই তা হলো- আপনারা দেখে থাকবেন এক বছরে একটি দেশে প্রায় ৭ লাখ লোক আশ্রয় নিয়েছে।
বাংলাদেশের মহানুভবতার প্রশংসার পরপরই জাতিসংঘ মুখপাত্র কোনো দেশের নাম উচ্চারণ না করে বলেন, এখনো যারা সেখানে সংঘাতের মুখে রয়েছে তাদের একটি নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পাওয়া গুরুত্বপূর্ণ, তারা যেখানেই যাক না কেন।” এদিকে রোহিঙ্গা নির্যাতনের ঘটনায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে জাতিসংঘ।
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন বন্ধে বার বার হুঁশিয়ারি দেয়ার পরও তা আমলে না নেয়ায় জাতিসংঘ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানিয়েছে প্রভাবশালী বৃটিশ দৈনিক দি গার্ডিয়ান। জাতিসংঘ সূত্রের বরাতে প্রচারিত ওই খবরে বলা হয়েছে, অভ্যন্তরীণ চাপ বিশেষত পশ্চিমা দুনিয়ার চাওয়ার প্রেক্ষিতে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস তদন্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে, নির্দিষ্ট কোনো দল বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জাতিসংঘ তদন্ত করবে না জানিয়ে বলা হয়- গুয়েতেমালার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও জাতিসংঘে দেশটির স্থায়ী প্রতিনিধি গার্ট রোজেনথাল এই তদন্ত দলের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। তবে তার মিয়ানমারে আসার কোনো পরিকল্পনা নেই।
বিশ্ব সমপ্রদায়ের সক্রিয় ভূমিকা চায় বাংলাদেশ: এদিকে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়কে সক্রিয় ও সহায়ক ভূমিকা রাখার আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মো. শহিদুল হক। রোহিঙ্গা সংকটের ফলে বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব সম্পর্কে সচিব বলেন, ‘বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই আশ্রয় শিবির বাংলাদেশের সংরক্ষিত বন ও বণ্যপ্রাণী ধ্বংস করছে, এর ফলে পরিবেশের বিপর্যয় হচ্ছে। আমাদের একমাত্র সমুদ্র সৈকত সৌন্দর্য্য ও পর্যটক হারাচ্ছে। আর সবচেয়ে বড় কথা আমাদের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলছে এবং ওই অঞ্চলের সামাজিক বিন্যাস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’ স্থানীয় সময় শুক্রবার জাতিসংঘে চলমান অভিবাসন সপ্তাহে যোগদান উপলক্ষে নিউ ইয়র্ক সফররত বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মো. শহিদুল হক রোহিঙ্গা সংকটের বর্তমান পরিস্থিতি এবং সর্বশেষ অগ্রগতি বিষয়ে ওআইসি’র রাষ্ট্রদূত পর্যায়ের সভায় ব্রিফিং করেন এবং ইন্টারন্যাশনাল পিস ইনস্টিটিউট-এ একটি সংলাপে অংশ নেন। উভয় অনুষ্ঠানেই এ বিষয়ক বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন তিনি।
অনুষ্ঠান দুটিতে পররাষ্ট্র সচিব রোহিঙ্গা সংকটের অতীত ও বর্তমান অবস্থা বিস্তারিত তুলে ধরেন। পররাষ্ট্র সচিবের ব্রিফিং-এ উঠে আসে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সৃষ্ট সামপ্রতিক সংঘাত এবং নতুন করে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি, এই সংকটের অন্তর্নিহিত কারণ, সহিংসতার দায়বদ্ধতা নিরূপণ, অপরাধ করে পার না পাওয়ার সংস্কৃতি বন্ধ, এ জাতীয় গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রস্তাবিত অসামরিক সেইফ জোন সৃষ্টি, এ সংকটের ফলে আন্তর্জাতিক মানবিক ও মানবাধিকার আইন এবং বিশ্ব সমপ্রদায়ের উপর সৃষ্ট চ্যালেঞ্জসহ আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের কাছ থেকে প্রত্যাশার বিষয়গুলো। ওআইসি’র সভায় প্রদত্ত ব্রিফিং-এ পররাষ্ট্র সচিব ঢাকায় অনুষ্ঠিত ওআইসি’র ৪৫তম ‘কাউন্সিল অব ফরেন মিনিস্টার’-এর সভায় মিয়ানমারে সৃষ্ট গণহত্যা ও সহিংসতাকে ১৯৪৮ সালের জেনোসাইড কনভেনশনের আওতায় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচার করার ব্যবস্থা গ্রহণে গাম্বিয়ার নেতৃত্বে গঠিত কমিটির কথা উল্লেখ করেন। রোহিঙ্গা সংকটের করণীয় বিষয়ক এক প্রশ্নের জবাবে শহিদুল হক বলেন, ‘আমরা দ্বিপক্ষীয় প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখছি।
আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা আসিয়ানের সহায়তা চাচ্ছি। ওআইসি এ বিষয়ে কাজ করছে। আর জাতিসংঘ ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ বিষয়টির সমাধানের উপায় খুঁজে বের করা ও আলোচনা অব্যাহত রাখার সকল প্রচেষ্টা চলমান রয়েছে।’ এসময় রোহিঙ্গা সংকট ও এর সমাধান এবং ভবিষ্যতে এর পুনরাবৃত্তি রোধে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়কে সক্রিয় ও সহায়ক ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মো. শহিদুল হক। ওআইসি’র রাষ্ট্রদূত পর্যায়ের সভাটি সঞ্চালন করেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন এবং ইন্টারন্যাশনাল পিস ইনস্টিটিউট-এর অংশগ্রহণমূলক সংলাপ অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির সহ-সভাপতি ড. অ্যাডাম লুপেল।