ক্রাইমবার্তা রিপোটঃ হৃদরোগে আক্রান্ত আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের শারীরিক অবস্থা সংকটাপন্ন। দিনভর চেষ্টায় অবস্থার সামান্য উন্নতি হলেও তিনি ঝুঁকিমুক্ত নন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। গতকাল সকাল থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল
বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের চিকিৎসকরা তাকে সুস্থ করে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা চালান। সন্ধ্যায় তাদের সঙ্গে যুক্ত হন সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চার চিকিৎসক। তাকে সিঙ্গাপুরে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা দিতে প্রস্তুতির অংশ হিসেবে এয়ার এম্বুলেন্সে করে এ চার চিকিৎসক ঢাকা আসেন।
সন্ধ্যায় বিএসএমএমইউতে চিকিৎসকদের সঙ্গে বৈঠক করেন তারা। ওই বৈঠকের পর আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম সাংবাদিকদের বলেন, ওবায়দুল কাদেরের অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে এই মুহূর্তে তাকে এখানেই চিকিৎসা দেয়া হবে। তাকে এয়ার এম্বুলেন্সে করে সিঙ্গাপুরে নেয়ার অবস্থা নেই বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।
অবস্থার আরো উন্নতি হলে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। এজন্য সোমবার সকাল ১০টা পর্যন্ত এয়ার এম্বুলেন্স অপেক্ষায় থাকবে। গতকাল ভোররাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হলে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে সকালে বিএসএমএমইউতে ভর্তি করা হয়।
সেখানে প্রাথমিক পরীক্ষার পর তার হার্টে তিনটি ব্লক ধরা পড়ার তথ্য জানান চিকিৎসকরা। পরে একটি ব্লকে তাৎক্ষণিকভাবে রিং পরানো হয়। দিনভর হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে তাকে পর্যবেক্ষণ করেন চিকিৎসকরা। এদিকে ওবায়দুল কাদেরের অসুস্থতার খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে যান প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদলসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ। হাসপাতালে ভিড় করেন দলীয় নেতাকর্মী ও শুভানুধ্যায়ীরা। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সুস্থতা কামনায় দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছে আওয়ামী লীগ।
ওবায়দুল কাদেরের শারীরিক অবস্থা নিয়ে গতকাল সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলনে বিএসএমএমইউ’র কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান ডা. সৈয়দ আলী আহসান বলেন, আমরা ওনার অবস্থা নিয়ে আশাবাদী। হয়তো তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। আবার নাও হতে পারেন। ২৪ থেকে ৭২ ঘণ্টা না পেরোলে অবস্থা সঠিকভাবে বলা সম্ভবই না। সকালে যখন তিনি হাসপাতালে আসেন তখন তার হার্টবিট বা হৃদস্পন্দন বন্ধ ছিল। সে সময় থেকে এখন পরিস্থিতি ভালো হয়েছে। তাই আমরা আশাবাদী। বিএসএমএমইউ’র ডা. মিল্টন হলে ওবায়দুল কাদেরের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে ভিসি ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া বলেন, শারীরিক অবস্থা এখনো আশঙ্কাজনক অবস্থায় থাকার কারণে সিঙ্গাপুরে উন্নত চিকিৎসার জন্য এয়ার এম্বুলেন্সে নেয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু সেটা সম্পূণরূপে নির্ভর করছে সিঙ্গাপুর থেকে আসা এয়ার এম্বুলেন্সের রোগী বহনের সুযোগ-সুবিধার উপর। কীভাবে ওবায়দুল কাদেরের চিকিৎসা প্রক্রিয়া চলছে সে বর্ণনা দিতে গিয়ে অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আলী আহসান বলেন, সকাল সাড়ে ৭টার দিকে তাকে যখন হাসপাতালে আনা হয় তখন তার হৃদস্পন্দন বন্ধ ছিল।
আমাদের একজন চিকিৎসক ফোন পেয়ে তার বাসায়ও গিয়েছিলেন। ৮টার সময় তার হার্টবিট আসলে শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা শুরু হয়। তখন ভেন্টিলেশন ও ওষুধ দেয়া হয়। এরপর ক্যাথল্যাবে নিয়ে দেখা যায়, তিনটি রক্তনালী একেবারে ব্লক। এরমধ্যে একটি শতভাগ ও অন্য দু’টি ৮০ শতাংশ ও ৯৯ শতাংশ। তখন সবচেয়ে ক্রিটিক্যাল ব্লক নালীটা খোলার ব্যবস্থা করি। প্রাইমারি পিসিআই (রিং পরানো) করার পর তিনি প্রায় দু’ঘণ্টা ভালো অবস্থায় ছিলেন। এরপর দুপুর ১২টার দিকে আবার অবস্থা খারাপ হয়। হার্টবিট প্রতি মিনিটে ৩৫ আরপিএম-এ নেমে যায়। আবারো ১০ থেকে ১৫ মিনিটের জন্য হার্টবিট শূন্য ছিল। তখন প্রেসার ঠিক করার জন্য আইইডিপি (প্রেসার স্বাভাবিক করার ব্যবস্থা) দেই। এখন হার্টবিট ৯০ থেকে ১১০ আরপিএম-এ আছে।
প্রধানমন্ত্রী আসার পর চোখের পাতা নাড়ানো (ব্লিকিং) এবং প্রেসিডেন্ট আসার পর চোখ মেলে তাকিয়েছেন ওবায়দুল কাদের উল্লেখ করে সাংবাদিকদের আরেক প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া বলেন, প্রধানমন্ত্রী এসে তাকে ডাক দেয়ার পর তার ব্লিকিং হচ্ছিলো। এ ছাড়া প্রেসিডেন্ট এসে তাকে ডাক দিলে তিনি চোখ মেলে তাকিয়েছেন। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিম এসে ডাক দেয়ার পর তার পা নড়ছিল। এ থেকেই রেসপন্সের মাধ্যমে তার শারীরিক অবস্থার উন্নতি বাহ্যিকভাবে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে। ওবায়দুল কাদেরকে দেখতে আসা প্রধানমন্ত্রীর কোনো নির্দেশনা ছিল কিনা- প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক কনক কান্তি বড়ুয়া বলেন, তিনি নির্দেশ দিয়েছেন চিকিৎসকেরা যদি মনে করেন তাকে বিদেশ নেয়া যাবে, তখনই নেয়া হবে। তারা যদি প্রয়োজন মনে না করেন বা পরিস্থিতি যদি এমন হয় যে তাকে পাঠানোর পরিস্থিতি নেই, তবে পাঠানো হবে না। পরবর্তী চিকিৎসা কি হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত চিকিৎসকরা বলেন, চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় তিনি রিপারফিউশন ইনজুরিতে আছেন। এই অবস্থার রোগীদের ক্ষেত্রে নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না।
রিং পরানোর পর ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত রোগীকে একই অবস্থায় রাখতে হয়। ওবায়দুল কাদেরের ক্ষেত্রে এরপর দুটো চিকিৎসা হতে পারে। সেগুলো হলো- করোনারি মেডিকেল থেরাপি ও বাইপাস অপারেশন। প্রফেসর অসিত বরণ জানান, আমরা আশাবাদী তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। তবে এ ধরনের রোগী যেমন সুস্থ হন তেমনই হঠাৎ করে তাদের অবস্থা অবনতিশীলও হয়। তারপরেও আমরা আশাবাদী। এ সময় ওবায়দুল কাদেরের চিকিৎসা নির্বিঘ্ন করতে ও অন্যান্য রোগীর যাতে অসুবিধা না হয় সেজন্য বিএসএমএমইউ’র ভেতর ভিড় না করতে সাংবাদিকসহ সব মহলের সহযোগিতা কামনা করেন বিএসএমএমইউ ভিসি। এদিকে ওবায়দুল কাদেরের চিকিৎসায় বিএসএমএমইউয়ের হৃদরোগ বিভাগের পক্ষ থেকে মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। বিএসএমএমইউ কার্ডিওলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আলী আহসানের নেতৃত্বে মেডিকেল বোর্ডে আরো রয়েছেন অধ্যাপক ডা. চৌধুরী মেশকাত আহমেদ চৌধুরী, অ্যানেসথেসিয়া বিভাগের অধ্যাপক ডা. দেবব্রত ভৌমিক, অধ্যাপক ডা. একেএম আক্তারুজ্জামান, কার্ডিও সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. রেজওয়ানুল হক, অধ্যাপক অসিত বরণ অধিকারী, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান, ডা. তানিয়া সাজ্জাদ, প্রিভেনটিভ অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. হারিসুল হক প্রমুখ।
হাসপাতালে প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে দেখতে যান প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। রাজশাহীতে সেনাবাহিনীর একটি অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার পর ঢাকা ফিরে বিকাল সাড়ে ৩টায় বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালে পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী। বিকাল সোয়া ৪টার দিকে তাকে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যেতে দেখা যায়। তার মিনিট দশেক পর বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে পৌঁছে ডি ব্লকের দোতলায় কার্ডিওলজি বিভাগে যান প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ। তার পরপরই স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী হাসপাতালে পৌঁছান। ওবায়দুল কাদেরকে দেখে বিকাল পৌনে ৫টায় হাসপাতাল থেকে ফিরে যান প্রেসিডেন্ট। স্পিকারও তার পরপরই বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল থেকে বেরিয়ে যান।
ওবায়দুল কাদেরের চিকিৎসার বিষয়ে তাদেরকে বিস্তারিত জানান বিএসএমএমইউ’র ভিসি অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া। তিনি বলেন, প্রথমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আসার পর ওবায়দুল কাদেরকে ডাকেন। এসময় প্রধানমন্ত্রীর ডাকে সাড়া দিয়ে মিটমিট করে তাকানোর চেষ্টা করেন তিনি। তিনি বলেন, এরপর যখন প্রেসিডেন্ট আসেন তখন পুরোপুরি তাকিয়েছেন। এসময় ওবায়দুল কাদেরের শারীরিক অবস্থা এবং চিকিৎসার সার্বিক বিষয়ে প্রেসিডেন্টকে জানানো হয়। এদিকে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে দেখতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতালে যান ঢাকা-১ আসনের সংসদ সদস্য ও প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। দুপুর ১টার দিকে তিনি হাসপাতালে যান। সেখানে তিনি চিকিৎসকদের কাছে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের বর্তমান শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নেন।
৬৭ বছর বয়সী ওবায়দুল কাদের ২০১৬ সালের ২৩শে অক্টোবর অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তার আগে ছয় বছর তিনি প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর আড়াই বছর কারাগারে ছিলেন ওবায়দুল কাদের। সেখান থেকেই তিনি ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। পর পর দুই মেয়াদে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কোম্পানীগঞ্জ থানা মুজিব বাহিনীর (বিএলএফ) অধিনায়ক ছিলেন। ওবায়দুল কাদের প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে। নোয়াখালী-৫ আসন থেকে চার বার সংসদ সদস্য হয়েছেন। ১৯৯৬ সালে যুব, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
২০০২ সালের জাতীয় কাউন্সিলে তিনি দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে জরুরি অবস্থার মধ্যে ওবায়দুল কাদের গ্রেপ্তার হয়ে প্রায় দেড় বছর কারাভোগ করেন। ২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনের দুই মাস আগে তিনি জামিনে মুক্তি পান। নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে প্রথমে তথ্য মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব দেয়া হয়। পরে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পান। এরপর থেকে টানা তৃতীয় মেয়াদে এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করে আসছেন।