- বিবিসি
হোলি-র সময় বাইসাইকেলে চেপে একটি বাচ্চা মেয়ে তাদের মহল্লায় সব বন্ধুবান্ধবকে তার দিকে রং ছুঁড়তে বলে – যাতে একটা সময় তাদের রংয়ের বেলুন সব ফুরিয়ে যায়। আর বাচ্চা মেয়েটি এ কাজ করে একটা ছোট্ট উদ্দেশ্য নিয়ে। যাতে এরপর সে তার আরেক মুসলিম বন্ধুকে সাইকেলের পেছনে বসিয়ে নিরাপদে মসজিদে নামাজের জন্য পৌঁছে দিতে পারে!
বাচ্চাদের দঙ্গলের রংয়ের স্টক ফুরিয়ে যাওয়ায় তারা তখন আর কোনও বেলুন ছুঁড়তে পারে না – আর মুসলিম বাচ্চা ছেলেটিও তার ধবধবে সাদা কুর্তা পাজামায় কোনও রঙের দাগ না-লাগিয়েই পৌঁছে যায় মসজিদের দোরগোড়ায়। তবে না, ভারতে এটা সত্যি সত্যি কোথাও ঘটেনি।
এ দেশে রঙের উৎসব হোলির ঠিক আগে জনপ্রিয় ডিটারজেন্ট ব্র্যান্ড সার্ফ এক্সেল যে ‘রং লায়ে সঙ্গ’ নামে বিজ্ঞাপনী ক্যাম্পেন শুরু করেছে, এটা তারই একটা গল্প। তবে এই আপাত-নিরীহ, সম্প্রীতির সুন্দর বিজ্ঞাপনী গল্প নিয়েও ভারতে ভীষণ তিক্ত প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
দু-চারদিন আগে সার্ফ এক্সেল এই বিজ্ঞাপনের ভিডিওটি প্রকাশ করার পর থেকেই অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়াতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাতে শুরু করেন, এর মাধ্যমে না কি কথিত ‘লাভ জিহাদ’ বা হিন্দু মেয়ের সঙ্গে মুসলিম ছেলের প্রেমে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে।
এই বিজ্ঞাপনে যে গল্প বলা হয়েছে, তার একটি বিকল্প ন্যারেটিভ তুলে ধরতে অনেকে আবার হিন্দু পুরুষদের সঙ্গে হিজাব-পরিহিত মুসলিম মহিলাদের হোলি খেলার ছবি পোস্ট করতে শুরু করে দেন।
এতেই শেষ নয়, সার্ফ এক্সেল-সহ তাদের নির্মাতা সংস্থা হিন্দুস্থান ইউনিলিভারের যাবতীয় প্রোডাক্ট বর্জন করারও ডাক দেওয়া হতে থাকে।
গত শনিবার থেকেই ভারতে দারুণভাবে ট্রেন্ড করতে থাকে (হ্যাশট্যাগ) বয়কটসার্ফএক্সেল। পাশাপাশি আবার অনেকেই অবশ্য ভালবাসা, বন্ধুত্ব ও সম্প্রীতির দারুণ নজির হিসেবে এই বিজ্ঞাপনটির প্রশংসাও করতে থাকেন। তবে সোশ্যাল মিডিয়াতে তাদের সংখ্যা ছিল তুলনায় অনেক কম।
বামপন্থী অ্যাক্টিভিস্ট ও রাজনীতিবিদ কবিতা কৃষ্ণন টুইট করেন, “সঙ্ঘ পরিবারের অনুগামী ঘৃণার কারবারিরাই লাভ জিহাদের চশমা দিয়ে এই বিজ্ঞাপনটিকে দেখছেন।”
“ভালবাসার পাঠ দিয়ে এদেরকে একটা উপযুক্ত শিক্ষা দিন”, দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
ভারতের জনপ্রিয় ইউটিউবার ধ্রুব রাঠী আবার কটাক্ষ করেন হিন্দুত্ববাদীদের একের পর এক পণ্য বর্জন করার ডাক দেওয়াকে। তিনি লেখেন, “এভাবে চললে ভক্তদের তো খাবার জন্য গোবর আর পান করার জন্য গোমূত্র ছাড়া কিছুই আর বাকি থাকবে না!”
সার্ফ এক্সেলের নির্মাতা হিন্দুস্থান ইউনিলিভার (বহুজাতিক সংস্থা ইউনিলিভারের ভারতীয় শাখা) অবশ্য এই প্রথম ভারতে হিন্দুত্ববাদীদের রোষের মুখে পড়ছে না।
দিনকয়েক আগেই তাদের ‘রেড লেবেল’ ব্র্যান্ড চায়ের একটি বিজ্ঞাপনে হিন্দুদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় জমায়েত কুম্ভমেলার একটি গল্প বলা হয়েছিল।
সেই বিজ্ঞাপনে দেখা যায়, কুম্ভে লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড়ে তার বৃদ্ধ বাবাকে ইচ্ছে করে হারিয়ে ফেলার পরিকল্পনা নিয়ে হাজির হয়েছিল এক ছেলে। পরে অবশ্য নিজের ভুল বুঝতে পেরে সেই ছেলে আবার নিজের বাবাকে খুঁজে বের করে, চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আবার মিলন হয় বাবা ও ছেলের।
সেই বিজ্ঞাপনের শেষে একটি বার্তাও ছিল, যাতে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ এই ধর্মীয় জমায়েতে কেউ যেন নিজেদের বয়স্ক পরিজনদের ফেলে না চলে যান। এই বার্তাটিকেও অনেকেই ‘হিন্দু-বিরোধী’ বলে রায় দিয়েছেন, বলছেন এটি কুম্ভমেলার চেতনাকে ভুলভাবে উপস্থাপিত করছে।
ফলে সার্ফ এক্সেলেরই বিজ্ঞাপন হোক বা রেড লেবেল চায়ের, দেখা যাচ্ছে সম্প্রীতি বা ভালবাসার বার্তা দিতে গিয়ে ধর্মীয় কট্টরপন্থীদের তীব্র রোষের মুখে পড়েছে হিন্দুস্থান ইউনিলিভার।
সার্ফ এক্সেলের সেই বিজ্ঞাপন :