তামিমের জবানিতে সেই সময় ৩০ সেকেন্ডের ব্যাপার

ক্রাইমর্বাতা রিপোট:   শ্বাসরুদ্ধকর সময়। ২০ গজ আর ৩০ সেকেন্ডের দূরত্ব। আক্ষরিক অর্থেই কপালগুণে বেঁচে গেছেন বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটাররা। কী ঘটেছিল তখন? ভয়াল সেই মুহূর্তের আবেগময় বয়ান দিলেন তামিম ইকবাল। ক্রিকইনফোর কাছে খুলে বলেছেন তিনি সব। তার
জবানিতে পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হলো।

‘বাসে চড়ার আগে কী ঘটেছিল তা আমাকে ব্যাখ্যা করতে দিন। বুঝতে পারবেন, ওই দুই-তিন মিনিট কতটা পার্থক্য গড়ে দিয়েছে।

মুশফিক ও রিয়াদ ভাই সাধারণত খুতবার সময় মসজিদে উপস্থিত থাকতে চান। এ কারণেই একটু আগে জুমার নামাজে যেতে চেয়েছিলাম। দুপুর দেড়টায় বাস ছাড়ার কথা ছিল। কিন্তু রিয়াদ ভাই প্রেস কনফারেন্স করতে যান। সেখানে খানিকটা সময় ব্যয় হয়। প্রেস কনফারেন্স শেষ হওয়ার পর তিনি ড্রেসিংরুমে আসেন।
ড্রেসিংরুমে আমরা ফুটবল নিয়ে মেতে উঠি। তাইজুল হারতে চাচ্ছিল না। কিন্তু অন্যরা খেলায় তাকে হারানোর চেষ্টা করে। তাইজুল ও মুশফিক দু’জনের মাঝেও একটা ম্যাচ হয়। এতে আরো খানিকটা সময় ব্যয় হয়। ওসব ছোটখাট জিনিসই শেষতক আমাদের বাঁচিয়ে দিলো।

খেলা শেষ করে আমরা বাসে উঠলাম। পরিকল্পনা ছিল নামাজ শেষে টিম হোটেলে যাওয়ার। এ কারণেই শ্রী (টিম এনালিস্ট শ্রীনিবাস চন্দ্রসেকারান) এবং সৌম্য সরকার আমাদের সঙ্গে ছিল। যেহেতু ঐচ্ছিক অনুশীলন ছিল না, যারা অনুশীলনে যাবে না তারা থাকবে হোটেলে। আর যারা অনুশীলন করবে তারা মাঠে আসবে। এটাই পরিকল্পনা ছিল।

আমি বাঁ দিক থেকে ষষ্ঠ সিটে বসি। যখন আমরা মসজিদের কাছাকাছি পৌঁছুই আমার ডানে যারা ছিল তারা জানালার বাইরে কিছু একটা দেখতে পায়। আমি ফ্লোরে একটি দেহ পড়ে থাকতে দেখি। তখন মনে হয়েছিল কেউ হয়তো মাতাল কিংবা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। স্বাভাবিকভাবেই নেই বিষয়টা। বাস চলতে থাকে এবং মসজিদের কাছে গিয়ে থামে। কিন্তু সবার দৃষ্টি তখনো মাটিতে পড়ে থাকা দেহটির উপর। ঠিক তখনই আমি আরেকজন রক্তাক্ত লোককে দেখি ধীরে ধীরে লুটিয়ে পড়ছে। সেখান থেকেই ভয়টা দানা বাঁধে। আমাদের বাস মসজিদের নিকট একটা গাড়ির কাছে গিয়ে থামে। আমরা দেখি যে বাস ড্রাইভার একজন মহিলার সঙ্গে কথা বলছে। কাঁপা কাঁপা গলায় তিনি বলছিলেন, ‘গুলি চলছে। যেও না। যেও না।’ আমাদের বাস ড্রাইভার মহিলাকে জিজ্ঞেস করেন মসজিদের ভেতরে কেউ আছে কি না। তিনি উত্তর দেন, ‘না… না… না… মসজিদে যেও না। গোলাগুলিটা মসজিদের ভেতরেই ঘটছে।’ তিনি কাঁদতে শুরু করেন।  আমাদের সবার চোখের সামনেই। ভয়টা আরো বেড়ে যায়। সেই মুহূর্তে আমরা মসজিদ থেকে মাত্র ২০ গজ দূরে ছিলাম। মানে বাস থেকে নেমেই মসজিদে ঢুকব এমন। এতটাই কাছে ছিলাম। আমরা মসজিদের ফ্লোরে বেশ কয়েকটি দেহ পড়ে থাকতে দেখি। এটা দেখার পর আমরা বুঝতে পারছিলাম না আসলে কি করবো। আমাদের মধ্যে যারা মাথায় টুপি পরে ছিল, ভয়ে তারা টুপি নামিয়ে ফেলে। সবাই টের পেয়েছিল কিছু একটা ঘটছে। যারা পাঞ্জাবি পরা ছিল, ওরা এর ওপর জ্যাকেট পরে নিলো। এ ছাড়া আর কী করার আছে?

এরপর আমরা বাসের মেঝেতে শুয়ে পড়ি। আমাকে দেখুন, আমি ঠিকমতো কথাও বলতে পারছি না। আমরা বাস ড্রাইভারকে বললাম এখান থেকে আমাদের বের করুন। কিছু একটা করুন। কিন্তু তিনি নড়লেন না। আমিসহ সবাই চিল্লা-পাল্লা শুরু করলো। ছয়-সাত মিনিট কাটলো। কোনো পুলিশ ছিল না। এরপর হঠাৎ পুলিশের আগমন। স্পেশাল ফোর্স ঝড়ের বেগে যেভাবে মসজিদে আসলো আমরা থ’ হয়ে গেলাম। আমার সারা শরীর জমে গেল। মসজিদ থেকে আহত-রক্তাক্ত দেহ একটার পর একটা বের হতে থাকলো।

তখন আমাদের নিজেদের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। আমরা চিৎকার করতে শুরু করি, ‘আমাদের যেতে দাও!’ কেউ একজন বলে উঠলো, ‘আমরা বের হলে যদি ওরা গুলি করে?’ আরেকজন বললো, ‘বাসে বসে থাকলে আমরা বিপদে পড়বো।’ আমার বোধ হলো বাস থেকে বেরিয়ে গেলে আমাদের রক্ষা পাওয়ার একটা সুযোগ থাকবে। বাসে আমরা বড় লক্ষ্যবস্তু। কিন্তু কোথায় যাব? দুটি দরজাই বন্ধ।

তখন কোনো কারণে ড্রাইভার বাসটা ১০ মিটারের মতো সামনে এগিয়ে নেন। আমি জানি না কেন তিনি সেটা করেছিলেন। আমরা তখন ভেঙে পড়েছি। সবাই আশা ছেড়ে দিয়েছে। আমরা বাসের মাঝের দরজায় ধাক্কা ও লাথি মারতে শুরু করলাম। ড্রাইভার দরজা খুললেন।

যখন ড্রাইভার বাসটা সামনে নিয়ে যাচ্ছিলেন। আমি আপনাকে (প্রতিবেদক) কল করেছিলাম। আপনি ভেবেছিলেন আমি মজা করছি। কিন্তু আমি কতটা সিরিয়াস ছিলাম, তা বোঝানোর মতো পরিস্থিতি ছিল না তখন। আপনি আমার কথা শুনেছিলেন, ঠিক? আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ি যখন মাজহার আমাকে ফোন করেন। কি ঘটছে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।

প্রায় আট মিনিট পর বাস থেকে শেষ পর্যন্ত নামলাম। সবাই বলছিল, পার্ক দিয়ে দৌঁড় দেই। কেউ বললো, পার্কে আমরা সহজ লক্ষ্যে পরিণত হব। বন্দুকধারী যদি আমাদের দেখে গুলি করতে শুরু করে?
আমার কাছে যেটা ভীতিকর লাগছিল, পুলিশ আমাদের দৌড়াতে দেখে কী ভাববে? এর মধ্যে দেখলাম আপনারা তিনজন (প্রতিবেদক মোহাম্মদ ইসাম, উৎপল শুভ্র ও মাজহারউদ্দিন) আসছেন। তখন বুঝতে পারিনি। কিন্তু কাল রাতে বুঝলাম, আপনারা কত বড় ঝুঁকি নিয়েছিলেন। অনেক কম মানুষই এমন ঝুঁকি নেয়। ওই রকম পরিস্থিতিতে কাছের মানুষেরাও হয়তো আপনাদের মতো ভূমিকা নেয় না। আসলে আপনাদের দেখে কিছুটা শান্ত হই এবং হাঁটতে শুরু করি। কিছুটা এগিয়ে যাওয়ার পর সবাই মাঠের দিকে দৌড়াতে শুরু করে।

জানেন, স্বচক্ষে মৃত্যুকে দেখেছি। শরীর ঠা-া হয়ে আসছিল। এটা এমন একটা ঘটনা যা আমরা সারা জীবনে ভুলতে পারবো না। দলের সবারই এই এক কথা। সবার মুখে কিছুটা হাসি ফিরেছে ঠিকই কিন্তু ভেতরে-ভেতরে বিধ্বস্ত।

আমরা হোটেলে ফিরে সোজা রিয়াদ ভাইয়ের কামরায় চলে যাই। বন্দুকধারীর ভিডিও দেখি। খেলোয়াড়েরা কাঁদতে শুরু করে। ড্রেসিংরুমে আমরা সবাই কেঁদেছি। একটা কথা নিশ্চিত করে বলতে পারি, এই ঘটনা ভুলতে অনেক সময় লাগবে। পরিবারের সাহায্য লাগবে। চোখ বন্ধ করলেই ভেসে ওঠে দৃশ্যগুলো। কাল রাতে বেশিরভাগ ক্রিকেটার একসঙ্গে ঘুমিয়েছে। আমি ঘুমিয়েছি মিরাজ ও সোহেল ভাইয়ের সঙ্গে। স্বপ্নে দেখেছি, বাইকে করে ওরা গুলি করছে।
বিমানবন্দরে আসার পথে আমরা একে অপরকে বলছিলাম, একটু এদিক-সেদিক হলেই আমরা নয়, লাশগুলো ঘরে ফিরতো। মাত্র ত্রিশ সেকেন্ডের ব্যাপার।’

Check Also

আশাশুনির খাজরা ইউনিয়নের খালিয়া রাস্তার বেহাল দশা।। বিপত্তিতে শতাধিক পরিবার।।দ্রুত সংস্কার দাবি 

এস,এম মোস্তাফিজুর রহমান,আশাশুনি।।আশাশুনি উপজেলার খাজরা ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ড খালিয়া গ্রামের সানাপাড়ার প্রায় শতাধিক পরিবার একটি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।