লে. কর্নেল (অব.) এটিএম মহিউদ্দিন সেরনিয়াবাত;
বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম নবীন দেশ। এই জনপদ পাঁচ হাজার বছরের অধিক প্রাচীন হলেও ১৯৭১-এর আগে কখনোই স্বাধীন ছিল না। এখানকার মিষ্টি পানি, নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া, উর্বর ভূমি, অফুরন্ত খাদ্য উৎসের লোভে শুধু সাইবেরিয়ার পক্ষীকুল নয়, সাগর-মহাসাগর পাড়ি দিয়ে ছুটে এসেছিল বিভিন্ন ধর্ম, গোত্র, জাতি ও ভাষাভাষীর উচ্চাভিলাষী মানুষ।
প্রথমে তারা বাণিজ্য, পরে শাসনক্ষমতা দখল করে এ দেশের সহজসরল মানুষের ওপর স্টিমরোলার চালিয়েছিল। বিদেশি পর্যটকদের বর্ণানানুযায়ী এসব শাসক ও তাদের অধীনস্তরা ছয় ফুট লম্বা ও ছয় ইঞ্চি মোটা পিচ্ছিল রশির চাবুক দিয়ে খাজনা দিতে ব্যর্থ দরিদ্র প্রজাদের এমনভাবে প্রহার করত- পিঠে এক ইঞ্চি গভীর ক্ষত সৃষ্টি এবং তা থেকে পচন ধরে মারা যেত। এসব অত্যাচারের বিরুদ্ধে যুগে যুগে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ হয়েছে।
মঞ্জু শাহ্, চেরাগ আলী, নুরলদীন, পিতাম্বর, সাওতাল নেতা সিধু-কানু দুই সহোদরসহ অসংখ্য বীর এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন। দুঃখজনক হল, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে তারা ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত করতে না পারায় প্রতিবাদ-সংগ্রামে সফল হতে পারেনি। জীবনের পর জীবন বলিদানের অনেক ঘটনার পর ১৯৭১ সালে যার নেতৃত্বে বিদেশি শাসক ও শত্রুকে এ দেশের মাটি থেকে চিরদিনের জন্য বিতারিত করা সম্ভব হয়েছে, হ্যামিলনের সেই বংশীবাদক শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মবার্ষিকীর পূর্বক্ষণে তার জীবনের চুম্বক অংশ উপস্থাপন করছি।
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের মধুমতি নদীর তীরে টুঙ্গিপাড়ায় পিতা শেখ লুৎফর রহমান ও মাতা সাহারা খাতুনের ঘর আলোকিত করে
জন্মেছিল এক শিশুপুত্র- নাম শেখ মুজিবুর রহমান। এই বংশের পূর্বপুরুষ শেখ বোরহানুদ্দিন দুইশ’ বছর আগে ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে সুদূর ইরাক থেকে বাংলায় এসে টুঙ্গিপাড়ায় আবাস গেড়েছিলেন। কঠিন ধর্মীয় অনুশাসন ও মূল্যবোধে বিশ্বাসী শেখ পরিবারের নিজস্ব মাদ্রাসায় আমপাড়ার মাধ্যমেই মুজিবের হাতেখড়ি। ছয় বছর বয়সে মৌলিক শিক্ষার উদ্দেশ্যে তাকে স্থানীয় গিমাডাঙ্গা স্কুলে ভর্তি করা হয়।
এই গিমাডাঙ্গা স্কুলে সেই সময়ে এক সংস্কৃতের শিক্ষক জ্যোতিষ শাস্ত্রের ওপর ভালো জ্ঞান রাখতেন। শেখ মুজিবের বাবা শেখ লুৎফর রহমানের সঙ্গে ছিল তার সখ্য এবং শেখবাড়িতে ছিল তার যাতায়াত। একদিন স্রেফ কৌতূহলবশত ওই জ্যোতিষী শিশু মুজিবের হস্তরেখা পড়তে গিয়ে কপাল কুচকে ফেলেন। তিনি শেখ লুৎফর রহমানকে এই বলে সতর্ক করেন যে, এই শিশু বেঁচে থাকলে বড় একটা কিছু হবে; বংশের নাম আলোকিত করবে।
তবে প্রতি পদে পদে তার বাধা, এমনকি অপঘাতে মৃত্যুযোগ রয়েছে। জ্যোতিষের এমন ভবিষ্যদ্বাণীতে শঙ্কিত পিতা ম্যাট্রিকুলেশন পর্যন্ত মুজিবকে কখনও নিজের ছায়ার বাইরে যেতে দেননি। হাইস্কুলে থাকাকালে কঠিন বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হয়ে চিরদিনের জন্য মুজিব অন্ধ হওয়ার উপক্রম হন। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা যে চোখ দুটি তৈরিই করেছেন একটি অন্ধ জাতিকে আলোর পথ দেখানোর জন্য, সেই চোখ শেষ পর্যন্ত তিনিই রক্ষা করেছিলেন। তবে এজন্য চার বছর তার পড়াশোনা বন্ধ ছিল।
১৯৩৮ সালে শেরেবাংলা ফজলুল হক ও সোহরাওয়ার্দীকে নিজ স্কুলে সংবর্ধনা দেয়ায় মুজিব স্থানীয় কংগ্রেস দলের রোষানলে পরেন। ফলে তুচ্ছ একটি ঘটনায় তাকে গ্রেফতার করা হয়। এভাবেই মুজিবের কারা জীবনের সূত্রপাত ঘটে। ম্যাট্রিকুলেশন পাস করার পর শেখ মুজিব কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন।
এখানে অধ্যয়নকালেই নিজ ব্যক্তিত্ব, সাহসিকতা, সাংগঠনিক দক্ষতায় টুঙ্গিপাড়ার গ্রাম থেকে উঠে আসা শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রদের প্রিয় মুজিব ভাই হয়ে যান। মূলত এখানেই তার নেতৃত্বের প্রথম বিকাশ ঘটে। তিনি ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ওই বয়সে তিনি কলকাতার ফরিদপুর জেলা সমিতিরও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
১৯৪৬-৪৭ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বৃহত্তর ফরিদপুরের দায়িত্ব পাওয়ায় জ্যেষ্ঠ নেতারা তার ওপর ক্ষুব্ধ হন। ১৯৪৭-এর প্রথমদিকে কলকাতায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা শুরু হলে তিনি স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে লাঠিহাতে রাত-দিন কলকাতার রাস্তায় টহল দেয়ার ঝুঁকি নিয়েছিলেন।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের ন্যায্য দাবির প্রতি সমর্থন দেয়ার অপরাধে তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার ও পরে তার একগুঁয়েমির জন্য আটক করা হয়। পরবর্তীকালে ইতিহাস সাক্ষ্য দিয়েছে- সৃষ্টিকর্তা রাজনীতির উন্মুক্ত মঞ্চ ও মাঠ তৈরি করেছিলেন যে তেজোদীপ্ত যুবকের জন্য; সেই যুবককে শ্রেণীকক্ষে বন্দি রাখার সাধ্য কার?
এ ব্যাপারে দক্ষিণ আফ্রিকার নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গে শেখ মুজিবের মিল পাওয়া যায়। নেলসন ম্যান্ডেলাকেও আন্দোলনে জড়িত থাকার অভিযোগে আইনের ক্লাস থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল। এরপর মুজিবের আর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ ও সময় হয়নি।
পূর্ব পাকিস্তান সৃষ্টির মাধ্যমে স্বাধীনতা এলেও মুক্তি আসেনি চিন্তা থেকেই দেশ বিভাগের মাত্র ৬ মাসের মধ্যেই মুজিব গঠন করেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ। ১৯৪৮-এ জিন্নাহ কর্তৃক উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার পরদিন বিক্ষোভ মিছিল থেকে শেখ মুজিবকে আটক করা হয়। পাকিস্তান সৃষ্টির পর এ নিয়ে দ্বিতীয়বার তিনি গ্রেফতার হন। মুক্তি পেয়ে টাঙ্গাইলের জনসভায় কঠোর ভাষায় সরকারের সমালোচনা করার অপরাধে আবারও জেলে ভরা হয়।
১৯৪৯-এর ৩০ জুন পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হলে কারাগারের বাসিন্দা তেজোদীপ্ত, সাহসী মুজিবকে যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। ১৯৫০ সালে মুক্তির পর সারা দেশের দুর্ভিক্ষের প্রতিবাদে ভুখামিছিলে নেতৃত্ব দেয়ায় আবারও আটক করা হয়। ১৯৫২ সালের জানুয়ারিতে বাইরে এলেও ভাষা আন্দোলনে উত্তাপ ছড়ানোর অপরাধে পুনরায় ১২ ফেব্রুয়ারি তাকে জেলে ভরা হয়। কিন্তু এভাবে কি তাকে নিবৃত্ত করা সম্ভব? ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ভাষা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে একাত্মতা জানিয়ে তিনি ও মঠবাড়িয়ার মহিউদ্দিন আহমেদ কারাগারেই আমরণ অনশন শুরু করেন। ১১তম দিনে তেজি অথচ পাতলা ছিপ ছিপে মুজিবের জীবন বিপদাপন্ন হয়ে পড়লে সরকার তাদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
১৯৫৩’র ফেব্রুয়ারিতে সাইকেল চালিয়ে তিনি ঢাকার পাড়া-মহল্লায় মিছিল-মিটিং করে মানুষের চেতনায় ভাষা আন্দোলনকে জাগ্রত করেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হলে শেখ মুজিবের নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক দক্ষতা আরও মজবুত হয়। গোপালগঞ্জের মুসলিম লীগের বড় নেতা ওয়াহিদুজ্জামানকে বিপুল ভোটে হারিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। মুজিব যুক্তফ্রন্টের তরুণ অথচ প্রভাবশালী মন্ত্রী হন। কিন্তু অল্পদিনেই এই মন্ত্রিপরিষদ বিলুপ্ত ও শেখ মুজিব গ্রেফতার হন। বছরখানেক পর মুক্ত হয়ে তিনি গণপরিষদ নির্বাচনে জয়ী ও মন্ত্রী হন। একই বছর তিনি আওয়ামী লীগেরও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলে দলের প্রতি কমিটমেন্টের কারণে মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করেন।
এই সময় দলের কাজে সম্পূর্ণভাবে আত্মনিয়োগ এবং আওয়ামী লীগকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করান। ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারি করা হলে আবারও মুজিবের স্থান হয় কারাগারে। ১৯৬১ সালের ৭ ডিসেম্বর তাকে মুক্তি দেয়া হলেও রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে সরকার ডিক্রি জারি করে। এতদিনে জেলখাটা তার গা সওয়া হয়ে গেছে। জেলের ঝুঁকি নিয়ে এই সুযোগে তিনি স্বাধীনতার প্রস্তুতির জন্য স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ এবং মহকুমা-থানায় নিউক্লিয়াস গঠন করেন। তার এই তৎপরতা অনুমান করতে পেরে সরকার তাকে জেলের ভেতরে পাঠায়। সামরিক আইন প্রত্যাহার হলে তিনি মুক্তি পেয়ে সোহরাওয়ার্দীকে নিয়ে গ্রামে-গঞ্জে সাংগঠনিক সফরে বের হন। ১৯৬২ সালে শিক্ষা কমিশন আন্দোলনে তিনি সমর্থন জানান। কেননা আগামী দিনে তার স্বপ্নের স্বাধীনতা সংগ্রামে যে এই ছাত্ররাই হবে প্রকৃত সৈনিক!
১৯৬৪-এর ৮ ও ৯ মার্চ মোনেম খাঁ ও তার সাঙ্গোপাঙ্গদের প্ররোচনায় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা হয়। শেখ মুজিব ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখে দাঁড়াও’ মর্মে বিবৃতি এবং দাঙ্গাবিরোধী মিছিলে নেতৃত্ব দেন। দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে আসে। ১৯৬৪ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে শেখ মুজিব ফাতেমা জিন্নাহকে সমর্থন ও প্রচারাভিযানকালে আন্দোলনের জন্য বাঙালিদের প্রস্তুতির আহ্বান জানান। তার বক্তব্যকে রাষ্ট্রবিরোধী আখ্যা দিয়ে আবারও তাকে আটক করা হয়। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধ তার রাজনৈতিক জীবনে সাফল্যের আরেকটি দরজা খুলে দেয়।
আঙুল দিয়ে তিনি বাঙালিদের দেখিয়ে দেন যে, কীভাবে পশ্চিমারা বাঙালিদের শত্রুর দয়ার ওপর ছেড়ে দিয়েছিল। পরের বছর তিনি ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি পেশ করলে সামরিক জান্তা ও শাষকগোষ্ঠী তাকে দেশের শত্রু আখ্যা দিয়ে বসে। আওয়ামী লীগেরও একটি বড় ও শক্ত অংশ তাদের সঙ্গে গলা মেলায়। কিন্তু মুজিব দমে যাওয়ার পাত্র নন। ছয় দফা নিয়ে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের মাঠ-ঘাট, পথ-প্রান্তর চষে বেড়ান।
মুজিবের জাদুকরী কণ্ঠ ও উপস্থাপনার কারণে বাঙালিরা ছয় দফাকে মুক্তি সনদ হিসেবে লুফে নেয়। তাকে বাধা দিতে আইউব-মোনেম সরকার একের পর এক মামলা ও হয়রানির খেলায় মেতে ওঠে। এসব মামলার চূড়ান্ত পর্যায়ে তাকে আটক ও ৩৪ জন বাঙালিসহ মুজিবকে প্রধান আসামি করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ফাঁদে ফেলা হয়। কিন্তু এ মামলা শাসকগোষ্ঠীর জন্য বুমেরাং হয়ে যায়। স্লোগান ওঠে- জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব।
১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে আন্দোলনের আগুন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। বেকায়দায় পড়ে নিশ্চিত ফাঁসির আসামি মুজিবকে সরকার প্যারোলে মুক্তির প্রস্তাব দিলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে বাধ্য হয়ে বিনাশর্তে তাকে মুক্তি ও মামলা প্রত্যাহার করা হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি ’৬৯ সালে লাখ লাখ জনতার উপস্থিতিতে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেয়া হয়। সেই থেকে শেখ মুজিব বাঙালির বঙ্গবন্ধু।
২৫ মার্চ ৬৯ লৌহমানব আইয়ুব খানের পতন ঘটে। আগরতলা মামলা সত্য না মিথ্যা, তা প্রমাণের পূর্বেই মুক্তি, ছয় দফার প্রতি জনসমর্থন, ’৬৯-এর সফল গণঅভ্যুত্থান মুজিবকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে দেয়। তিনি বাঙালির নাড়ির স্পন্দন বুঝতে পারেন। তিনি উপলব্ধি করতে পারেন যে, হাজার বছরের নিগৃহীত, শোষিত বাঙালি এবার তার পেছনে ঐক্যবদ্ধ।
কিন্তু তার স্বপ্ন পূরণের জন্য তাদের ম্যান্ডেট প্রয়োজন। এরপর তিনি এক ব্যক্তির এক ভোটের নির্বাচন দাবি করেন। ৫ ডিসেম্বর ’৬৯ নেতা সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট ভাষায় উচ্চারণ করেন, ‘জনগণের পক্ষ থেকে আমি ঘোষণা করছি যে, আজ থেকে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে শুধু বাংলাদেশ।’
১৯৭০-এর মার্চে পিন্ডি থেকে ঘোষণা করা হয়, ডিসেম্বরে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন। নির্বাচনী প্রচারাভিযানকালে সব ক্লান্তি দূরে ঠেলে পূর্ব পাকিস্তানের এমন কোনো জেলা, মহকুমা, থানা বাদ যায়নি; যেখানে সশরীরে উপস্থিত হয়ে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা ও নৌকার পক্ষে ভোট প্রার্থনা করেননি। ৭ ও ১৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে যথাক্রমে ১৬২ ও ২৬৪ আসন নিয়ে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়।
সারা দেশ আনন্দে ভাসতে থাকে। কিন্তু শুরু হয় ষড়যন্ত্র। বাঙালিদের হাতে কিছুতেই শাসন ক্ষমতা নয়! অতএব বাঙালি নেতৃত্ব, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র, এমনকি একই ইউনিফর্ম পরিহিত সেনা, পুলিশ ও ইপিআর বাহিনীকে ধ্বংস করার প্রস্তুতি শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু সবই বুঝতে পারছেন, কিন্তু বিচ্ছিন্নতাবাদীর অগ্রিম অপবাদে অভিযুক্ত হয়ে বাঙালির ইস্পাতকঠিন ঐক্যে ফাটল ধরানোর মতো হঠকারী সিদ্ধান্ত নিতে প্রস্তুত নন।
তারপরও ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে পুরো জাতিকে আগামী দিনের গেরিলাযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতির সংকেত দিয়ে দেন। তিনি আটক কিংবা নিহত হতে পারেন জেনেই ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। বাঙালির হৃৎপিণ্ডে, মস্তিষ্কে, শিরা-উপশিরায় স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ছড়িয়ে দেন। ফলে ৯ মাস তিনি কারাবন্দি থাকলেও তার নির্দেশ ধারণ করেই বাঙালি ছিল ঐক্যবদ্ধ, সুসংগঠিত। আর তাই তো মাত্র ৯ মাসে তারা দেশ স্বাধীন করতে পেরেছিল।
এ মাটি জন্ম দিয়েছে অনেক দেশপ্রেমিক, রাজনীতিক ও বীরের। তাদের অবদানকে খাটো করা না করেও বলা যায়- এই জাতিকে ধীরে ধীরে ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত করে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন যিনি, তিনিই শেখ মুজিব। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু মুক্ত হয়ে তার আজীবনের লালিত স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন। কিন্তু তখনও অব্যাহত ছিল ষড়যন্ত্র। দেশি-বিদেশি পরাজিত শক্তির ষড়যন্ত্রের চূড়ান্ত পরিণতিতে ১৫ আগস্ট ’৭৫ সপরিবারে তাকে হত্যা করা হলে শৈশবে জ্যোতিষের ভবিষ্যদ্বাণী- অপঘাতে তার মৃত্যু সত্যে প্রমাণিত হল।
তবে কি বঙ্গবন্ধুর জন্ম হয়েছিল কেবল বাংলাদেশ সৃষ্টির জন্য! কিন্তু জ্যোতিষের বংশের মুখ উজ্জ্বল করার ভবিষ্যদ্বাণী যে ছিল খুবই সীমিত কল্পনামাত্র! কেননা শেখ মুজিব কেবল তার বংশ নয়; হাজার বছরের পরাধীন একটি জাতিকে দিয়েছেন স্বাধীনতা, বিশ্ব দরবারে তাদের মুখ করেছেন উজ্জ্বল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে; কিন্তু এই দেশ যদি ভবিষ্যতে আবারও বিপদাপন্ন হয়, তবে সৃষ্টিকর্তা যেন মুজিবকে প্রেরণ করেন স্বাধীনতা রক্ষার জন্য- এটাই সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা।
এটিএম মহিউদ্দিন সেরনিয়াবাত : অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা