সুপ্রিমকোর্ট থেকে গায়েব হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ নথি প্রশাসনকে নজরদারি বাড়াতে হবে-ব্যারিস্টার শফিক * এটা রোধ হওয়া দরকার -ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন * হাইকোর্ট বেঞ্চের উদ্বেগ

ক্রাইমর্বাতা রিপোট: সুপ্রিমকোর্ট থেকে একের পর এক নথি গায়েবের ঘটনায় নতুন সংকটে বিচারপ্রার্থীরা। প্রায়ই গুরুত্বপূর্ণ মামলার নথি উধাও হয়ে যাওয়ায় সংশ্লিষ্টদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। বিষয়টি হাইকোর্টের একাধিক বেঞ্চের নজরেও এসেছে।

এ নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়া বিচারপ্রার্থীদের অনেকে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ করলেও প্রতিকার মিলছে না। এর সঙ্গে এক শ্রেণীর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠেছে। আবার ইচ্ছে করে নথি লুকিয়ে রাখা, পয়সা দিলে তা বের কয়ে দেয়ার অভিযোগও আছে।

দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে নথি গায়েবের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে আইনজ্ঞরাও বলছেন, নথি গায়েব মারাত্মক অপরাধ। প্রশাসনকে তৎপর হতে হবে, জড়িতদের বিরুদ্ধে নিতে হবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা।

এ নিয়ে কথা হয় সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের সঙ্গে। তিনি  বলেন, সুপ্রিমকোর্টে প্রায়ই মামলার নথি গায়েবের কথা শুনি। এটা রোধ করা দরকার। সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসনকে নজরদারি বাড়াতে হবে। জানতে চাইলে সুপ্রিমকোর্ট বারের সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেছেন, অনেক সময় নথি আদালতে পাওয়া যায় না। আবার কিছু অর্থ খরচ করলেই সেটি আবার পাওয়াও যায়। এটা রোধ হওয়া দরকার। আমরা একটি কমিটিও করে দিয়েছি। কমিটি এ বিষয়ে তার পর্যবেক্ষণ জানিয়ে প্রতিবেদনও জমা দিয়েছে। সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিলে সংকট কিছুটা লাঘব হতে পারে।

জানা যায়, জনৈক রফিকুল ইসলাম ২০১৭ সালের ২ জানুয়ারি মহানগর দায়রা জজ আদালতে ফৌজদারি মামলা করেন। মামলায় সরকারের সঙ্গে মহানগর ট্রেডার্সের পক্ষে মঞ্জুর কাদের পক্ষ হয়। পরে দায়রা জজ আদালতের একটি আদেশের বিরুদ্ধে রফিকুল হাইকোর্টে যান।

২০১৭ সালের ২৩ জানুয়ারি শুনানির পর হাইকোর্ট রুল জারি ও ৪ মাসের জন্য স্থগিতাদেশ দেন। পরে আদালত স্থগিতাদেশ বর্ধিতও করেন। এরপরই ফাইলটি হাইকোর্ট বিভাগ থেকে উধাও হয়ে যায়। আজও তার হদিস মেলেনি।

গত বছর ৬ ডিসেম্বর রফিকুল ইসলামের আইনজীবী শংকর চন্দ্র দাস সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার বরাবর আবেদন করলেও ফাইল খুঁজে পাওয়া যায়নি। পরে সিএমএম কোর্ট মামলার কার্যক্রম শুরু করে, এর ফলে রফিকুল ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

তিনি যুগান্তরকে জানান, বিচারপতি একেএম আসাদুজ্জামানের নেতৃত্বে হাইকোর্ট বেঞ্চে ফাইল না পাওয়ার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। আদালত ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছে। পরে রেজিস্ট্রার বরাবর আবেদন করা হলেও মামলার ফাইল পাওয়া যায়নি। ফলে মামলার স্থগিতাদেশ বর্ধিত করাও সম্ভব হয়নি। এ সুযোগে সিএমএম কোর্ট মামলা চালু করে দিয়েছেন এবং ২৮ মার্চ পরবর্তী শুনানি।

এ বিষয়ে হাইকোর্টের নথি শাখার (ক্রিমিনাল মিস কেস) সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা জানান, প্রতিদিন এ শাখা থেকে হাজার হাজার ফাইল যায়। আর সেকশনে লোকবল ও জায়গা স্বল্পতাও রয়েছে। এজন্যই ফাইল হারানোর অভিযোগ উঠে কখনও কখনও। তবে হাইকোর্ট সেকশন থেকে কোনো ফাইল হারায় না। অভিযোগ পেলে ফাইল উদ্ধার করা হয়। আর সংশ্লিষ্ট মামলার ফাইলটি অনুসন্ধানের জন্য পাঠানো হয়েছে। গত মাসে লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নপত্র বাতিলের আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করেন ওয়াজেদুল ইসলাম শাহীন নামে এক ব্যক্তি।

কিন্তু শুনানির আগে মামলার নথি গায়েব হওয়ায় সেদিন আদেশ দিতে পারেননি আদালত। পরদিন নতুন করে মামলা ফাইল করে উপস্থাপন করা হলে আদালত তার প্রার্থিতা ফিরিয়ে দেন। সংশ্লিষ্ট বেঞ্চ এ ঘটনায় অসন্তোষ প্রকাশ করে সেকশনের দুই কর্মকর্তাকে ভর্ৎসনাও করেন।

গত মাসে এ ঘটনা ঘটে। রাজধানীর বাংলাবাজারে অর্পিত সম্পত্তির তালিকাভুক্ত একটি জমিদার বাড়ি দখলের জন্য প্রতারণা ও জালিয়াতির অভিযোগে করা মামলা বাতিল সংক্রান্ত আবেদনের ফাইল হাইকোর্ট থেকে গায়েব হয়ে যায়। ৭ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি মো. রিয়াজউদ্দিন খানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ফাইল উদ্ধারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে এবং কিভাবে ফাইল গায়েব হয়েছে সে ব্যাপারে প্রতিবেদন দিতে হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রারকে ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় দেন।

এ ব্যাপারে হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার গোলাম রব্বানীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি  জানান, ফাইলটি উদ্ধার করে সংশ্লিষ্ট বেঞ্চে পাঠানো হয়েছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মামলার এক পক্ষের আইনজীবী এসআরএম লুৎফর রহমান আকন্দ সাংবাদিকদের বলেন, ওই বাড়ির মালিক জমিদার দ্বিজেশ চন্দ্র রায় চৌধুরীর ভুয়া নাতি সেজে রতন চন্দ্র রায় গং ওয়ারিশ হিসেবে সরকারি বাড়িটি দখলের জন্য প্রতারণার আশ্রয় নেয়। ২০০৫ সালে এ ঘটনায় মামলা হয়।

তবে মামলায় অভিযোগ গঠনের আদেশ বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৬১ ধারায় একটি বাতিল আবেদন করেন রতন চন্দ্রসহ অন্যরা। আবেদনের শুনানি শেষে হাইকোর্ট মামলার কার্যক্রম দু’বার স্থগিত করে রুল জারি করেন। বিভিন্ন সময়ে হাইকোর্ট থেকে নথি গায়েবের ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছেন বিচারপতিরাও। ১১ জানুয়ারি বিএনপি নেতা ইঞ্জিনিয়ার মঞ্জুরুল আহসান মুন্সির এক মামলার শুনানিতে এটিকে বিচার ব্যবস্থার জন্য ভয়াবহ বলে মন্তব্য করেন হাইকোর্টের বেঞ্চ।

এ অনিয়ম রোধে প্রধান বিচারপতির পরামর্শ অনুযায়ী সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতি ও সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসনকে কাজও করতে বলা হয়েছে। অনেক সরকারি অফিসের ফাইলও আটকে থাকার অভিযোগ রয়েছে। মানুষকে আইনি সহায়তাদানকারী প্রতিষ্ঠান সুপ্রিমকোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটির সদস্য সচিব ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট টাইটাস হিল্লোল রেমা গত বছরের ১৭ অক্টোবর রেজিস্ট্রার জেনারেল বরাবরে চিঠি ইস্যু করেন। সেখানে সরকারি স্টিকার সংবলিত ফাইল বা লিগ্যাল এইড অফিসের স্বাক্ষরিত পত্র বা মামলাগুলো সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ার কথা বলা হয়েছে। পরে গত ৬ নভেম্বর ডেপুটি রেজিস্ট্রার (প্রশাসনও বিচার) মোহাম্মদ আক্তারুজ্জামান ভূঁইয়া স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখার জন্য সব শাখাকে নির্দেশ দেয়া হয়।

এ বিষয়ে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসনের এক কর্মকর্তা বলেন, মামলার ফাইল হারানোর কোনো অভিযোগ পেলে আমরা ব্যবস্থা নেই। সংশ্লিষ্ট শাখার প্রধানকে ফাইল খুঁজে বের করার নির্দেশ দেই। অনেক সময় তাৎক্ষণিক নির্দেশ দেয়া হয়। তিনি সংশ্লিষ্ট মামলার নথি উদ্ধারে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার আশ্বাস দেন।যুগান্তর

Check Also

বিএনপি নেতাকর্মীদের জড়িয়ে হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে দেবহাটায় মানববন্ধন

দেবহাটা প্রতিনিধি: স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার দোসর এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও ভূমিদস্যুদের গ্রেফতার এবং বিএনপির …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।