আবু সাইদ বিশ্বাসঃ ক্রাইমর্বাতা রির্পোট: সাতক্ষীরা: প্রাকৃতিক বিপর্যয়, মাটিতে লবণক্ষতা বৃদ্ধি, পানির লেয়ার নিচে নেমে যাওয়া, পানিতে আর্সেনিকের উপস্থিতিসহ নানা কারণে সাতক্ষীরায় মিষ্টি পানির উৎস নষ্ট হচ্ছে। গতআট মাসে জেলাতে ১৫শ ২২টি মিঠা পানির উৎস নষ্ট হয়েছে। যদিও গত এক বছরে জেলাতে ৩ হাজার ৭০টি মিঠা পানির উৎস সৃষ্টি করার দাবী করেছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্ত সাতক্ষীরা। দিনের পর দিন জেলাতে সুপেয় পানির উৎস নষ্ট হচ্ছে। পুকুর ও নদীতে বাড়ছে লবণক্ষতা। মাটির গভীরে বাড়ছে আর্সেনিক। চলতি মৌসুমে জেলাতে পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। পানির লেয়ার নিচে নেমে যাওয়াতে বেশিরভাগ নলকূপে পানি উঠছে না। পুকুর গুলো শুকিয়ে গেছে। কিছু এলাকার নলকূপে সিমীত পরিমানে পানি উঠছে। বেসরকারী ভাবে স্থাপন করা পানি বিশুদ্বকরণ ফিল্টারগুলোর প্রায় ৪০ শতাংশই অকেজো হয়ে পড়েছে। ফলে গোটা জেলাতে বিশুদ্ধ পানি পেতে হিমশিম খাচ্ছে জেলা ২২ লক্ষ মানুষ। এর মধ্যে প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ সুপেয় পানির অভাবে বিষাক্ত পানি ব্যবহার করছে।
চারপাশে সুবিশাল জলরাশি সত্ত্বেও পানের উপযোগী একটু পানির জন্য রীতিমতো হাহাকার চলছে। খাওয়ার উপযোগী পানির অভাব পূরণে দূরদূরান্তে ছুটে বেড়ানোর পাশাপাশি অনেকে আবার পুকুরের কাদামিশ্রিত ও লবণযুক্ত পানিও পান করতে বাধ্য হচ্ছেন।
গ্রীষ্মকাল শুরুর আগেই দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় সাতক্ষীরার শ্যামনগর,কালিগঞ্জ,আশাশুন ও তালা উপজেলার বেশিরভাগ এলাকাতে এমন অবস্থা বিরাজ করছে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্ত সাতক্ষীরা সূত্রে জানা যায় সরকারী হিসাব মতে জেলাতে মোট ৩৬ হাজার ৪১১টি হস্তচালিত নলকূপ রয়েছে। যার মধ্যে অকেজো রয়েছে ৫ হাজার ৪০২টি এবং সচল রয়েছে ৩১ হাজার ৯টি। তবে বাস্তবতা হলো অকেজোর সংখ্যা আরো বেশি।
এর মধ্যে সাতক্ষীরা সদরে চালু রয়েছে ৬৬২৫টি এবং অকেজো রয়েছে ৫০৪টি। কলারোয়াতে চালু রয়েছে ৫৪৭৭টি এবং অকেজো রয়েছে ৪৪০টি। তালাতে চালু রয়েছে ৫৪৩৪টি এবং অকেজো রয়েছে ২৭৪টি। আশাশুনিতে চালু রয়েছে ৫০৯১টি এবং অকেজো রয়েছে ৭৪৪টি। দেবহাটাতে চালু রয়েছে ৩০২৭টি এবং অকেজো রয়েছে ১১২টি। কালিগঞ্জে চালু রয়েছে ৪৫৫৪টি এবং অকেজো রয়েছে ১৯৭১টি। শ্যামনগরে চালু রয়েছে ৮৫৫০টি এবং অকেজো রয়েছে ৩৮৮টি। সাতক্ষীরা পৌরসভাতে চালুরয়েছে ৪৪৮টি।
সব মিলিয়ে জেলাতে মোট ৩ হাজার ৮৮০টি অকেজো নলকূপ রয়েছে। যা গত বছরে ছিল ২ হাজার ৪৬১টি।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্ত সাতক্ষীরা সূত্রে জানা যায় সরকারী হিসাব মতে গতবছর জেলাতে ৩৩ হাজার ৩৪১টি হস্তচালিত নলকূপ ছিল। যার মধ্যে অকেজো ছিল ৩ হাজার ৮৮০টি এবং সচল ছিল ২৯ হাজার ৪৬১টি। তবে বাস্তবতা হলো অকেজোর সংখ্যা আরো বেশি ছিল। সেই হিসাব মতে জেলাতে অগভীর নলক’প চালু চিল ১২ হাজার ৯৪টি এবং অকেজো ছিল ২ হাজার ৫৬৫টি।
সাতক্ষীরায় শতকরা কতভাগ মানুষ সুপেয় পানি পান করছেন তার কোনো সঠিক তথ্য নেই জনস্বাস্থ্য প্রকৗশল অধিদফতরে। কাগজপত্রে ৮০ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানি পাচ্ছে- এমনটা উল্লেখ থাকলেও বাস্তবতা ভিন্ন।
উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরায় প্রায় ২২ লাখ মানুষের বসতি। জলবায়ু ট্রাস্টের অর্থায়নে বিভিন্ন এনজিও সংস্থার মাধ্যমে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা হলেও তার যথাযথ সুফল পায়নি স্থানীয়রা।
চলতি বছরে জেলাতে ২৪৩টি সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাস্তবায়ন নিয়ে ছিল নানা অভিযোগ। পানির বিভিন্ন উৎস বাবদ জেলাতে নলকূপ,পুকুর সহ বিভিন্ন উৎস প্রকল্প তদারকি করেছে জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলি। বাস্তবায়ন কৃত প্রকল্পের ৫০ ভাগ স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং বাকি ৫০ শতাংশ স্থানীয় উপজেলা পরিষদ বাস্তবায়ন করেছে। খাতা কলমে যার বেশির ভাগ কাজ সমাপ্ত করা হয়েছে। কাজের কাজ তেমন কিছুই হয়নি বলে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ।
চলতি বছরে কলারোয়া পৌরসভাতে একটি পানি শোধনাগার স্থাপন করা হয়েছে। ৩ কোটি ৫৩ লক্ষ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি চালু হলে প্রতিঘণ্টায় এক লক্ষ ৮০হাজার লিটার পানি উৎপাদন করতে পারবে । চলতি বছরের জুন মাসে প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা।
সরেজমিনে ঘুরে ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রাকৃৃতিক উৎসগুলো শুকিয়ে যাওয়া, সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় গড়ে ওঠা জলাধারগুলো চাহিদা পূরণে সক্ষম না হওয়ায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে চলমান খাওয়ার উপযোগী পানির এ সমস্যা তাঁদের দৈনন্দিন ও প্রাত্যহিক জীবনের ওপর প্রভাব ফেলছে।
শ্যামনগর সদরসহ উপকূলবর্তী গোলাখালী, কালিঞ্চি, দেবালয়, হেঞ্চিসহ বিভিন্ন এলাকায় দেখা গেছে, খাওয়ার উপযোগী পানির জন্য মানুষের নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। নারী-পুরুষ এমনকি শিশুরা পর্যন্ত পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় খাওয়ার পানি সংগ্রহ করতে মাইলের পর মাইল রাস্তাা পাড়ি জমাচ্ছে। সপ্তম শ্রেণির সাবিনা জানায়, ঈশ্বরীপুর গ্রাম থেকে চার কিলোমিটার দূরবর্তী দেবালয় গ্রামের মাজেদ সরদারের বাড়ির পুকুর থেকে দিনে দুবার পানি সংগ্রহ করতে হয় তাকে। তার মা সুমাইয়া বেগম বলেন, সকাল ও স্কুল ছুটির পর এত দূর থেকে দুই দফা পানি নিয়ে আসতে গিয়ে মেয়ের লেখাপড়ার ক্ষতি হচ্ছে। নিজে গৃহস্থালি ও স্বামী দিনমজুরের কাজে ব্যস্ত থাকায় মেয়েকে দিয়ে পানি টানাতে হচ্ছে বলে জানান তিনি।
শ্যামনগর উপজেলা জনস্বাস্থ্য সহকারী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান জানান, এই অঞ্চলের শতকরা ৭০ ভাগ মানুষ পুকুরের পানি পান করে থাকে। লবণাক্ত এলাকা হওয়ায় গ্রীষ্মকালে পুকুরের পানি কমে যাওয়ায় খাওয়ার পানির সংকট প্রবল আকার ধারণ করে। তবে সরকারিভাবে ট্যাংকি সরবরাহ করে বৃষ্টির সময়কার পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে স্থানীয় লোকজনের সারা বছরের জন্য প্রয়োজনীয় পানির চাহিদা পূূরণের চেষ্টা চলছে।
শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার ১২টি ইউনিয়নে পাঁচ হাজার ৭৯৫টি পুকুর ও ১৩৬টি জলমহাল রয়েছে। এছাড়া ৪৬৫টিতে পিএসএফ থাকলেও ব্যবস্থাপনার অভাবে বন্ধ রয়েছে ৪০
আইলা দুর্গত শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জিএম মাসুদুল আলম জানান, ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলা পরবর্তী উপকুলীয় অন্যান্য ইউনিয়নের চেয়ে তার ইউনিয়নে মানুষজন বিশ্বদ্ধ খাওয়ার পানি কষ্ট পা
য় অনেক বেশি। তিনি বলেন, বিকল্প কোনো ব্যবস্থা না থাকায় প্রত্যন্তত অঞ্চলের মানুষজন যে পুকুরে কাপড়,কাচা ও গোসল করে সেই একই পুকুরের পানি পান করে থাকে।
১৯৯০ সালের পর থেকেই শ্যামনগরে খাবার পানির সংকট শুরু হয়। এর জন্য অপরিকল্পিতভাবে লোনা পানির চিংড়ি চাষ, নদী ভাঙনসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যাগকে করছে উপকুলীয়বাসী।
সাতক্ষীরা জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আমিনুল ইসলাম জানান, সাতক্ষীরাতে সুপেয় পানির সংকট রয়েছে। মিষ্টি পানির বিভিন্ন উৎস নষ্ট হয়ে গেছে। নতুন করে সুপেয় পানির উৎস তৈরি করতে নানা মুখি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। অকেজো নলক’প সমূহ কার্যকর করার চেষ্টা করা হচ্ছে। নতুন নতুন মিষ্টি পানির উৎস তৈরি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে উপকুলীয় জেলা হওয়াতে দিন দিন লবণক্ষতা আর্সেনিক বৃদ্ধি পাচ্ছে। সংকট সমাধান কষ্ট সাধ্য হয়ে পড়ছে। আবু সাইদ বিশ্বাসঃসাতক্ষীরা: