ক্রাইমর্বাতা রির্পোট: নুসরাত জাহান রাফিকে হত্যার মিশনে অংশ নিয়েছিল কারা? কারা তার শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়েছিল? পরীক্ষা কেন্দ্র সংরক্ষিত এলাকা, সেখানে অপরিচিত কারও যাওয়া কি সম্ভব? এলাকাবাসীর মুখে মুখে এখন এসব প্রশ্ন। তাদের কথা পরিচিত বিধায় বোরকার ছদ্মবেশে মাদরাসার ভেতরে প্রবেশ করে সন্ত্রাসীরা। আর নিরাপদে তাদের মিশন শেষে নির্বিঘ্নে বেরিয়ে যায়। এ সময় কেন্দ্রে থাকা নিরাপত্তা বাহিনী কী করছিল? এসব বিষয় এলাকাবাসীকে যেমন ভাবিয়ে তুলেছে তেমন রহস্যেরও জন্ম দিয়েছে। এলাকাবাসীর কথা- যৌন হয়রানির ঘটনায় প্রতিবাদ ও মামলা করায় ফেনীর সোনাগাজীতে মাদরাসা শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে পরিকল্পিতভাবে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। সোনাগাজী সিনিয়র ফাজিল ডিগ্রি মাদরাসায় নুসরাতের সহপাঠী, শিক্ষক ও স্থানীয় বাসিন্দাদেরও একই কথা। স্থানীয়দের ধারণা, ঘটনার আগে পুরো বিষয়টি রেকি করা হয়েছে। আগ থেকে সতর্ক প্রস্তুতির কারণে এমন নির্মম ঘটনা ঘটিয়ে সহজেই পালিয়ে গেছে অপরাধীরা। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন পিবিআই ও জেলা পুলিশও বিষয়গুলো মাথায় রেখে ঘটনার মূল হোতাদের ধরতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
অপরাধীদের পালিয়ে যেতে মাদরাসার ভেতরের কারো সংশ্লিষ্টতা ছিল কিনা সে বিষয়টিও ক্ষতিয়ে দেখা হচ্ছে। নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় আসামি করা হয়েছে অধ্যক্ষ এস এম সিরাজ উদ দোলাহসহ আটজন ও আরো অজ্ঞাতনামা চার জনকে। এদের মধ্যে এজাহারভূক্ত কয়েকজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করলেও এখনো স্পষ্ট হয়নি নুসরাতের গায়ে আগুন দিয়েছিল কারা? এমনকি দগ্ধ হবার পর নুসরাতের ডাইং ডিক্লারেশনে উল্লেখ করা আলোচিত শম্পা চরিত্রেরও কোন কূলকিনারা করতে পারেনি পুলিশ। কোন চার জন নুসরাতকে ডেকে মাদরাসার ছাদে নিয়ে গেছে এবং তারপর আগুন লাগিয়ে পালিয়ে গেছে তাদের নিয়ে জোর গুঞ্জণ আছে এলাকাবাসী ও স্থানীয়দের মধ্যে। অনেকে ধারণা করছেন এজাহারভূক্ত আসামিদের কয়েকজন নুসরাতকে পুড়িয়ে মারার ঘটনায় যুক্ত রয়েছে। তবে রিমাণ্ডে আসামিরা কতটুকু কী বলেছে তাও ক্ষতিয়ে দেখছে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। ঘটনার দিন ৬ এপ্রিল আরবি প্রথম পত্রের পরীক্ষা দিতে ভাই মাহমুদুল হাসান নোমানকে নিয়ে পরীক্ষা কেন্দ্রে যান নুসরাত জাহান রাফি।
এসময় শুধু প্রবেশপত্র ও কলমসহ একটি ফাইল নিয়ে সোনাগাজী সিনিয়র ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসা কেন্দ্রে প্রবেশ করতে দেয়া হয় তাকে। তার ভাইকে কেন্দ্রের গেটে আটকে দেয়া হয়। পরীক্ষায় অংশ নিতে কাগজপত্র নিয়ে নিজের আট নম্বর কক্ষে চলে যান নুসরাত। পরীক্ষা শুরুর আগে সকাল সাতটা থেকে সাড়ে নয়টা পর্যন্ত দাখিল বিভাগের ক্লাস চলে মাদরাসাটিতে। সাড়ে নয়টার দিকে একদিকে আলীম পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষায় অংশ নিতে কেন্দ্রে প্রবেশ করেন। অন্যদিকে ক্লাস শেষে শিক্ষার্থীরাও গেট দিয়ে বেরিয়ে আসেন। স্থানীয়দের ধারণা এ সুযোগটি কাজে লাগায় সন্ত্রাসীরা। তারা বোরকার ছদ্মবেশ কাজে লাগিয়ে নিমিষেই মিশে যায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে। মিশনে অংশ নেয়া বোরকা, হাতমোজা ও চশমা পরা চারজনের কথা উল্লেখ করা আছে মামলার এজাহারে। এদের মধ্যে দুইজনকে নারী হিসেবে উল্লেখ করলেও আরো দু’জন পুরুষ নারীর ছদ্মবেশে নুসরাতের গায়ে আগুন লাগায় বলে ধারণা করা হচ্ছে। এদের মধ্যে নারী একজন নুসরাতকে ডেকে ভবনের ছাদে নিয়ে যান।
মাদরাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগে দায়ের করা মামলায় স্বাক্ষী ও নুসরাতের বান্ধবী নিশাতকে ছাদে মারধর করা হচ্ছে বলে জানান ওই নারী। এ খবর পেয়ে নিজের কাগজপত্র রেখে বান্ধবীকে বাঁচাতে তিনতলার ছাদে চলে যান নুসরাত। সেখানে গিয়ে বোরকা পরা চারজনকে দেখতে পান। এদের মধ্যে দুইজন নুসরাতের সঙ্গে কথা বলেন এবং মামলা তুলে নিতে চাপ দেন। এই দু’জন নারী ছিল বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করেছেন নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান। মামলা তুলে নিতে রাজি না হওয়ায় এক পর্যায়ে নুসরাতের দুই হাত দড়ি দিয়ে পেছনে বেঁধে ফেলে চারজন। পরে কেরোসিন দিয়ে তার শরীরে আগুন লাগিয়ে দেয় তারা। আগুন লাগানোর পর সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে অপরাধীরা। বোরকা পরেই মূল ফটক দিয়ে বের হয়ে যান বলে কেউ কেউ ধারণা করছেন। ঘটনার পরে নুসরাত হত্যা মামলার আসামি উত্তর চর চান্দিয়া গ্রামের আহসান উল্লাহর ছেলে নূর উদ্দিন(২০) বাইরে বের হয়ে এসে ছাদে কেরোসিন ও ম্যাচ দেখতে পেয়েছেন বলে জানান।
পাশাপাশি আগুনের বিষয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য দেন। ঘটনার পর তাকে নানা বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে অসংলগ্ন উত্তরও দেন স্থানীয় অনেককে। এরপর থেকে গা ঢাকা দেন নুর উদ্দিন। ঘটনার দিন সকালে ও আগের দিন রাতে মাদরাসা ও আশপাশের এলাকায় বেশ কয়েকবার সন্দেহজনক ঘুরাফেরা করতে দেখা গেছে নুর উদ্দিনকে। মাদরাসার শিক্ষক ও স্থানীয়রা ধারণা করছেন অধ্যক্ষ এসএম সিরাজ উদ দোলাহর ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত নুর উদ্দিন আগুনের ঘটনায় নেতৃত্ব দিতে পারেন। যৌন হয়রানির মামলায় সিরাজ উদ দৌলাকে গ্রেপ্তারের পর তার মুক্তির দাবিতে সংগ্রাম পরিষদও গড়ে তুলেছিলো নুর উদ্দিন। এছাড়া, ঘটনার আগের রাতে কেরোসিন ও ম্যাচ ভবনের ছাদে নিয়ে যাওয়া হয় বলে জানা গেছে।
পরিকল্পনামাফিক কাজ করতে বৈঠকও করা হয়েছে। মূলত পুরুষ অপরাধীরা ছদ্মবেশ নিতে বোরকা পরলেও পুরুষ হিসেবে শনাক্ত হয়ে যাওয়ার ভয়ে হাতমোজা ও চশমা পরেন। নুর উদ্দিন উচ্চতায় খুব লম্বা না হওয়ায় নারী হিসেবে ছদ্মবেশ নেয়ার সন্দেহের তালিকায় রাখা হয়েছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে বাকি অজ্ঞাত তিনজনের বিষয়েও বিশদ জানা যেতে পারে বলে দাবি নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান সোহাগের। ২০১৭ সালে প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া না দেয়ায় নুসরাতকে চুনের পানি দিয়ে ঝলসে দেন শ্রমিক থেকে অধ্যক্ষের কাছের বনে যাওয়া নুর উদ্দিন। এছাড়া, মামলার আরেক আসামি শাহাদাত হোসেনও এই ঘটনায় জড়িত থাকতে পারে দাবি করেছেন নুসরাতের পরিবার। সোনাগাজী সিনিয়র ফাজিল ডিগ্রি মাদরাসায় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ অনুমোদিত কোন কমিটি না থাকলেও শাহাদাত ছিলেন অধ্যক্ষ সিরাজ ঘোষিত ছাত্রলীগ সভাপতি।
ঘটনার পর থেকে শাহাদাত হোসেনও পলাতক রয়েছে। ঘটনার দিন পরীক্ষার কেন্দ্রে ১৪৪ ধারা থাকলেও এ দুজনের প্রবেশে বাধা ছিল না বলে অভিযোগ করেছেন মাদরাসার পিয়ন নুরুল আমিন। তিনি মানবজমিনকে বলেন, বোরকাপরা চারজনের সঙ্গে নুর উদ্দিন ও শাহাদাতের যোগসাজশ থাকতে পারে। তারা যখন-তখন অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার কক্ষে অবাধে যাতায়াত করতেন। কয়েকজন জানিয়েছেন, ৫ই এপ্রিল রাতে ও পরদিন সকালে নুর উদ্দিন ও শাহাদাতকে মাদরাসার মূল ফটকে দেখা গেছে। তবে ঘটনার সময় পরীক্ষা কেন্দ্রে দায়িত্বরত একজন উপ-সহকারী পরিদর্শক (এএসআই) কেন্দ্রের মূল ফটক ছেড়ে সোনাগাজী জিরো পয়েন্ট এলাকায় সকালের নাশতা করতে যান বলেও অভিযোগ করেছেন কয়েকজন। স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন পুলিশ ঘটনার সময় সতর্ক অবস্থানে থাকলে কেউ এমন অপরাধ করে পালাতে পারতো না। দায়িত্বে অনেকটা গাফিলতি করায় আগুন লাগানোর পরও অপরাধীরা নির্বিঘ্নে পালিয়ে যেতে পেরেছে। একইভাবে ২৭ মার্চের ঘটনার পরে পুলিশ ও প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রতিনিধি দল। তড়িৎ ব্যবস্থা নিলে নুসরাতকে এমনভাবে পৃথিবী ছেড়ে যেতে হতো না বলেও মন্তব্য ছিল প্রতিনিধি দলের। তবে ঘটনার পর বোরকা পরে সন্দেহজনকভাবে কাউকে বের হতে দেখা যায়নি বলে দাবি করেছে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ ও পুলিশের সদস্যরা। সেক্ষেত্রে অপরাধীরা আগুন লাগানোর পর মাদরাসার ভেতরের কারো সহায়তা নিয়ে পোষাক বদল করে উত্তর দিকের সীমানা প্রাচীর পেরিয়ে সহজে পালিয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করছেন তারা।
এদিকে, নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার মামলার তদন্তের দায়িত্বে থাকা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ফেনী জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মনিরুজ্জামান গতকাল মানবজমিনকে বলেন, মামলার তদন্তে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। এজাহারভুক্ত চার জনসহ মোট দশজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। এদের জিজ্ঞাসাবাদ থেকে মূল কিলিংয়ে অংশ নেয়াদের বিষয়েও নিশ্চিত হওয়া যাবে।
আরো দুইজন গ্রেপ্তার: নুসরাত জাহানকে পুড়িয়ে হত্যা মামলার অন্যতম আসামি নুর উদ্দিনকে গতকাল ময়মনসিংহ থেকে ও মকসুদ আলম কাউন্সিলরকে বৃহস্পতিবার ঢাকার ফকিরাপুল এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই। তবে মামলার অপর আসামি শাহাদাতকে এখনও গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। নুসরাত অগ্নিদগ্ধ হওয়ার পর দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হলে নুর উদ্দিন ও শাহাদাত হোসেন ওরফে শামীম গা ঢাকা দেয়। শুরুর দিকে স্থানীয় পুলিশ এদের গ্রেপ্তারের ব্যাপারে উদ্যোগ না নিয়ে বরং এটি আত্মহত্যার চেষ্টা বলে বক্তব্য দিয়েছিল। সে সুযোগে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায় তারা।
পুলিশ-প্রশাসনের গাফিলতি ছিল: জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের অভিযোগ ও তদন্ত বিষয়ক পরিচালক আল মাহমুদ ফয়েজুল কবির বলেছেন, আলোচিত নুসরাত হত্যা মামলার মাস্টারমাইন্ড হলো সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার অধ্যক্ষ মো. সিরাজ উদ দৌলা। তার শুভাকাঙ্খী, সহযোগী ও দোসররা এমন ঘটনা ঘটিয়েছে বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। গতকাল শুক্রবার সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসায় বেশ কয়েকজনের সাক্ষ্য নিয়ে তিনি এসব কথা বলেন। এ সময় তিনি আরো বলেন, ২৭ মার্চের পর যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হলে ৬ এপ্রিলের ঘটনাটি এড়ানো সম্ভব হতো। সেদিনের ঘটনার জেরেই ৬ এগ্রিলের ঘটনাটি ঘটেছে। আল মাহমুদ ফয়েজুল কবির বলেন, নুসরাতের হত্যাকান্ডটি ছিল পূর্বপরিকল্পিত।
২৭ মার্চ ঘটনার পর যদি কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসন সক্রিয় থাকতো তাহলে ৬ এপ্রিলের ঘটনাটি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হতো। এসময় আরো উপস্থিত ছিলেন সোনাগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকতা সোহেল পারভেজ। নুসরাতের চাচা শামীম অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে অনেক আগ থেকে যৌন হয়রানী, চেক জালিয়াতিসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে বলে মানবধিকার কমিশনের কাছে জানান