রাজধানীতে পুলিশের ওপর ‘ককটেল’ হামলার দায় স্বীকার ‘আইএসের’

ক্রাইমর্বাতা রির্পোট:  সোমবার রাতে ঢাকার গুলিস্তানে ককটেল বিস্ফোরণে তিন পুলিশের আহত হওয়ার ঘটনাটি কথিত ইসলামিক স্টেট গ্রুপ ঘটিয়েছে, নাকি এর পেছনে অন্য কেউ জড়িত রয়েছে -তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া সাংবাদিকদের বলেছেন, “সোমবার গুলিস্তানে যে ককটেলটি অনেক শক্তিশালী ছিল। আইএস যে দাবি করেছে, তা পুলিশ খতিয়ে দেখছে।”

সোমবার রাত পৌনে ৮টার দিকে গুলিস্তানের ডন প্লাজার সামনে রাস্তায়দায়িত্ব পালনরতপুলিশ সদস্যদের ওপর ককটেল ছুড়ে মারা হয়। এতে পুলিশের তিনজন সদস্য আহত হন।

তবে জঙ্গিবাদ বিশ্লেষক তাসনিম খলিল বলছেন, “এটি ককটেল বা পটকা ছিল না, বরং এটি ছিল একটি আইইডি বা হাতে বানানো শক্তিশালী বিস্ফোরক।”

ইসলামিক স্টেট গ্রুপের কর্মকাণ্ড নজরদারি করে, যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক সাইট ইন্টেলিজেন্স জানিয়েছে, গুলিস্তানে ওই হামলার দায় স্বীকার করেছে আইএস। হোলি আর্টিজান হামলার পর দুই বছরের মধ্যে তারা আবার ঢাকায় এই হামলা চালালো বলে সংস্থাটি জানিয়েছে।

পাঁচ বছর পর আইএস প্রধান আবু বকর আল-বাগদাদীর নতুন একটি ভিডিও বার্তা প্রকাশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ওই হামলা হয় বলে সাইট ইন্টেলিজেন্স বলছে।

যা বলছেন পুলিশ কর্মকর্তারা
মঙ্গলবার ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া সাংবাদিকদের বলেছেন, সোমবার গুলিস্তানে যে ককটেলটি বিস্ফোরিত হয়েছে, সেটি সাধারণ কোন ককটেল নয়। অনেক শক্তিশালী ছিল। তিনি বলেন “এর সঙ্গে যেই জড়িত থাকুক না কেন, তাকে আইনের আওতায় আনা হবে।”

মঙ্গলবার আহত পুলিশ সদস্যদের দেখতে গিয়ে তিনি ওই মন্তব্য করেন। আহত দুইজন পুলিশ সদস্য হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। আইএস এই হামলার দায় স্বীকার করেছে জানিয়ে তার কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, সেটি তারা খতিয়ে দেখছেন।

“এর সঙ্গে অন্য কেউ জড়িত আছে কিনা, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে.” তিনি জানান।

পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলছেন, ”সারা বিশ্বে উগ্রবাদের যে প্রভাব আছে, বাংলাদেশও তার বাইরে নয়। তবে সংঘবদ্ধ বা বড় ধরণের নাশকতা করার ক্ষমতা তাদের নেই। কখনো কখনো তারা বিছিন্নভাবে এ ধরণের ঘটনা করার অপচেষ্টা করে, সেগুলো আমরা নজরদারিতে রাখছি।”

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, অতীতে নানা জঙ্গি হামলার পেছনে আইএস দাবি করলেও বাংলাদেশে তাদের অস্তিত্বের ব্যাপারটি আগেও তারা পাননি। সেসব দাবির প্রমাণও মেলেনি। বরং স্থানীয় কিছু জিহাদি গ্রুপকে নানা সময় সক্রিয় বলে জানতে পেরেছেন।

ফলে ককটেল হামলাটি আসলে কারা চালিয়েছে, তা তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তারা কোন মন্তব্য করতে চান না।

আরেকজন পুলিশ কর্মকর্তা বলছেন, এর সঙ্গে “জঙ্গি হামলার সংশ্লিষ্টতা নেই, এটি সেখানকার স্থানীয় বিরোধের জেরে ঘটেছে”। এর বেশি তিনি আর কিছু বলতে চাননি।

২০১৬ সালের পহেলা জুলাই ঢাকার গুলশানে হোলি আর্টিজানে হামলায় যে হতাহতের ঘটনা ঘটে, তারও দায় স্বীকার করেছিল আইএস। তবে বাংলাদেশের পুলিশ সেসব ঘটনার জন্য স্থানীয় জঙ্গি গোষ্ঠীকে দায়ী করেছে।

শ্রীলংকায় হামলার পরে বাংলাদেশের ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ও ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেছেন, শ্রীলংকায় জঙ্গি হামলার পরে জঙ্গিবাদের ঝুঁকি কিছুটা বেড়েছে, তারা আরো বেশি উত্তেজিত হয়েছে। তবে তা নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। কিছু হওয়ার মতো অবস্থায় এটি এখনো যায়নি।

মনিরুল ইসলাম বলেছিলেন, “এরা বিচ্ছিন্নভাবে রয়েছে। মানে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। বিচ্ছিন্নভাবে হয়তো সাংগঠনিক শক্তি অর্জনের দিকেই এদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ আছে।”

“একটা বড় হামলা করার জন্য যে ধরনের প্রস্তুতি প্রশিক্ষণ, মনোবল, সর্বোপরি যে পরিমাণ রসদ বা সরঞ্জামাদি দরকার, সেগুলো তাদের কাছে নেই বলে আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে। তবে ছোটখাট ব্যক্তি বিশেষ কোনো কাজ করতে চাইতে পারে, কিন্তু বড় ধরনের হামলার কোনো আশংকা আমরা আপাতত করছি না।”

‘আইএস মতাদর্শী জঙ্গিদের সক্রিয় হয়ে ওঠা উড়িয়ে দেয়া যায় না’
উগ্রবাদী হামলা ও এ জাতীয় ঘটনা পর্যবেক্ষক করেন সাংবাদিক ও লেখক নুরুজ্জামান লাবু।

তিনি বলছেন, যদিও পুলিশ এই ঘটনা সঙ্গে উগ্রবাদী হামলার বিষয়ে কিছু বলতে চান না, তবে মোটরসাইকেলে করে এসে পুলিশের ওপর ককটেল হামলার ঘটনার সঙ্গে আগের উগ্রবাদী হামলাগুলোর অনেক মিল পাওয়া যায়।

“ফলে এখানে আইএসের দাবিকে উড়িয়ে দেয়া যাবে না।”

লাবু বলছেন, শ্রীলংকায় হামলার পরে বাংলাদেশের আত্মগোপনে থাকা উগ্রবাদী সংগঠনগুলো নতুন করে উজ্জীবিত হয়ে উঠতে পারে। তাদের টেলিগ্রাম বা গোপন যোগাযোগের চ্যানেলগুলোতেও সেরকম লক্ষণ দেখা যায়। সুতরাং এরকম হামলা করে তাদের উপস্থিতির জানান দেওয়ার চেষ্টা থাকতে পারে।

তিনি বলছেন, বাংলাদেশে যেসব উগ্রবাদী সংগঠনকে বিভিন্ন নাম দেওয়া হয়েছে, তারা অনেকে আইএস বা আল-কায়েদার মতাদর্শ অনুসরণ করে।

“বিশেষ করে গুলশানে হোলি আর্টিজান হামলার সঙ্গে সঙ্গে যেভাবে তাদের নানা বক্তব্য, ছবি বা ভিডিও আইএসের ওয়েবসাইটে আপলোড হয়েছে, তাতে তাদের সঙ্গে আইএসের সম্পর্কের বিষয়টি পরিষ্কার।”

”ফলে উগ্রবাদী বিরোধী অনেক অভিযান হলেও, এখনো তাদের মতাদর্শী বিশ্বাসী সদস্যদের লুকিয়ে থাকার সম্ভাবনা নাকচ করে দেওয়া যাবে না। তাদের মধ্যে হয়তো শ্রীলংকায় হামলা, আল-বাগদাদীর ভিডিও প্রকাশের পর নিজেদের অবস্থান জানান দেয়ার একটা চেষ্টা করতে পারে।’

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মাহমুদা আকতার বলছিলেন, “পুলিশ বা র‍্যাব অনেকটা এগিয়েছে। কিন্তু আমরা যে পুরোপুরি শংকামুক্ত, এমন নয়।”

“আমরা এখনও উগ্রবাদীদের ধরার অনেক খবর পাই। এই খবরগুলো কিন্তু প্রমাণ করে, উগ্রবাদীদের অস্তিত্ব আছে। উগ্রবাদীরা দূর্বল হয়েছে, কিন্তু তাদের অস্তিত্ব টিকে আছে এটাও সত্য।”

উগ্রবাদ পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষক তাসনিম খলিল তার ফেসবুক পাতায় লিখেছেন, ”বাংলাদেশে আইসিসের নতুন আমীর দায়িত্ব নিয়ে বিভিন্ন গ্রুপগুলোকে নতুন করে ঐক্যবদ্ধ করার উদ্যোগ নেন। চ্যাটার ছিলো যে রমজান মাসে এদের বড় ধরণের হামলার পরিকল্পনা আছে। গতরাতে গুলিস্তানে যে বোমা হামলা হয়েছে এটা তারই প্রিভিউ হয়তো।”

আইএস প্রধান আবু বকর আল-বাগদাদীর নতুন একটি ভিডিও বার্তা
প্রায় পাঁচ বছর পর নতুন প্রকাশিত একটি ভিডিওতে আইএস প্রধান আবু বকর আল-বাগদাদী ঘোষণা দিয়েছেন, আইএসের ভূখণ্ড হারানোর প্রতিশোধ নেওয়া হবে। সিরিয়ার বাঘুজ শহরের পরাজয়ের প্রতিশোধ হিসাবে শ্রীলংকায় ইস্টার সানডের হামলা চালানো হয়েছে বলে তিনি দাবি করেছেন।

যদিও বিবিসির সংবাদদাতা বলছেন, শ্রীলংকায় হামলার পরপরই আইএস যে দাবি জানিয়েছিল, তখন শহরটির কোন উল্লেখ করা হয়নি।

২০১৪ সালের পর এই প্রথম তাকে আবার প্রকাশ্যে কোন ভিডিওতে দেখা গেল। এই ভিডিওতে তাকে বাঘুজের পরাজয়ের কথা স্বীকার করতে শোনা যায়, যে শহরটি ছিল এই গ্রুপের হাতছাড়া হওয়া সর্বশেষ শক্ত ঘাঁটি। আইএসের আল ফুরকান মিডিয়া নেটওয়ার্কে ভিডিওটি প্রকাশ করা হয়। বিবিসি বাংলা।

Check Also

বিএনপি নেতাকর্মীদের জড়িয়ে হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে দেবহাটায় মানববন্ধন

দেবহাটা প্রতিনিধি: স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার দোসর এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও ভূমিদস্যুদের গ্রেফতার এবং বিএনপির …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।