সরকারের বেধে দেয়া দামে সাতক্ষীরায় ধান বিক্রয় হচ্ছে না: দেড় মণ ধানে মিলছে একজন শ্রমিক: ৫ লক্ষ ধান চাষী সর্বশান্ত

আবু সাইদ বিশ্বাসঃ সাতক্ষীরা: সরকারের বেধে দেয়া দামে সাতক্ষীরায় ধান-চাল ক্রয়- বিক্রি হচ্ছে না। এক হাজার চল্লিশ টাকার স্থালে বিক্রি হচ্ছে ৫শ থেকে ৭শ টাকা দরে মণ প্রতি ধান। সিন্ডিকেটের কবল ও খাদ্য গুদামের কর্মকর্তাদের দুর্ণিতির কারণে সাধারণ কৃষক সরকারের বেধে দেয়া দামে এক কেজিও ধান এখনও বিক্রি করতে পারিনি। ফলে হাজার হাজার কৃষক ধানের ন্যার্য মূল্য না পেয়ে ফুঁশে উঠেছে। এছাড়া মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে নেয়া ঋণের টাকা পরিশোধ করতে দিশেহারা হয়ে পড়েছে অনেক চাষীরা। সার,ওষুধ ও ডিজিলের দোকানে হালখাতার টাকা পরিষোধ করতে চাষীরা পানির দরে ধান বিক্রি করছে। শ্রমিক সংকট ও শ্রমমূল্য বৃদ্ধির কারণে ও অনেকে মাঠ থেকে ধান তুলতে পারছে না।

চাষীদের দাবী সময়মতো সার, প্রয়োজনীয় সেচ ও নিড়ানি দেয়াসহ আবহাওয়া অনুকুলে থাকায় চলতি মৌসুমে সাতক্ষীরায় বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে । বিশিষে করে গত কয়েক বছর ধরে কম খরচে মাছের ঘেরে বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। খরচের তুলনায় লাভ বেশি হওয়ায় চাষীরা ধান ও মাছ এক সাথে চাষ করে আসছে। উৎপাদন খরচ বেশি, শ্রমিক সংকট, আকাশে মেঘের ঘনঘটা, অতিরিক্ত মজুরী, আগাম বন্যার শঙ্কা মাথায় নিয়েই জেলায় বোরো চাষীরা ধান আগাম ঘরে তুলতে শুরু করেছে। কিন্তু ধানের বাম্পার ফলন হলেও দাম নিয়ে শঙ্কায় তারা। এদিকে নারী ও পুরুষ শ্রমিকের মধ্যে মজুরি বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করায় শ্রম বৈষম্য নীতিমালা বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
একজন পুরুষ শ্রমিকের সকাল বিকাল দুবেলার শ্রম বিক্রি হচ্ছে ৭শ থেকে ৮শ টাকায়। সেখানে এক মণ মোটা চালের ধান বিক্রি হচ্ছে ৫শ টাকায়। ফলে জেলার প্রায় ৫লক্ষ ধান চাষী সর্বশান্ত হতে চলেছে। জেলার বিভিন্ন এলাকার ধান চাষীদের সাথে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

জেলা কৃষি খামারবাড়ি সূত্র মতে চলতি মৌসুমে জেলাতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭৪ হাজার ৭৩৩ হেক্টর জমিতে।সাতক্ষীরা সদরে ২৩ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে। যা থেকে ধানের উৎপাদন ধরা হয়েছে ৯৬ হাজার ৩৮৮মেঃটন। কলারোয়া উপজেলাতে আবাদ হয়েছে ১২ হাজার ৭৭১ হেক্টর জমিতে। সব ঠিক থাকলে ধান উৎপান হবে ৫০ হাজার ৬৮৫ মেঃটন। তালাতে আবারে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৮ হাজার ৭১৭ হেক্টর জমিতে । যার উৎপাদিত ধানের লক্ষ্য মাত্রা ধরা হয়েছে ৭৭হাজার ২৮১ মেঃটন। দেবহাটাতে আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ হাজার ৮৬০ হেক্টর এবং ধান উৎপাদনের লক্ষ্য মাত্রা ধরা হয়েছে ২৪ হাজার ৩৮২ মেঃটন। কালিগঞ্জ উপজেলাতে আবাদের লক্ষ্য মাত্রা ধরা হয়েছে ৫ হাজার ২৯০ হেক্টর জমিতে যা থেকে উৎপাদিত ধানের পরিমান ধরা হয়েছে ২১ হাজার ৩৬০ মেঃটন। আশাশুনিতে আবাদ হয়েছে ৬ হাজার ৪৬৫ হেক্টর জমিতে যা থেকে উৎপাদিত হবে ২৭ হাজার ১৪৪মেঃটন। অন্যদিকে লোনা অধ্যুষিত শ্যামনগর উপজেলাতে বোরোর আবাদ ধরা হয়েছে ২ হাজার ৩০ হেক্টর জমিতে যা থেকে উৎপাদিত ধানের পরিমান ধরা হয়েছে ৮ হাজার ১৯০ মেঃটন।

বোরো চাষীদের ধানের ন্যার্য মূল্য চলতি মৌসুমে ১২ লক্ষ ৫০ হাজার মে.টন চাল এবং ৫০ হাজার মে.টন গম কেনার সিদ্ধান্ত নেয়েছেন সরকার। এর মধ্যে ১০ লক্ষ মেট্রিক টন সিদ্ধ চাল, ১.৫ লক্ষ মেট্রিক টন আতপ চাল এবং ১.৫ লক্ষ মেট্রিক টন ধান (এক লক্ষ মেট্রিক টন চালের সমপরিমান) সংগ্রহ করা হবে। ৩৬ টাকা দরে সিদ্ধ চাল, ৩৫ টাকা দরে আতপ চাল এবং ২৬ টাকা দরে ধান সংগ্রহ করা হবে। ২৫ এপ্রিল থেকে শুরু হয়ে অভিযান চলবে ৩১ আগস্ট ২০১৯ পর্যন্ত।

সেই হিসাবে এক মণ ধানের দাম ১০৪০ টাকা । কিন্তু সাতক্ষীরাতে মোটা চালের ধান ৫শ টাকা এবং চিকন চালের ধান সর্বোচ্ছ ৭শ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। চাষীরা বলছে সরকারের বেধে দেয়া দামে কেউ ধান কিনছে না। জেলা খাদ্যগুদান কর্তৃপক্ষ বলছে তাদের কাছে কোন কৃষক এখনো ধান বিক্রি করতে আসেনি।

কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা যায় এবছর সাতক্ষীরা জেলাতে বোরো ধানের বিঘা প্রতি উৎপাদন খরচ হয়েছে প্রায় ১৭/১৮ হাজার টাকা। বাজার মুল্যে কৃষকরা বিঘা প্রতি ধানের দাম পান ১৪ -১৫ হাজার টাকা। ফলে বিঘা প্রতি ক্ষতি হচ্ছে ৩-৪ হাজার টাকা।

ফজর আলী (৫০),সাতক্ষীরা শহরের ৫নং ওয়ার্ডের মিয়াসাহেবের ডাঙ্গা গ্রামের কৃষক। তার সাথে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তিনি এবছর দুই বিঘা জমিতে বোরো ধানের আবাদ করেছে। ধানের বাড়ন ও ভাল। তার হিসাব মতে,বিঘা প্রতি তার উৎপাদন খরচ দাঁড়াবে ১৮ হাজার টাকা । এর মধ্যে বিঘা প্রতি বীজতলা তৈরিতে খরচ হয়েছে ২ হাজার টাকা। ১০ কেজি বীজ,সার পানি, পাতা উঠানো জমিতে তিন চাষ তিন হাজার টাকা,রোপন এক হাজার টাকা,সার ওষধ, আগাছা দমন,ওষধ স্প্রে তিনশ টাকা, ধান কাটা ১৭শ টাকা,বহন-ঝাড়া ১৫শ টাকা,জমির হারি ছয় হাজার টাকা,পানি সরবরাহের জন্যে তিন হাজার টাকা তাকে দিতে হবে। তার এক বিঘা জমিতে চিকন চালের ধান ১৮ মন এবং মোটা চালের ধান ২০ মণ উৎপাদন হয়েছে। সাতক্ষীরাতে মোটা চালের ধানের বর্তমাণ দাম মণ প্রতি ৫শ টাকা। সেই হিসাবে ২০ মণ ধান বিক্রি হবে ১০ হাজার টাকায়। ফলে তার ক্ষতি প্রায় ৭ থেকে ৮ হজার টাকা। অন্যদিকে চিকন চালের ধান জেলাতে বিক্রি হচ্ছে মণ প্রতি ৭শ টাকায়। ফলে ১৮ মণ ধানের দাম ১২হাজার ৬শ টাকা।
এত ক্ষতির পরও কেন তিনি ধান লাগান এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, জমি নিজের, পানির ম্যাশিন নিজের,শ্রমিক নিজেই তাই বেশির ভাগ পরিশ্রম তার শরীরের উপর দিয়ে হয়ে গেছে। অর্থনৈতিক ভাবে বিঘা প্রতি ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা খরচ করতে হয়েছে তার। তাই লাভ থাকবে বলে তার আশা।
জমির মালিকদের অভিযোগ উৎপাদন খরচ বেশি হওয়াতে জমির প্রকৃত মালিকরা ধান চাষ করেনা। তারা জমি চুক্তি ভিত্তিক হারি দেয় কৃষকদের কাছে।
প্রান্তীক চাষীরা বলছে, ইংরেজ আমলে যে ভাবে জমিদাররা এদেশে কৃষখদের শোষণ করতো তেমনি একটি পরিবেশ বর্তমানে কৃষিতে বিরাজ করছে। কৃষকরা সারা বছরই মাহজনদের জমি হারি নিয়ে উৎপাদন করলে ও তারা লাভের মুখ দেখছে না।
এরই মধ্যে দেশে এবারও বর্ষার আগেই আগাম বন্যার শঙ্কা প্রকাশ করছেন আবহাওয়াবিদরা। বিষয়টি সম্পর্কে সতর্ক করে কৃষি ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এর ভিত্তিতে কৃষি মন্ত্রণালয় ৭৫ ভাগ ধান পাকলেই কেটে ফেলতে বলছে।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক অরবিন্দু বিশ্বাস জানান, তাদের নিয়মিত পরামর্শ ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবছর জেলাতে বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। দাম নিয়ে অসুন্তষ্ট থাকলেও কৃষকরা খুশি। এছাড়া সরকারের দেয়া নির্ধারিত দামে কৃষকদের কাছ থেকে ধান ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য তারা চেষ্টা করছে।

Check Also

যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার

নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।