জেলায় কৃষকের বোবা কান্না: শ্রমিকের মজুরি পরিশোধে হিমশিম!

মনিরুল ইসলাম মনি: প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ বিভিন্ন প্রতিকুলতার মধ্যে জেলাব্যাপী বোরো ধান কাটা ও অধিকাংশ ধান মাড়াই শেষ করেছে। তবে, বাজারে ভালো দাম না পাওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছে জেলার প্রান্তিক চাষীরা। চলতি বছর ধানের বাম্পার ফলন হলেও ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়ে শ্রমিকের মুজুরী, সমিতি (এনজিও) ও সারের দোকানসহ মহাজনের টাকা দিতে পারছেন না। এমনকি দুই মণ ধান বিক্রি করে তিনজন শ্রমিকের মজুরীর টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে এসব প্রান্তিক কৃষকদের।

এদিকে গত কয়েকদিনে জেলার বিভিন্ন ধানের বাজারে অস্বাভাবিক দরপতনের ঘটায় দিশেহারা হয়ে পড়েছে ধান চাষীরা। কৃষকদের দাবি, সরকার গত ২৫ এপ্রিল থেকে ২৬ টাকা কেজি দরে কৃষকদের নিকট থেকে ধান ক্রয়ের তারিখ নির্ধারণ করলেও চলতি সপ্তাহে (মে মাসে) জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান উদ্বোধন করা হয়েছে। যদিও প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের কারণে এখনো খাদ্য গুদামগুলিতে ধান ক্রয় শুরু হয়নি। ক্ষোভ প্রকাশ করে কৃষকরা বলেন, দেনা পরিশোধ করতে আমারা ধান কম দামে বাজারে বিক্রি দিয়েছি। কিন্তু যারা সরকার নির্ধারিত মূল্যে খাদ্য গুদামগুলিতে ধান বিক্রয় করবেন তাদের পরিচয় কি কৃষক? নাকি কৃষকের মুখের হাসি কেড়ে নেয়া প্রাভবশালী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। এবিষয়ে তারা উর্ধতন কতৃপক্ষের নিকট সঠিক তদন্তের দাবি জানান।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকার গত ২৫ এপ্রিল থেকে ২৬ টাকা কেজি প্রতি দরে কৃষকদের নিকট থেকে বোরো ধান ক্রয় কার্যক্রমের তারিখ নির্ধারণ করলেও চলতি মে মাসে (গত সপ্তাহে) জেলার বিভিন্ন স্থানে ধান-চাল ক্রয় উদ্বোধন করা হয়। তবে সরকার নির্ধারিত তারিখের ২১ দিন পেরিয়ে গেলেও উপজেলা খাদ্য গুদামগুলিতে ধান ক্রয় শুরু হয়নি। এ কারণে বাজারে ধানের অস্বাভাবিক দরপতনের ঘটনা ঘটেছে। আর এ সুযোগে প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা মিলারদের সাথে সিন্ডিকেট করে বাজার থেকে কম দামে ধান কিনে গুদামগুলিতে সরকার নির্ধারিত দরে বিক্রি করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে একাধিক কৃষক অভিযোগ করেছেন।
সদর উপজেলার ঝাউডাঙ্গা ইউনিয়নের কৃষক মনিরুল, জাফর আলী, জাহিদুর রহমান, দেবহাটার আব্দুল আলীম, তালার ইকবাল হোসেন, শাহিনুর, কলারোয়ার আনোয়ার, খোরশেদ জানান, সরকার নির্ধারিত এক কেজি ধানের মূল্য ২৬ টাকা, সে হিসেবে এক মণ (৪০ কেজি) ধানের মূল্য ১০৪০ টাকা। কিন্তু বর্তমান বাজারে প্রকারভেদে ধান বিক্রি হচ্ছে ১৬ থেকে ১৭ টাকা কেজি দরে (এক মণ ৬৪০ থেকে ৬৮০ টাকা)। তাদের অভিযোগ, প্রান্তিক কৃষকদের প্রতি মণ ধানে ৩৬০ থেকে ৩৮০ টাকা লোকসান হচ্ছে। অথচ বাজারে সিন্ডেকেটকারীরা কম মূল্যে ধান কিনে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এসব কৃষকদের দাবি, প্রতি বছর প্রভাবশালী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট সদস্যরা জেলা ও উপজেলা খাদ্যগুদাম কর্মকর্তাদের মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে ম্যানেজ করে গুদামে ধান বিক্রি করে কয়েক লাখ টাকা লাভবান হচ্ছেন।
কৃষক মনিরুল বলেন, এ বছর দুই মণ ধান বিক্রি করে তিন জন শ্রমিকের (ধান কাটা) মুজুরী দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া সমিতি (এনজিও) ও সারের দোকানসহ বিভিন্ন দেনা পরিশোধ করতে ফসল ফলানো ধানের জমি বিক্রি করতে হবে। কৃষক খোরশেদ বলেন, ধান উৎপাদনের খরচ যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে সে হারে বাড়ছে না উৎপাদিত ফলানো ধানের দাম। আমরা ধান চাষ করে সংসার চালায়, ধান উঠানোর সাথে সাথেই তা বিক্রি করে ধার-দেনা শোধ করতে হয়, এবছর ধানের বাম্পার ফলন হওয়ায় কৃষকের মুখে হাসি ফুটলেও শেষ সময়ে সঠিক দাম না পাওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। তিনি আরো বলেন, এই ধান বিক্রি করে দোকান থেকে নেয়া সার, বীজ, কীটনাশক, মাঠের পানিসহ সব কিছুর দাম পরিশোধ করতে হবে। এছাড়া নিজেদের বছরের খোরাক তো রয়েছে। কিন্তু বাজারে ধানের দরপতনে কৃষি জমি বিক্রি করে এসব দেনা পরিশোধ করতে হবে। কৃষক আব্দুল আলীম বলেন, বোরো আবাদ করে যে টাকায় ধান বিক্রি করেছি তাতে শুধু শ্রমিকের মুজুরী দিতে পেরেছি। আর বাকি কিছু টাকা আছে এই দিয়ে সার, ডিজেলের দোকানে অল্প কিছু দেনা দিতে পারবো। কান্না জড়িত কন্ঠে তিনি বলেন, আমরা কষ্ট করে ফসল ফলাবো আর লাভবান হবে প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা। আর কয়েক দিন পর দেশব্যাপী ঈদের আনান্দ শুরু হবে কিন্তু প্রান্তিক কৃষকের পরিবারের বোবা কান্না কেউ দেখতে পায় না। তিনি আগামী মৌসুমে আর ধানের আবাদ না করে তরকারি বা অন্য কোন ফসলের আবাদ করবেন বলে জানান। সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আমজাদ হোসেন জানান, কৃষি অফিসের কার্ডধারী প্রান্তিক কৃষকদের তালিকা সম্পন্ন শেষ পর্যায়ে রয়েছে। ১/২ দিনের মধ্যে এ তালিকা খাদ্যগুদামে পাঠানো হবে।
এ বিষয়ে সাতক্ষীরা জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. জাকির হোসেন জানান, সরকার নির্ধারিত মূল্যে ধান ও চাল ক্রয় অভিযান শুরু হয়েছে। উপজেলা কৃষি অফিসের তালিকা অনুযায়ী কৃষকরা তাদের ধান নির্ধারিত মূল্যে খাদ্য গুদামে বিক্রি করতে পারবেন।

Check Also

আশাশুনির খাজরা ইউনিয়নের খালিয়া রাস্তার বেহাল দশা।। বিপত্তিতে শতাধিক পরিবার।।দ্রুত সংস্কার দাবি 

এস,এম মোস্তাফিজুর রহমান,আশাশুনি।।আশাশুনি উপজেলার খাজরা ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ড খালিয়া গ্রামের সানাপাড়ার প্রায় শতাধিক পরিবার একটি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।