এইচ এম আকতার: সোনালী ধান যেনো কৃষকের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতি মণ ধানে কৃষকের লোকসান হচ্ছে ৪৪০ টাকা। ন্যার্য্য মূল্য না পাওয়ার আশঙ্কা আর শ্রমিকের মজুরি বেশি হওয়ায় ধান ঘরে তুলছে না কৃষক। পাকা ধান ক্ষেতে আগুন দিয়ে অভিনব কায়দায় প্রতিবাদও করছে কৃষক। কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান না কেনায় সরকার নির্ধারিত মূল্যও পাচ্ছে না কৃষকরা। গত দুই বছরের আমদানি করা চাল গোডাউনে থাকায় নতুন করে ধান কিনতে পারছে না মিল মালিকরা। তাহলে কি হবে এতো ধান চালের। প্রশ্ন হলো কার স্বার্থে এখনও আমদানি হচ্ছে চাল।
দেশে এখন চাহিদার তুলনায় বেশি ধান-চাল রয়েছে। উৎপাদন খরচের প্রায় অর্ধেক দামে ধান বেচতে হচ্ছে কৃষককে। অথচ খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে সরকারি-বেসরকারিভাবে গত ১০ মাসে ২ লাখ টন চাল আমদানি হয়েছে। আমদানির অপেক্ষায় রয়েছে আরও ৩ লাখ ৮০ হাজার টন চাল। অতিরিক্ত ধান উৎপাদন তার ওপর চাল আমদানি। তাহলে কি হবে এতো ধান চালের।
২০১৭ সালের মে মাসে হাওরে আগাম বন্যায় ফসলহানির পর সরকার চালের আমদানি শুল্ক উঠিয়ে দেয়। সরকার থেকে বলা হয়েছিল, এই ক্ষতির ফলে ঘাটতি হবে ১০ লাখ টন চালের। কিন্তু গত দুই বছরে দেশে প্রায় ৬০ লাখ টন চাল আমদানি হয়েছে। আমদানি করা এসব চালের অধিকাংশই এখনও অবিক্রীত রয়ে গেছে। আর এ কারণেই মিলারদের গোডাউনে ধান রাখার কোন জায়গা নেই।
গত নবেম্বরে সরকার ২৮ শতাংশ আমদানি শুল্ক পুনর্বহাল করে। এতে চাল আমদানি কমলেও বন্ধ হয়নি। বাড়তি উৎপাদন ও আমদানির চাল বাজারে চাপ তৈরি করছে। ফলে দাম নিয়মিত কমছে। ধানের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় বিপদে পড়েছেন কৃষকেরা। এ নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ-কর্মসূচিও পালিত হচ্ছে।
ধানের ন্যায্যমূল্য দাবিতে এবার রংপুরে মহাসড়কে ধান ছিটিয়ে প্রতিবাদ করেছেন কৃষকরা। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে রংপুর নগরের মাহীগঞ্জ সাতমাথা এলাকায় রংপুর-কুড়িগ্রাম মহাসড়কে এ প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করা হয়। এসময় তারা মানববন্ধন ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন।
প্রতিবাদ কর্মসূচি থেকে ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা, সরকারি উদ্যোগে হাটে হাটে ক্রয়কেন্দ্র খুলে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনে নেয়ার দাবি জানান। কৃষক সংগ্রাম পরিষদ নামে একটি সংগঠন এই প্রতিবাদী কর্মসূচির আয়োজন করে।
কৃষকরা দুঃখ করে বলেন, এক বিঘা ধান উৎপাদনে খরচ পড়ছে ৯ থেকে ১০ হাজার টাকা। আর বিঘাপ্রতি উৎপাদিত ফসল বিক্রি করে পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ৬-৭ হাজার টাকা। এতে করে প্রতি বিঘায় ধান উৎপাদনে লোকসান প্রায় তিন হাজার টাকা। এতে করে কৃষকদের লাভ তো দূরের কথা মহা-লোকসানে পড়তে হচ্ছে।
কৃষকদের অভিযোগ, এক মণ ধানের দামে ধান কাটার একজন শ্রমিককে কাজে নিতে হয়। শ্রমিকের চড়া মজুরির কারণে জমি থেকে ধান কেটে ঘরে তুলতে পারছেন না কৃষক। ধার-দেনা করে কৃষকদের ধান কেটে ঘরে তুলতে হচ্ছে। এর আগে বোরো ধানের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় ধানক্ষেতে আগুন দিয়ে প্রতিবাদ জানান কৃষকরা। টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এই প্রতিবাদ জানান চাষিরা।
সরকারি-বেসরকারি হিসাব বলছে, দেশে ২৫ থেকে ৩০ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত রয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে এই বাড়তি চাল রপ্তানির বিষয়টিও বিবেচনা করা হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে কেন দেশে চাল আমদানি হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, মূলত উদ্বৃত্ত চালের কারণেই ধানের দাম বাড়ছে না। ১০-১৫ দিনের মধ্যে বোরো ধান পুরোপুরি কাটা হয়ে যাবে। এর মধ্যে যদি দেশে কোনো দুর্যোগ না হয়, তাহলে সরকার চাল রপ্তানির সিদ্ধান্ত নেবে। এতে ধানের দাম বাড়তে পারে।
সরকার যেখানে চাল রপ্তানির চিন্তা করছে, সেখানে কেন চাল আমদানি হচ্ছে, এর কারণ জানতে চাইলে কৃষিমন্ত্রী বলেন, দেশের পাঁচ তারকা হোটেলে ও ধনীরা সুগন্ধি-সরু চাল খেতে পছন্দ করে। তাদের প্রয়োজনে এসব চাল আমদানি হতে পারে। তবে আমদানি বেশি হয়ে গেলে তা নিয়ন্ত্রণে সরকার আমদানি শুল্ক ২৮ শতাংশ থেকে আরও বাড়ানোর কথা চিন্তা করবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৩-১৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশে যত চাল বিদেশ থেকে আনা হয়েছে, তার আমদানি মূল্য ছিল টনপ্রতি ৮০০ থেকে ১ হাজার ডলার। অথচ এ সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে চালের গড় মূল্য ছিল টনপ্রতি প্রায় ৫০০ ডলার। ওই বাড়তি টাকা দেশ থেকে পাচার হয়েছে বলে সিপিডির প্রতিবেদনে ইঙ্গিত করা হয়।
এ ব্যাপারে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সরকারের উচিত হবে ধান-চালের সংগ্রহ দ্রততর করা ও সংগ্রহের পরিমাণ বাড়ানো। এতে ধানের বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। আর আমদানি বন্ধে শুল্কের পরিমাণ আরও বাড়ানো যেতে পারে। চাল আমদানির নামে দেশ থেকে অর্থ পাচার হচ্ছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা উচিত।
সরকার এ বছরের মে মাস থেকে ১৩ লাখ টন ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্য ঠিক করেছে। চলবে তিন মাস। মে মাসের অর্ধেক পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত ১ হাজার ২৬৯ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহ হয়েছে। বেশির ভাগ চালকলমালিক বাজার থেকে ধান কেনা শুরুই করেননি। কুষ্টিয়া, দিনাজপুর, রংপুর, নওগাঁসহ বেশির ভাগ বড় মোকামে ধান-চাল কেনা প্রায় বন্ধ রয়েছে। চালকলমালিক ও ব্যবসায়ীদের কাছে থাকা পুরোনো চাল তাঁরা সরকারি গুদামে দিচ্ছেন।
অন্যদিকে বোরো ধান কাটা শুরু হওয়ার এই সময় দেশের ১৬ হাজার চালকলের প্রায় সবই চালু থাকে। কিন্তু বর্তমানে চালু রয়েছে প্রায় ১ হাজার চালকল। কারণ হিসেবে চালকলমালিকেরা বলছেন, তাঁদের কাছে থাকা পুরোনো চালই বিক্রি হয়নি। ফলে তাঁরা আর নতুন করে ধান কিনছেন না।
সরকারি সংগ্রহের কোনো প্রভাব ধান-চালের দামের ওপরে না পড়ার কারণ হিসেবে অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, সরকার মূলত কেনে চাল আর তা চালকলমালিকদের কাছ থেকে নেয়। চালকলমালিকেরা ফড়িয়াদের মাধ্যমে কৃষকদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করে। সরকার প্রতিবছর ১৩ লাখ টন ধান কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি কেনার ঘোষণা দেয়। কিন্তু কোনো সময়ই তা কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি কেনা হয় না। ফলে সব সময় বড় কিছু চালকলমালিক ধান-চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবিষয়ক সংস্থা ইউএসডিএ চলতি মাসে বিশ্বের দানাদার খাদ্যের বৈশ্বিক উৎপাদন পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা গেছে, গত এক বছরে বাংলাদেশে চালের উৎপাদন বেড়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। এ বছর উৎপাদন হতে পারে ৩ কোটি ৫৩ লাখ টন চাল, যা বিশ্বের প্রধান ধান উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে দেশে এ বছর বোরো মৌসুমে ১ কেজি চাল উৎপাদনে ৩৬ টাকা খরচ পড়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয় ১০ লাখ মেট্রিক টন সেদ্ধ চাল, দেড় লাখ মেট্রিক টন আতপ চাল এবং দেড় লাখ মেট্রিক টন ধান সংগ্রহ করবে। কেজিপ্রতি ৩৬ টাকা দরে সেদ্ধ চাল, ৩৫ টাকা দরে আতপ চাল এবং ২৬ টাকা দরে ধান সংগ্রহ করা হবে। এহিসেবে এক মণ ধানের দাম হয় ১০৪০ টাকা। কিন্তু বর্তমানে বাজারে এক মণ ধান বিক্রি হচ্ছে ৬০০ টাকায়। এতে করে প্রতি মণ ধানে কৃষকের লোকসান হচ্ছে ৪৪০ টাকা। গত ২৫ এপ্রিল থেকে শুরু হয়ে ধান-চাল সংগ্রহ চলবে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত। অর্থাৎ চালের সংগ্রহ মূল্যেই কৃষকের জন্য কোনো লাভ ধরা হয়নি।