মিসরের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে চিকিৎসা দিতে অবহেলার মাধ্যমে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী হত্যা করেছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
তার স্বজন ও বন্ধুরা বলছেন, সোমবার কায়রোর আদালতে শুনানির ফাঁকে তিনি ধপ করে মাটিতে পড়ে গেলে পুলিশ যথেষ্ট দ্রুততার সঙ্গে তার প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারেনি। ব্রিটিশ গণমাধ্যম ইন্ডিপেন্ডেন্টের খবর এমন তথ্যই দিয়েছে।
তবে মিসরীয় অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তারা জানায়, তাকে জলদি হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। পরবর্তী সময়ে সেখানে তিনি মারা গেছেন বলে জানানো হয়।
অভিযোগে বলা হয়, পড়ে যাওয়ার পর কারাকক্ষের খাঁচার চত্বরে ২০ মিনিটেরও বেশি সময় ৬৭ বছর বয়সী এই মুসলিম ব্রাদারহুড নেতাকে অবহেলায় ফেলে রেখেছিল কারাপ্রহরীরা। যদিও এসময় বিবাদীরা সাহায্য চেয়েছিলেন।
ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও লিভার রোগে ভুগছিলেন মুরসি। বিদেশি শক্তি ও জঙ্গি গোষ্ঠীকে সহায়তার অভিযোগের পুনর্বিচারের শুনানিতে কথা বলার পর তিনি আকস্মিক মাটিতে পড়ে যান।
ধারনা করা হচ্ছে, তিনি হৃদরোগে মারা গেছেন। দেশটির সাবেক এই ইসলামপন্থী প্রেসিডেন্টের মৃত্যু ও আটকাবস্থা নিয়ে একটি স্বাধীন তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ ও মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো।
২০১৩ সালে মিসরের প্রথম গণতান্ত্রিক এই প্রেসিডেন্টকে সেনা অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে। মৃত্যুর পরপরই খুবই দ্রুত ও গোপনীয়তার সঙ্গে তার দাফন শেষ করা হয়েছে।
তার পরিবার অনুরোধ করেছিল নিজ জেলা শারকিয়াতে যাতে তাকে কবর দেয়া হয়। কিন্তু সে অনুরোধ অগ্রাহ্য করে রাজধানীর পূর্ব দিকের উপশহর নাসরে তাকে চিরশায়িত করে প্রশাসন।
জানাজায় তার পরিবার সদস্য ও আইনজীবীদের হাতে গোনা কয়েকজন সদস্যকে অংশ নিতে দেয়া হলেও ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন তাদের দেখতে দেয়া হয়নি।
সোমবারে মুরসির পাশাপাশি আবদুল্লাহ আল হাদ্দাদের বাবা ও ভাইয়েরও বিচার চলছিল। তিনি বলেন, প্রত্যক্ষদর্শীরা তাকে জানান-মুরসি পড়ে গেলে সাহায্যের জন্য কেউ এগিয়ে যায়নি।
‘প্রহরীরা তাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি মাটিতেই পড়ে ছিলেন। আধঘণ্টা পর একটা অ্যাম্বুলেন্স আসে। অন্যান্য বন্দিরা তাকে পড়ে যাওয়া অবস্থায় দেখলে চিৎকার করতে থাকেন।’
হাদ্দাদ বলেন, আটকদের মধ্যে কয়েকজন চিকিৎসক ছিলেন। প্রহরীদের কাছে তারা অনুরোধ করেন-যাতে মুরসির চিকিৎসা করতে তাদের সুযোগ দেয়া হয় কিংবা তার প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়।
‘তিনি পড়ে যাওয়ার পরে যে অবজ্ঞা করা হয়েছে, তা ছিল ইচ্ছাকৃত। আটক ব্যক্তিরা চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করলে কারাপ্রহরীরা প্রথমে যে কাজটি করেছে, পরিবার সদস্যদের কারাকক্ষের বাইরে নিয়ে গেছে।’
তিনি বলেন, বাবার কথা ভেবে আমার ভয় হচ্ছে। আটক হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত চারবার হার্ট অ্যাটাক হলেও তাকে অস্ত্রোপচার করতে দেয়া হয়নি।
মুরসির পরিবারের সঙ্গে কথা বলা বিবাদীদের এক পারিবারিক বন্ধুর তথ্যের সঙ্গেও হাদ্দাদের বক্তব্য মিলে গেছে। কিন্তু নিরাপত্তার জন্য তিনি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক।
এক অ্যাকটিভিস্ট বলেন, মুরসি কথা বলা বন্ধ করার ১০ মিনিট পর কারাকক্ষের খাঁচার দেয়ালে আঘাত করতে শুরু করেন বন্দিরা। চিৎকার করে বলতে থাকেন-তিনি অচেতন হয়ে পড়েছেন। তার সাহায্য দরকার।
‘সেখানে অবস্থান করা পরিবারগুলো আমাকে বলেন-অন্তত ২০ মিনিটের বেশি সময় ধরে পুলিশ কোনো উদ্যোগ নেয়নি। তাকে সেখানেই ফেলে রাখা হয়।’
তিনি বলেন, এরপর পরিবারগুলোকে কারাগারে বাইরে নিয়ে যায় পুলিশ। তখন অ্যাম্বুলেন্স চলে এসেছে।
মুরসির শাসনামলের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বিষয়ক মন্ত্রী আমর দারাংয়ের বক্তব্যেও একই চিত্র পাওয়া গেছে।
তিনি বলেন, খাঁচার চত্বরে অচেতন অবস্থায় আধাঘণ্টা যাবত পড়েছিলেন দেশটির সাবেক এই প্রেসিডেন্ট। এছাড়া কারাগারে মুরসিকে যথাযথ চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়নি।
তুরস্ক থেকে ইন্ডিপেন্ডেন্টকে তিনি বলেন, ১০ জনেরও কম লোককে তার জানাজায় অংশ নিতে সুযোগ দেয়া হয়। তার মরদেহের স্বাধীনভাবে কোনো পরীক্ষা নিতে দেয়া হয়নি।
এসব অভিযোগ নিয়ে কথা বলতে চাইলে মিসরীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে ঘটনার সরকারি বিবরণে বলা হয়েছে, মাটিতে পড়ে যাওয়ার পরপরই মুরসিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
মুরসিকে চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত করার অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে মিসরের স্টেট ইনফরমেশন সার্ভিস(এসআইএস) একটি আলাদা বিবৃতি দিয়েছে। তারা বলছে, তাকে চিকিৎসা সেবা নেয়ার সুযোগ দেয়ার আবেদন আদালত গ্রহণ করেছেন।
তার মৃত্যুকে ভয়াবহ আখ্যা দিলেও প্রত্যাশিত বলে মন্তব্য করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। মানবাধিকার সংস্থা বলছে, তোরা কারাগারে নোংরা কক্ষের চত্বরে মুরসিকে ঘুমাতে বাধ্য করা হয়েছিল। আটকাবস্থায় যথাযথ চিকিৎসার অভাবে তার শরীরে ডায়াবেটিস প্রাণঘাতী রূপ নিয়েছিল।
মুরসিকে যদি জরুরি চিকিৎসা দেয়া না হয়, তবে কারাগারেই তিনি মারা যেতে পারেন বলে গত বছর ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য ও আইনজীবীদের একটি গোষ্ঠী হুশিয়ারি করে প্রতিবেদন দিয়েছিল।
ব্রিটিশ পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির সাবেক প্রধান ক্রিসপিন ব্লান্টের নেতৃত্বে ওই প্যানেল মত দিয়েছিল, মিসরের সাবেক এই প্রেসিডেন্ট সম্ভবত নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। কংক্রিটের নির্জন বন্দিশিবিরে তাকে দিনের ২৩ ঘণ্টা আটক রাখা হয়েছিল।
পতন হওয়া একনায়ক হোসনি মোবারকের সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী আহমেদ শফিককে পরাজিত করে ২০১২ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন মুরসি। তার শাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের পর ক্ষমতার আসার বছরখানেক পর তাকে অপসারণ করা হয়েছে।
২০১৩ সালে আটক হওয়ার পর অন্তত পাঁচ মাস তাকে নিরুদ্দেশ রাখা হয়েছে। এ সময় ব্রাদারহুড ও তার সমর্থকদের প্রতি নৃশংস ধরপাকড় চালায় দেশটির সেনাবাহিনী। শত শত লোককে হত্যা ও হাজার হাজার জনকে কারাবন্দি করা হয়।
২০১৩ সালের নভেম্বরের আগে তাকে জনসমক্ষে হাজির করা হয়নি। তখন বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা উসকে দেয়া, ২০১১ সালে জেলখানা ভেঙে মুক্ত হওয়া এবং গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে তাকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়।