ক্রাইমর্বাতা রিপোর্ট: কায়রোর ভয়াবহ কুখ্যাত কারাগারটির সাবেক ওয়ারর্ডেন বলেছেন, ওই কারাগারটির নকশা এমনভাবে করা হয়েছে, যাতে কেউ এটিতে একবার ঢুকলে মৃত্যু ছাড়া বের হতে না পারেন।
মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির বেলায়ও তেমনটি ঘটেছে। তার বিরুদ্ধে চলা গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগের দীর্ঘ বিচারের সর্বশেষ অধিবেশনে শব্দপ্রতিরোধী গ্লাসের বক্সের ভেতর তিনি আকস্মিক পড়ে যান।
দেশটিতে প্রথম কোনো গণতান্ত্রিক নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ২০১২ সালে প্রেসিডেন্ট হন মুরসি। পরে বছর খানেক দায়িত্ব পালনের পর তাকে এক রক্তক্ষয়ী সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে।
যারা তাকে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করেছিল, সেই রাষ্ট্রযন্ত্রের কারাগারেই তিনি মারা গেলেন।
গত বছর মার্চে ব্রিটেনের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও পার্লামেন্ট সদস্যদের একটি প্যানেলের সভাপতিত্ব করেছিলাম আমি। ড. মুরসির আটকাবস্থা নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়েছিল সেখানে।
মুরসির শারীরিক অবস্থা নিয়ে তার পরিবার ও অন্যান্যদের কাছ থেকে যেসব নথি আমরা পেয়েছিলাম, তার ওপর ভিত্তি করে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে তিনি পর্যাপ্ত চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন না। বিশেষ করে তার ডায়াবেটিস ও লিভার রোগের নিয়ন্ত্রণ অপর্যাপ্ত।
একজন বন্দি হিসেবে তার শরীরের এসব সমস্যা নিয়ন্ত্রণের নিশ্চয়তা দেয়ার দায়িত্ব ছিল মিসরীয় কর্তৃপক্ষের। তাকে পর্যাপ্ত চিকিৎসাসেবা নেয়ার সুযোগ দেয়া উচিত ছিল তাদের।
কিন্তু ছয় বছর আগে আটকের পর থেকে তাকে নির্জন কারাবাসে রাখা হয়েছিল। বাইরের দুনিয়া থেকে তাকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছিল।
চিকিৎসক কিংবা আইনজীবীদের তার কাছে যেতে দেয়া হয়নি। এতগুলো বছরে মাত্র তিনবার পরিবারের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি।
এই মর্মান্তিক অবস্থার মধ্যে তার শরীরের ওজন কমে যায়। এতে শারীরিকভাবে তিনি দুর্বল হয়ে পড়েন এবং তার ডায়াবেটিস প্রাণঘাতী রূপ নেয়।
তবে মুরসির স্বাস্থ্য নিয়ে আমরা যে পর্যালোচনা দিয়েছিলাম, মিসরীয় প্রতিনিধি পরিষদের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটি তার প্রতিবাদ জানিয়েছিল। কিন্তু ড. মুরসির আটকাবস্থা নিয়ে কোনো স্বাধীন পর্যালোচনা তারা দেয়নি।
মুরসির আটকাবস্থা এমন ছিল যে নির্যাতনের অপরাধে প্রেসিডেন্ট সিসির দায়ী হওয়া উচিত। এটা এমন এক অপরাধ, যেটা আন্তর্জাতিক বিচার ব্যবস্থার আওতায় পড়ে।
ইতিমধ্যে তিনি কয়েক হাজার লোককে হত্যার ঘটনায় দায়ী। ২০১৩ সালে যখন তিনি কায়রোর চত্বর খালি করে ক্ষমতায় আসেন, তখন থেকেই বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের ঘটনা অব্যাহত রয়েছে।
সাম্প্রতিক একটি হিসাব বলছে, মিসরের কারাগারে অন্তত ছয় হাজার বন্দি পচে মরছেন।
এটা আমাদের পর্যালোচনার সময় যেমন পরিষ্কার হয়েছিল, তেমনি বিষয়টি এখনো পরিষ্কার যে ড. মুরসির প্রতি যে আচরণ করা হয়েছে, মিসরীয় বন্দিদের প্রতি নির্যাতনের প্রতিফলনই তাতে স্পষ্ট হয়েছে।
২০১৬ সালে মিসরীয় মানবাধিকারবিষয়ক জাতীয় কমিটি জানিয়েছে, সর্বোচ্চ নিরাপত্তাবেষ্টিত স্কোরপিয়ান-তোরা কারাগারে পরিকল্পিতভাবে চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত করা কিংবা তাতে হস্তক্ষেপ, এ ছাড়া মর্যাদাহানি কিংবা অবমাননা ঘটছে। অন্যান্য কারাগারগুলোতেও নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে।
আমাদের প্রতিবেদন প্রকাশের পর মুরসিকে যে অবস্থায় রাখা হয়েছিল, পরিস্থিতিতে তার থেকে কোনো উন্নতি ঘটেছিল কিনা একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশনের মাধ্যমে তা পর্যালোচনা করে দেখা উচিত মিসরীয় সরকারের। কিন্তু এমন কোনো তদন্তের আভাস পাওয়া যাচ্ছে না এখনো।
৬৭ বছর বয়সী মুরসি আদালতে পড়ে যাওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর পরিবার সদস্যদের উপস্থিতিতে তাকে দাফন করা হয়েছে।
মুরসির ছেলে আবদুল্লাহ মোহাম্মদ মুরসি বলেন, ‘বাবার নিজ শহরে যাতে সাধারণ মানুষের উপস্থিতিতে একটি জানাজার ব্যবস্থা করা হয়, আমরা সেই অনুরোধ রেখেছিলাম কর্তৃপক্ষের কাছে। কিন্তু তা রাখা হয়নি।’
এ ঘটনায় অবশ্যই একটি তদন্ত হওয়া উচিত। একটি স্বাধীন আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিটিই হতে পারে তার একমাত্র পদক্ষেপ।
কারাগারে ছয় বছর ধরে অনবরত নির্যাতনের পর মিসরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নির্বাচিত একজন গণতান্ত্রিক প্রেসিডেন্টের জনসমক্ষে মৃত্যু হয়েছে। কাজেই দায়ীদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসা উচিত।
লেখক: ক্রিসপিন ব্লান্ট, ব্রিটেনের কনজারভেটিভ পার্টির এমপি এবং আন্তঃদলীয় সৌদি উমেন অ্যাকটিভিস্ট ডিটেইনি প্যানেলের প্রধান