ক্রাইমর্বাতা রিপোর্ট: বহুল আলোচিত স্বাস্থ্য অধিদফতরের সেই আবজাল এখন অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে। একা নন। গেছেন সপরিবারে। আছেন বহাল তবিয়তে রাজার হালে। সেখানেও তার বাড়ি-গাড়িসহ কোনো কিছুরই অভাব নেই।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কড়া নজরদারির মধ্যে কীভাবে এত বড় রাঘববোয়াল দেশ ছাড়তে পারল সেটিই এখন ভাবিয়ে তুলছে সংশ্লিষ্টদের।
এ জন্য কেউ কেউ শর্ষের মধ্যে ভূত তালাশের কথাও ভাবতে চান। কেননা রীতিমতো দুদকের শক্ত জাল কেটে বেরিয়ে গেছেন আবজাল।
এদিকে কথায় আছে ‘চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে’। আবজালের ক্ষেত্রেও এখন সেরকম কিছু ঘটতে যাচ্ছে। দুদকের দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষ। বিপুল পরিমাণ সম্পদের তথ্য গোপন করার প্রমাণও মিলেছে।
দালিলিক হিসেবে যার পরিমাণ প্রায় ৩শ’ কোটি টাকা। শুধু তাই নয়, আবজালের স্ত্রী রুবিনা খানমের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে ২৬৩ কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য মিলেছে। হতবাক হওয়ার মতো বিষয়।
কেননা, যিনি চাকরিজীবনে মোট বেতন পেয়েছেন ১৭ লাখ টাকা, তার স্ত্রীর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এত টাকা জমা হওয়ার গ্রহণযোগ্য কোনো কারণ থাকতে পারে না। উপরন্তু, যা তিনি আয়কর নথিতে দেখাননি।
সূত্র বলছে, সম্পদের তথ্য গোপন ও অর্থ পাচারের অভিযোগে শিগগির আবজাল দম্পতির বিরুদ্ধে দুদক মামলা করবে। তবে পর্যবেক্ষক মহল মনে করে, আবজাল সপরিবারে বিদেশে অবস্থান করতে পারলে তার টিকিটি স্পর্শ করা কঠিন হবে। মামলাটি শুধু আইনি পদক্ষেপের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে।
সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে আবজাল দম্পতি অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমিয়েছেন, এমন খবরে খোদ দুদকের কর্মকর্তারাই হতাশ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, সম্পদ অনুসন্ধানের শুরুতেই পালিয়ে যাওয়া ঠেকাতে ইমিগ্রেশনে তাদের পাসপোর্ট ব্লক করা হয়। এরপরও তারা কীভাবে দেশ ছাড়তে সক্ষম হলেন, তা ক্ষতিয়ে দেখা হচ্ছে।
আবজাল দম্পতির সম্পদের অনুসন্ধান প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দুদকের পরিচালক কাজী সফিকুল আলম যুগান্তরকে বলেন, সন্দেহজনক ও অপ্রদর্শিত উৎস থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ সংগ্রহ করায় তার বিরুদ্ধে অর্থ পাচার বা মানি লন্ডারিং আইনেও মামলা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে অনুসন্ধান কর্মকর্তা মামলার অনুমতি চেয়ে কমিশনের কাছে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছেন।
সূত্র জানায়, চলতি বছর মার্চে দুদকের পৃথক দুটি অনুসন্ধান টিম আবজাল হোসেন ও তার স্ত্রী রুবিনা খানমের দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণী যাচাই শুরু করে। অনুসন্ধানে দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণীর সঙ্গে প্রকৃত অর্থ-সম্পদের ব্যাপক গরমিল পাওয়া যায়। কোটি কোটি টাকার সম্পদের তথ্য বেমালুম চেয়ে যান আবজাল দম্পতি।
আবজালের স্ত্রী রুবিনা খানমের মালিকানাধীন রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের ব্যাংক হিসাবের তথ্যও গোপন করা হয়। অনুসন্ধানে রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের ব্যাংক হিসাবে ২৬৩ কোটি টাকার অবৈধ লেনদেনের তথ্য পায় দুদক।
দুদকের এ সংক্রান্ত অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বামীর অবৈধ আয়কে বৈধ করার পূর্বপরিকল্পনার অংশ হিসেবে ব্যাংক হিসাবসমূহে কখনও এসওডি, কখনও মেয়াদি হিসাব আবার কখনও সঞ্চয়ী হিসাব অথবা পে-অর্ডার ইস্যু করে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে তিনি অপরাধ করেছেন।
এ ছাড়া অজ্ঞাত উৎস থেকে ব্যাংক হিসাবে অপ্রদর্শিত ২৬৩ কোটি ৭৭ লাখ ৬৪ হাজার ৭২৩ কোটি টাকা জমাকরণ এবং পরে উত্তোলন করে পাচারে জড়িত ছিলেন রুবিনা খানম।
দুদক সূত্র জানায়, আবজাল হোসেন তার সম্পদ বিবরণীতে ৬০ লাখ ৭ হাজার ৭২৫ টাকার ঘোষণা দেন। কিন্তু যাচাইকালে দেখা যায়, তিনি ১ কোটি ৬৫ লাখ ৪৩ হাজার ২১৫ টাকার সম্পদ গোপন করেছেন। দুদক তার ২ কোটি ২৫ লাখ ৫০ হাজার ৯৪০ টাকার সম্পদের খোঁজ পায়।
এ ছাড়া আবজালের মালিকানায় থাকা ১ কোটি ২৪ লাখ ২২ হাজার ২৯৭ টাকার অস্থাবর সম্পদের তথ্যও পাওয়া যায়। দুদকের অনুসন্ধান টিম দেখতে পায় কয়েকটি ব্যাংক হিসাব থেকে বিভিন্ন সময় ক্লিয়ারিং ও পে-অর্ডারের মাধ্যমে বিশাল অঙ্কের অর্থ অন্যত্র সরিয়ে নেন আবজাল হোসেন।
স্থানান্তর করা অর্থের পরিমাণ ২০ কোটি ৭৪ লাখ ৩২ হাজার ৩২ টাকা। এসব অর্থ তার জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কারণ তিনি তার চাকরিজীবনে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সর্বমোট বেতন পান ১৭ লাখ ৪৬ হাজার ৩১২ টাকা। তিনি সব মিলিয়ে বেতন পেতেন ৩০ হাজার টাকা। অথচ চড়তেন হ্যারিয়ার ব্র্যান্ডের জিপে।
ঢাকার উত্তরায় তার ও স্ত্রীর নামে বাড়ি আছে পাঁচটি। বাড়ি আছে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতেও। রাজধানী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জায়গায় আছে অন্তত ২৪টি প্লট ও ফ্ল্যাট। দেশে-বিদেশে আছে বাড়ি-মার্কেটসহ অনেক সম্পদ।
দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আবজাল হোসেন সরকারি চাকরিতে থেকে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে বিপুল অর্থ-সম্পদ উপার্জন করেছেন।
আবজালের স্ত্রী রুবিনা খানম তার সম্পদ বিবরণীতে ৪ কোটি ৭ লাখ ৫৫ হাজার ৩০০ টাকার সম্পদের ঘোষণা দেন। দুদকের অনুসন্ধানে দেখা যায়, রুবিনা খানম বিশাল অঙ্কের সম্পদের তথ্য গোপন করে মিথ্যা বিবরণী উপস্থাপন করেছেন। যাচাইকালে তার নামে ৯ কোটি ৮৬ লাখ ১ হাজার ৮০১ টাকার গোপনকৃত সম্পদের তথ্য বেরিয়ে আসে।
দুদক বলছে, আবজাল হোসেন তার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের নামে স্বাস্থ্য অধিদফতরের বড় বড় কাজ করতেন। সরকারি চাকরি থেকে অবৈধভাবে ঠিকাদারি ব্যবসা করলেও স্বাস্থ্য অধিদফতর কোনোদিন এ নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি। বরং আবজালের প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিতে সব সময়ই সহায়তা করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।
সূত্র বলছে, দুদকের কাছে সম্পদ বিবরণী জমা দেয়ার পরপরই আবজাল দম্পতি বিদেশে পালিয়ে যান। বর্তমানে তারা অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থান করছেন। অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে অনেক আগেই বাড়ি কেনেন আবজাল। এখন সেখানেই সপরিবারে বসবাস করছেন।
আবজালের দেশ ছাড়ার খবরের সত্যতা নিশ্চিত না করলেও দুদক বলছে, এমন খবরে তারা কিছুটা হতাশ। কারণ আবজাল হোসেন সত্যি দেশ ছেড়ে থাকলে তাতে তদন্ত প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হবে। একই সঙ্গে শাস্তি নিশ্চিত করাও কঠিন হয়ে পড়বে। আবজাল যাতে কোনোভাবেই বিদেশ পালাতে না পারে সে জন্য আগেই ইমিগ্রেশনে চিঠি দেয়া হয়েছিল।
চলতি মাসের ১০ তারিখ ইমিগ্রেশন থেকে দুদককে জানানো হয়, আবজাল হোসেন নামের কোনো যাত্রীর বিদেশ গমনের বিষয়ে কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই। এরপর দুদক বাংলাদেশ বিমানে চিঠি দেয়।
কিন্তু বাংলাদেশ বিমান থেকে আবজালের বিমান ভ্রমণ সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। শেষমেশ বাংলাদেশে কার্যক্রম চলমান আছে এমন সব বিমান সংস্থার কাছে চিঠি দিয়েছে দুদক। তাদের কাছে প্যাসেঞ্জার লিস্টও চাওয়া হয়েছে।
সূত্র বলছে, আবজাল দম্পতির সব সম্পদ দেখভাল করছেন তার আত্মীয়স্বজন। এ ছাড়া স্বাস্থ্য অধিদফতরে কর্মরত তার কয়েকজন শ্যালক ও ভাতিজা আবজালের পক্ষে প্রভাবশালী মহলে তদবির শুরু করেছেন। বিদেশে বসে স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রভাবশালী একজন ঠিকাদারও তার পক্ষে কাজ করছেন।
এ কারণে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি বড় অংশ মনে করে, যতই তদন্ত-অনুসন্ধান হোক না কেন আবজালের কিছুই হবে না। কারণ এর আগে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কোনো দুর্নীতিবাজের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা যায়নি। মামলা হলেও ফাঁকফোকর দিয়ে সে বেরিয়ে যাবে।
সূত্র বলছে, দুদকের অনুসন্ধান শুরুর পরপরই আবজাল হোসেন তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি বন্ধ করে দেন। এরপর তিনি ভুয়া রেজিস্ট্রেশনের একাধিক নম্বর ব্যবহার করেন। তবে তার ফোনালাপ বিশ্লেষণ করে দুদক জানতে পারে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে তিনি দুদকের অনুসন্ধান নিয়ে কথাবার্তা বলেন। এ ছাড়া সরকারের প্রভাবশালী মহলেও নিজেকে বাঁচাতে নানামুখী তৎপরতা অব্যাহত রেখেছেন।
প্রসঙ্গত, আবজাল হোসেনের বয়স এখন ৪৫। বাড়ি ফরিদপুর সদর। ১৯৯২ সালে তিনি তৃতীয় বিভাগে এইচএসসি পাস করেন। এরপর আর পড়ালেখা করেননি। ওই সময় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পে দৈনিক মজুরিভিত্তিক বদলি কর্মচারী হিসেবে যোগ দেন।
পরবর্তী সময়ে প্রকল্পটি রাজস্ব খাতে স্থানান্তরিত হলে আবজালের ভাগ্য খুলে যায়। এরপর তাকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের ক্যাশিয়ার পদে পোস্টিং দেয়া হয়। ১৯৯৮ সালে তিনি স্বাস্থ্য অধিদফতরে বদলি হয়ে আসেন। পদোন্নতি পেয়ে হন হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা।