ক্রাইমর্বাতা রিপোর্ট:সাতক্ষীরা: স্ত্রীকে উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদ করায় বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে প্রকাশ্যে রিফাত শরীফ নামে এক যুবককে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ফেসবুক ব্যবহারকারীরা।
প্রকাশ্য সড়কে শতশত মানুষের উপস্থিতিতে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না তারা। ক্ষোভ আর নিন্দা প্রকাশ করে হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেফতার করে শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন তারা।
অনেকেই এ ঘটনাকে ঢাকায় নিহত দর্জি দোকানের কর্মী বিশ্বজিৎ দাস হত্যার সঙ্গে তুলনা করেছেন।
এদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া হত্যাকাণ্ডের একটি ভিডিওতে রিফাতকে এলোপাতাড়ি কোপাতে দেখা গেছে কয়েকজন যুবককে। এসময় স্বামীকে বাঁচাতে স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি দুই যুবককে বারবার প্রতিহতের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। কিন্তু তার পাশেই দাঁড়িয়ে অন্যরা এ দৃশ্য দেখলেও কেউ এগিয়ে আসেননি।
অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ও ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান লিখেছেন, ‘চোখের সামনে কোনোদিন কোনো অন্যায় দেখে পালিয়ে আসিনি। হয়রানির শিকার হয়েছি। নানা ভোগান্তিতে পড়েছি। তবু প্রতিবাদ করেছি। প্রতিরোধ করেছি।
অথচ বরগুনায় আজ শত শত লোকের উপস্থিতিতে স্ত্রীর সামনে শাহ নেয়াজ রিফাত শরীফ (২৫) নামের এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। কেউ একজন ভিডিও করেছেন। সেই ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। নানা বিপ্লবী মন্তব্য পাওয়া যাচ্ছে তাতে। কিন্তু একজন মানুষকেও পাওয়া যায়নি যিনি ঘটনার প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ করে ঠেকাতে গেছেন।
চোখের সামনে অন্যায় দেখেও নিরব থাকার এমন প্রবণতা একটা জাতি ধ্বংস হওয়ার জন্য যথেষ্ট। আমি জানি না যারা আজ ঘটনাস্থলে ছিলেন, তারা কীভাবে ঘুমাবেন! জানি না কোন আফিম খেয়ে আমরা ঘুমাচ্ছি। জানি না কবে এই ঘুম ভাঙবে। শুভরাত্রি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আহমেদ নয়ন লিখেছেন, ‘বরগুনায় প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের ‘নিরব দর্শক’ হয়ে ওঠারও একটা ব্যাকগ্রাউন্ড আছে। এই ব্যাকগ্রাউন্ড সৃষ্টির দায় কিন্তু আপনি-আমি এড়াতে পারি না।’
সাংবাদিক ও লেখক মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ লিখেছেন, ‘সবাই দাঁড়িয়ে ভিডিও করাদের বিচার চাইছে। যারা কোপালো তাদের বিচার না করলেও হবে যেন।’
নরওয়ের অসলো থেকে শাহাদাত হোসাইন নামের একজন তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন,
‘সারা বছর চাষ করেন-
নির্মমতা, ঘৃণা,
জি ভাই, সহমত ভাই …
আর ফলন আশা করেন –
মমতা,
সাহস,
প্রতিরোধ …
ভারী রসিক তো মিয়া, আপনারা।
আপনাদের সবাইকে যে সুলতান সুলেমানের হারেমের রক্ষীবাহিনীর মত খোজা বানানোর প্রকল্প হাতে নেয় নাই তার জন্য শুকরিয়া করেন।’
জেনস শিপার নামের একটি আইডি থেকে লেখা হয়েছে, বিশ্বজিতের রক্তের দাম দিতে হয়েছে রিফাতের প্রাণের বিনিময়ে! বিচারহীনতার সংস্কৃতির এই দেশে এভাবেই রিফাতদের চলে যেতে হয় অকালে অতৃপ্তি নিয়ে আর আমাদের বেঁচে থাকতে হয় তাদের অভিশাপের বোঝা নিয়ে!’
সোহাগ সরকার লিখেছেন, ‘পূর্বের ঘটনাগুলির ধারাবাহিকতায় এটা বলা যায় যে ছবিতে দৃশ্যমান দোষী ব্যক্তিরা আগামীতে মহামান্য উচ্চ আদালতে নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে বেখসুর খালাস পাবেন। আমরা এখন ফেসবুকে দু একটা ইমোশনাল পোস্ট করে দুদিন পর সব ভুলে যাবো। এ জন্য এদেশে ঘটে যাওয়া কোনো দুর্ঘটনার কোনো পোস্ট ফেসবুকে দেখলে হাস্যকর লাগে, লাগে ঘৃণাও।’
মোহাম্মদ ইব্রাহিম নামের একজন্য লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের বিচার বিভাগ, আইন বিভাগ সারা দেশের মানুষের কাছে এখন প্রশ্নবিদ্ধ। যদি বিচার বিভাগ কিছুটা হলেও স্বাধীন থেকে থাকে, তাহলে নিশ্চয় এর বিচার হবে। আর যদি সঠিক আইনের প্রয়োগ হয়ে থাকতো তাহলে এরকম নির্মম ঘটনা আর ঘটতো না।’
প্রসঙ্গত, বুধবার সকাল ১০টার দিকে নয়ন নামে এক যুবকের নেতৃত্বে ৪-৫ দুর্বৃত্ত রিফাতকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় ফেলে যায়।
নিহতের পরিবার জানায়, রিফাতকে কুপিয়ে হত্যা করেছে তার সদ্যবিবাহিত স্ত্রীর প্রেমিক নয়ন। রিফাতের সঙ্গে দু’মাস আগে পুলিশলাইন সড়কের আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি নামের এক মেয়ের বিয়ে হয়। বিয়ের পর নয়ন নামে এক যুবক মিন্নিকে তার প্রেমিকা দাবি করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপত্তিকর পোস্ট দিতে থাকে।
রিফাতের বাবা দুলাল শরীফ বলেন, নয়ন প্রতিনিয়ত আমার পুত্রবধূকে উত্ত্যক্ত করত এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপত্তিকর পোস্ট দিত। এর প্রতিবাদ করায় আমার ছেলেকে নয়ন তার দলবল নিয়ে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে। তিনি বলেন, আমার একমাত্র ছেলেকে যারা দিনে-দুপুরে কুপিয়ে হত্যা করেছে, তাদের বিচার চাই।
স্থানীয়রা জানান, রিফাত বুধবার সকালে তার স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে বরগুনা সরকারি কলেজে নিয়ে যান। পরে কলেজ থেকে ফেরার পথে মূল ফটকে নয়নসহ কয়েকজন রিফাতের ওপর হামলা চালায়।
এ সময় তারা ধারালো অস্ত্র দিয়ে রিফাতকে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। রিফাতের স্ত্রী মিন্নি দুর্বৃত্তদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু কিছুতেই হামলাকারীদের থামানো যায়নি। তারা তাকে উপর্যুপরি কুপিয়ে রক্তাক্ত করে চলে যায়। পরে স্থানীয় লোকজন রিফাতকে হাসপাতালে নিয়ে যান।
আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি জানান, বরগুনা পৌরসভার ধানসিঁড়ি সড়কের আবু বকর সিদ্দিকের ছেলে নয়ন বন্ড ও তার প্রতিবেশী দুলাল ফরাজীর দুই ছেলে রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজী এবং রাব্বি আকন তার স্বামীর ওপর হামলা করে।
তিনি বলেন, আমার সামনে ওই সন্ত্রাসীরা রিফাতকে কুপিয়ে হত্যা করে। আমি শত চেষ্টা করেও আমার স্বামীকে বাঁচাতে পারিনি।
বরগুনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবীর মোহাম্মদ হোসেন বলেন, খবর পেয়ে আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। ভিডিও ফুটেজ দেখে আসামি শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের গ্রেফতারের জন্য অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
জেলা আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক সুমন দেবনাথ বলেন, রিফাত ছাত্রলীগ কর্মী ছিলেন। তবে জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি জোবায়ের আদনান অনিক বলেন, রিফাত ছাত্রলীগের কর্মী নন।