ক্রাইমর্বাতা রিপোর্ট: কামাল : পুরান ঢাকার দর্জি দোকানী বিশ্বজিৎকে প্রকাশ্য দিবালোকে উপর্যপরি কুপিয়ে হত্যার স্মৃতি বিস্মৃত হওয়ার আগেই আরেকটি নৃশংসতা দেখলো দেশবাসীর সাথে বিশ্ববাসীও। বিশ্ববিবেককে নাড়া দেয়া তোলপাড় তোলা এবারের ঘটনাটি ঘটেছে বরগুনায়। এটিও ঘটেছে দিনের বেলায় প্রকাশ্যে জনগণের সামনে- একই কায়দায় কুপিয়ে। স্ত্রীর হাতের মেহেদীর রঙ মুছে যাওয়ার আগেই তার সামনে চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে খুন করেছে তার স্বামী রিফাত শরীফকে। অকাল বৈধব্য বরণকারী স্ত্রী আয়েশা আক্তার মিন্নি এখন পাগলপ্রায়। খুনীদের হাতে নিয়ত উত্ত্যক্ত হওয়ার প্রতিবাদ করায় তার স্বামীকে অকালে চলে যেতে হয়েছে। এ ঘটনায় থানায় মামলার পর পুলিশ জড়িতদের গ্রেফতারে মাঠে নেমেছে। দু’জনকে গ্রেফতারের দাবি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল করেছেন। তিনি বলেছেন, পুলিশ বসে নেই।
এদিকে, গতকাল বৃহস্পতিবার রিফাত শরীফের জানাযা শেষে তাকে দাফন করা হয়েছে। জানাযায় হাজারো মানুষের উপস্থিতি ঘটেছে। দেশের উচ্চ আদালত প্রকাশ্যে এমন ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করে পুলিশের আইজিকে রেড অ্যালার্ট জারী করে জড়িতদের দেশের বাইরে যাওয়া ঠেকাতে নির্দেশ দিয়েছেন।
জানা গেছে, রিফাত হত্যাকান্ডের মূলহোতা নয়নকে ২৪ ঘণ্টা পার হওয়ার পরও গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। বুধবার ২৭ জুন রাত ২ টায় নিহত রিফাতের বাবা বাদী হয়ে নয়ন, রিফাত ও রিশানসহ ১২ জনকে আসামী করে সদর থানায় মামলা করেন। এরপরই অভিযানে নামে পুলিশ। গ্রেফতার করা হয় চন্দন নামে মামলার ৪ নম্বর আসামীকে। তবে একদিন পেরিয়ে গেলেও প্রধান অভিযুক্ত নয়ন, রিফাত ফরাজি ও রিশান ফরাজিসহ জড়িতদের গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। এদিকে কুপিয়ে হত্যার ওই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে।
পর্যবেক্ষক মহল বলছেন, দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণেই প্রকাশ্যে দিবালোকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করার ঘটন বেশি ঘটেছে। জড়িতরা ওই সংস্কৃতির কারণেই সাহস পেয়েছে। চাঞ্চল্যকর অনেক হত্যাকান্ডের সাথে জড়িতরা ইতোমধ্যে রক্ষাকবচের সন্ধান পেয়েছে। আর জনগণ এ ধরনের এমন অনেক ঘটনাই মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। এখন তাদের ভয়, খুনীদের নিবৃত্ত করতে গিয়ে তারা আবার কোন অজানা আতংক আর আশংকায় পড়েন। তাদের ভবিষ্যত চিন্তা থেকেই তারা প্রকাশ্যে এমন ঘটনা ঘটে যেতে দেখলেও বরগুনার ঘটনায় খুনীদের হাত থেকে রিফাত শরীফকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি। তাদের কাছে এ ধরনের ঘটনার ফলাফল সুখকর নয় বলেই তারা মনে করেছেন।
স্বজনদের অভিযোগ, স্ত্রীকে উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদ ও মাদক ব্যবসায় বাধা দেয়ার জেরেই এ হত্যাকান্ড হয়েছে। তবে, স্থানীয় অনেকের দাবি প্রেমঘটিত কারণে রিফাতকে হত্যা করা হয়েছে।
বুধবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে স্ত্রী আয়েশাকে বরগুনা সরকারি কলেজে নিয়ে যান রিফাত। কলেজ থেকে ফেরার পথে মূল ফটকে নয়ন, রিফাত ফরাজীসহ দুই যুবক রিফাত শরীফের ওপর হামলা চালায়। এ সময় ধারালো অস্ত্র দিয়ে রিফাত শরীফকে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে তারা। রিফাত শরীফের স্ত্রী আয়েশা দুর্বৃত্তদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু কিছুতেই হামলাকারীদের থামানো যায়নি। তারা রিফাত শরীফকে উপর্যুপরি কুপিয়ে রক্তাক্ত করে চলে যায়। পরে স্থানীয় লোকজন রিফাত শরীফকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে রিফাত শরীফের মৃত্যু হয়।
রিফাতের জানাযায় মানুষের ঢল দাফন
রিফাত শরীফের দাফন সম্পন্ন হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে বরগুনা সদর উপজেলার বুড়িরচর ইউনিয়নের নিজ বাড়িতে জানাযা শেষে তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। রিফাত শরীফের জানাযায় নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের ঢল নামে।
এর আগে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে রিফাতের মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। পরে মরদেহ নিয়ে বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে বরগুনার নিজ বাড়িতে পৌঁছায় একটি অ্যাম্বুলেন্স। অ্যাম্বুলেন্স বাড়িতে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে পরিবেশ।
জানাজায় ইমামতি করেন বরগুনা কামিল (মডেল) মাদরাসা জামে মসজিদের ইমাম ক্বারী মো. সোলায়মান। জানাজায় অন্যান্যের মধ্যে বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বরগুনা জেলা পরিষদের সাবেক প্রশাসক আলহাজ মো. জাহাঙ্গীর কবীর, বরগুনা জেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান ও বরগুনার সাবেক সংসদ সদস্য মো. দেলোয়ার হোসেন, বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম সরোয়ার টুকু, জেলা যুবলীগের সভাপতি কামরুল আহসান মহারাজ, সাধারণ সম্পাদক সাহাবুদ্দিন সাবুসহ এলাকাবাসী অংশ নেন।
জানাজায় উপস্থিত সবার কাছে রিফাতের পক্ষ থেকে ক্ষমা প্রর্থনা করেন রিফাতের বাবা মো. দুলাল শরীফ এবং চাচা আজিজ শরীফ। এ সময় তারা রিফাতের রূহের মাগফেরাত কামনার জন্য সবার কাছে দোয়া চান।
জানাজার আগে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. ছিদ্দিকুর রহমান প্রমুখ। এ সময় তারা নিহত রিফাতের হত্যাকারীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার জন্য প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ জানান এবং তাদের যে কোনো সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
দুই আসামী গ্রেফতার
রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় মো. হাসান নামে এক আসামীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে বরগুনার পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, বুধবার রাতে নৃশংস এ হত্যাকান্ডে নিহত রিফাতের বাবা দুলাল শরীফ বাদী হয়ে ১২ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। মামলার ৯ নম্বর আসামী মো. হাসান। তবে হাসানকে কখন কোথা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে তদন্তের স্বার্থে সে বিষয়ে কোনো তথ্য জানাতে রাজি হয়নি পুলিশ। এর আগে এ মামলায় চন্দন নামে আরেক আসামীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত এ মামলার দুই আসামীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
রিফাতের শরীরে ছিল অসংখ্য আঘাত
প্রকাশ্যে হত্যার শিকার রিফাত শরিফের (২৬) শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন ছিল। তবে মূলত অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে গতকাল বৃহস্পতিবার জানিয়েছেন ময়নাতদন্তকারী দলের প্রধান জামিল হোসেন। দুপুরে বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রিফাতের লাশের ময়নাতদন্ত হয়। হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জামিল হোসেনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি দল ময়নাতদন্ত করে।
ময়নাতদন্ত শেষে বেলা ১টার দিকে জামিল হোসেন বলেন, রিফাতের শরীরে ছিল অসংখ্য আঘাত। এর মধ্যে গলা, মাথা ও বুকের তিনটি আঘাত গুরুতর ছিল। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। বেলা সোয়া ১টার দিকে রিফাতের লাশ পরিবারের সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
১২ জনের নামে মামলা
রিফাত শরীফকে (২৫) কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় ১২ জনকে আসামী করে মামলা দায়ের করেছেন রিফাতের বাবা দুলাল শরীফ। বুধবার রাতেই ১২ জনের নাম উল্লেখ করে বরগুনা সদর থানায় এই হত্যা মামলা দায়ের করেন তিনি। প্রধান আসামী করা হয়েছে খুনের মূল হোতা হিসেবে অভিযুক্ত সাব্বির হোসেন নয়নকে, যে এলাকায় ‘নয়ন বন্ড’ নামেও পরিচিত।
মিন্নি এবং আরেক যুবকের বাধা উপেক্ষা করেই রিফাতকে কোপায় নয়ন ও রিফাত ফরাজীমামলার এক নম্বর আসামী সাব্বির হোসেন নয়ন, দুই নম্বর আসামী রিফাত ফরাজি, তিন নম্বর আসামী রিশান ফরাজি, চার নম্বর আসামী চন্দন। এর মধ্যে প্রথমেই চন্দনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে।
কলেজের গেট থেকে রিফাতকে টেনে-হিঁচড়ে বের করে কয়েক যুবক
সকালে ঘটনার সময় বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে দিয়ে বাজারে যাচ্ছিলাম। যাওয়ার পথে দেখতে পাই, কিছু অল্প বয়সী যুবক রিফাতকে টেনে-হিঁচড়ে কলেজ গেট থেক বের করছিল। নয়নসহ আরও কয়েকজন কলেজের সামনে ক্যালিক্স একাডেমির পূর্ব পাশের গলিতে অবস্থান করছিল। যে যুবকরা রিফাতকে টেনে-হিঁচড়ে বের করছিল সেখান থেকে একজন ক্যালিক্স একাডেমির গলিতে দৌড়ে যায়। এরপর ওইখান থেকে নয়নসহ দুই-তিনজন ধারালো অস্ত্র নিয়ে বের হয়ে রিফাতকে কোপাতে থাকে। এভাবেই ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন প্রত্যক্ষদর্শী জীবন ইসলাম (ছদ্মনাম)।
তিনি আরও বলেন, ‘রিফাতকে কোপানোর সময় ওই যুবকরা পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। মেয়েটি (মিন্নি) যখন বার বার হামলাকরীদের সরিয়ে নিচ্ছিল তখন আমিও তাদের সরতে বলি। কিন্তু তাদের কাছে ধারালো অস্ত্র থাকায় কাছে যেতে সাহস পাইনি। রিফাতকে কোপানোর পর হামলাকারীরা পালিয়ে যায়। সবমিলিয়ে চার থেকে পাঁচ মিনিটের মধ্যে এই ঘটনা ঘটে।’
স্ত্রীর বর্ণনায় রিফাত হত্যাকা-
বরগুনা শহরে প্রকাশ্য রাস্তায় কারা কীভাবে রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যা করেছে, সেই বিবরণ সাংবাদিকদের জানালেন তার স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি। গতকাল বৃহস্পতিবার বরগুনা পুলিশ লাইনস এলাকায় বাবার বাড়িতে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, স্বামীকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন তিনি। অস্ত্রের সামনেই হামলাকারীদের বাধা দিতে চেয়েছেন, চিৎকার করছেন। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি। কান্না জড়ানো কণ্ঠে মিন্নি বলেন, “আমি অনেক চেষ্টা করছি, কিন্তু ফিরাইতে পারি নাই।”
আগের দিন বুধবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বরগুনা শহরের কলেজ রোডে রিফাতকে (২৩) স্ত্রীর সামনেই কুপিয়ে জখম করে একদল যুবক। বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে তার মৃত্যু হয় ।
রিফাতের ওপর হামলার একটি ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়লে দেশজুড়ে শুরু হয় আলোচনা। সেখানে দেখা যায়, দু যুবক রামদা হাতে রিফাতকে একের পর এক আঘাত করে চলেছে। আর মিন্নি স্বামীকে বাঁচানোর জন্য মরিয়া হয়ে হামলাকারীদের ঠেকানোর চেষ্টা করছেন।
সদর উপজেলার বুড়িরচর ইউনিয়নের বড় লবণগোলা গ্রামের দুলাল শরীফের ছেলে রিফাতের সঙ্গে বরগুনা পৌর এলাকার নয়াকাটা এলাকার মোজাম্মেল হোসেন কিশোরের মেয়ে আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির বিয়ে হয় মাস দুই আগে।
বরগুনার সরকারি কলেজের ডিগ্রি প্রথম বর্ষের ছাত্রী মিন্নিকে বুধবার কলেজ থেকে আনতে গিয়েই প্রকাশ্য রাস্তায় খুন হন রিফাত।
মিন্নি বলেন, হামলাকারীদের সবাইকে তিনি চিনতে পারেননি। তবে নয়ন বন্ড, রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজী নামে তিনজন ছিল তাদের মধ্যে।
বরগুনার ওসি আবির মোহাম্মদ হোসেন বুধবার সাংবাদিকদের বলেছিলেন, মিন্নিকে নিজের স্ত্রী বলে দাবি করে আসছিলেন নয়ন। এই বিরোধকে কেন্দ্র করেই রিফাতের উপর হামলা চালানো হয়।
মিন্নি সাংবাদিকদের বলেন, নয়ন বিয়ের আগে থেকেই তাকে উত্ত্যক্ত করত, হুমকি দিত। বিভিন্ন সময় পথেঘাটে হেনস্তাও করেছে।
নিহত রিফাত শরীফ নিহত রিফাত শরীফ বুধবারের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে মিন্নি বলেন,“আমি আর রিফাত কলেজ থেকে ফিরছিলাম। এ সময় কিছু ছেলে এসে রিফাতকে মারতে শুরু করে। আমি চেষ্টা করেও তাদের থামাতে পারি নাই। পরে নয়ন বন্ড, রিফাত ফরাজী আর রিশান ফরাজী এসে কোপানো শুরু করে। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করেছি; অস্ত্র ধরেছি; চিৎকার করছি; একটা লোকও আগায় আসেনি।”
এদিকে নয়নের মা শাহিদা বেগম সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেছেন, তার ছেলের সঙ্গে গত বছরের অক্টোবরে ৫ লাখ টাকা দেনমোহরে মিন্নির বিয়ে হয়। কিন্তু সেই বিয়ে ৩ মাসের মধ্যেই ভেঙে যায়। পরে নয়নের বন্ধু রিফাতের সঙ্গে মিন্নির প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এরপর দুই মাস আগে তাদের পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সাংবাদিকদের বলেন, ভিডিও ফুটেজ দেখে বাকি আসামীদের শনাক্ত করা হচ্ছে। তবে তদন্তের স্বার্থে তাদের নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি তিনি।
বরিশালের ডিআইজি মো. সফিকুল ইসলাম বলেন, “কোনো আসামীকে ছাড় দেওয়া হবে না। সব আসামী ধরা পরবে এবং বিচার হবে।”
আমার ছেলেকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে: রিফাতের বাবা
‘আমার ছেলেকে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। ছেলেকে তো আর ফিরে পাবো না, প্রশাসনের কাছে অনুরোধ, যাতে করে হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়। আমার কিছু চাওয়ার নাই, আমি সুষ্ঠু বিচার চাই’−ছেলের খুনিদের এভাবেই শাস্তির দাবি জানান বরগুনা সদর উপজেলার বুড়িরচর ইউনিয়নের বাসিন্দা নিহত রিফাত শরীফের বাবা দুলাল শরীফ।
রিফাতের বাবা দুলাল শরীফ গনমাধ্যমকে বলেন, ‘সকালে আমি একটু দেরি করে ঘুম থেকে উঠি। সকাল ৯টায় আমার ফোনে তিনবার রিং বাজলেও আমি টের পাই নাই। সকাল ১০টার পরে আমি ঘুম থেকে উঠছি। রিফাতের চাচা শ্বশুরের ফোন পেয়ে হতবিহ্বল হয়ে যাই। তড়িঘড়ি করে একটা মোটরসাইকেল নিয়ে হাসপাতালে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখি অ্যাম্বুলেন্স তাকে (রিফাত) নিয়ে বরিশালের উদ্দেশে রওনা হচ্ছে। আমি দরজা খোলার পর বাবার চেহারাটা দেখার পর মনে করছি আল্লাহ জানি কী…।’ এ সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
নৃশংস হত্যার শিকার রিফাতের বাবা বলেন, ‘তারপর বলি আমি যেতে পারবো না। আমার যেহেতু হার্টের সমস্যা, ডাক্তার আমাকে নিষেধ করেছেন জানাজায় পর্যন্ত না যেতে, মৃত্যু সংবাদও যেন আমাকে কেউ না বলে। তাই আমি রয়ে গেছি। ওই অবস্থায় তাকে হাসপাতালে (বরিশালে) নিয়ে গেছে। এর পরের ঘটনা তো সবাই জানে।’
দুলাল শরীফ আরও বলেন, ‘হাসপাতালে যাওয়ার পর লোকমুখে শুনেছি ওরা (হামলাকারীরা) ওখানে পূর্বপরিকল্পিতভাবে ওঁৎ পেতে ছিল। তা না হলে তাদের হাতে রাম দা কেন থাকবে? আমি মনে করি, তারা জানতো সে কলেজে যাবে।’
ছেলের হত্যার বিচারের দাবি জানিয়ে দুলাল শরীফ বলেন, ‘আমার একটাই আশা, এ ধরনের সন্ত্রাসী যারা আছে, তাদের বিচার হওয়া উচিত। হত্যাকা-ে যারা জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। আমার কিছু চাওয়ার নাই। আমার সন্তান চলে গেছে, সে তো আর ফিরে আসবে না। আমি সুষ্ঠু বিচার চাই। প্রশাসনের কাছে এটাই আমার দাবি।’
ছেলের কথা বলতে গিয়ে কাঁদছেন বাবা দুলাল শরীফ হত্যাকান্ডে কারা জড়িত জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিকেবি রোডের নয়ন নামে একটা ছেলে জড়িত। এলাকায় সে একজন কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ী। সে একবার হেরোইন, একবার ফেনসিডিল নিয়ে ধরা পড়েছে। জেল খেটেছে। এসপি সাহেবের কাছে নালিশ করার পর তিনি একবার ধরে চালান দিছেন। কিন্তু পরে বের হয়ে যায়। সন্ত্রাসীরা কখনও জেলে আটকা থাকে না। তাদের নেটওয়ার্ক খুব বড় থাকে। ওপরে তাদের অবশ্যই বড় ধরনের লিংক আছে, যারা তাদের বের করে আনে। বরগুনাতে মাদক ব্যবসায়ী যারা আছে তারা ঢুকে (জেলে) আর বের হয়। আমি এই জিনিসটাই বুঝি না। ঢুকলেই কেমনে বের হয়ে যায়। প্রশাসনের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, তারা যেন এটা খতিয়ে দেখেন। এছাড়া, রিফাত ফরাজিসহ আরও দুই-তিনজন জড়িত আছে।’
দুলাল শরীফ বলেন, রিফাত সকালে বাসা থেকে ৫০০ টাকা নিয়ে বের হয়েছিল। সে বলেছিল স্ত্রীকে নিয়ে কলেজে যাবে। কিন্তু কখনও বুঝতে পারিনি এই যাওয়াই ওর শেষ যাওয়া হবে।’
দুই খুনির যত অপকর্ম
স্থানীয় ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, হত্যাকারী দুজনের একজন রিফাত ফরাজী, আরেকজন নয়ন বন্ড। দুজনই অনেক আগে থেকেই অপরাধ জগতের পরিচিত মুখ। সংঘটিত করেছেন আরো অনেক অপকর্ম। তাদের কারণে অতিষ্ঠ এলাকার মানুষ। অনুসন্ধানে ওঠে এসেছে তাদের অপকর্মের নানা খতিয়ান। ছিনতাই, মাদক, হামলাসহ নানা অপকর্মের হোতা এই দুই খুনি।
দুই খুনি নয়ন ও রিফাতের বিষয়ে স্থানীয় ও ভুক্তভোগী এলাকাবাসীরা জানান, মাদক ব্যবসা, মাদক সেবন ও ছিনতাইসহ নানা অপকর্মে যুক্ত ছিলেন রিফাত ফরাজী। এ কারণে স্থানীয়দের কাছে একটি আতঙ্কের নাম রিফাত ফরাজী। রিফাতের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন, এমন মানুষের সংখ্যা কম নয়। প্রতিবেশী ও স্থানীয়দের ওপর হামলা, মারধর রিফাতের কাছে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এসব কারণে কয়েকবার গ্রেফতার হলেও অজ্ঞাত কারণে খুব স্বল্প সময়েই মুক্তি পান তিনি। ২০১৭ সালের ১৫ জুলাই সন্ধ্যায় তরিকুল ইসলাম (২১) নামে এক প্রতিবেশীকে কুপিয়ে মারাত্মক যখম করেন রিফাত ফরাজী।
আরও জানা গেছে, খুনি নয়ন বন্ডের (২৫) বাসা বরগুনা সরকারি কলেজের দক্ষিণ-পশ্চিমে বরগুনা পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ডে। নয়নের বাবা মৃত মো. ছিদ্দিকুর রহমান। দুই ভাইয়ের মধ্যে নয়ন ছোট। নয়নের বড় ভাই মিরাজ দীর্ঘদিন ধরে সিঙ্গাপুর প্রবাসী হওয়ায় মাকে নিয়েই ওই বাসায় বসবাস করে নয়ন। ২০১৭ সালের ৫ মার্চ রাত ১১টার দিকে নয়ন বন্ডের বাসায় অভিযান চালায় বরগুনা জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। এ সময় বিপুল পরিমাণ মাদক, দুটি দেশীয় অস্ত্র ও এক সহযোগীসহ নয়ন বন্ডকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এসব মাদকের মধ্যে ছিল ৩০০ পিস ইয়াবা, ১২ বোতল ফেনসিডিল ও ১০০ গ্রাম হেরোইন। এ ঘটনায় পুলিশের মামলায় দীর্ঘদিন জেলে থাকার পর সম্প্রতি জামিনে বেরিয়ে আসেন নয়ন বন্ড। জেল থেকেই বেরিয়ে মূলত এ হত্যাকা- ঘটায় সে।
অপর খুনি রিফাত ফরাজী মাদক ব্যবসা, মাদক সেবন ও ছিনতাইসহ নানা অপকর্মে যুক্ত ছিলেন। এ কারণে স্থানীয়দের কাছে আতঙ্ক সে। রিফাতের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন, এমন মানুষের সংখ্যা কম নয়। প্রতিবেশী ও স্থানীয়দের ওপর হামলা, মারধর খুনি রিফাতের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এসব অপকর্মে কয়েকবার গ্রেফতার হলেও অজ্ঞাত এক কারণে খুব স্বল্প সময়েই মুক্তি পেয়ে সে।
২০১৭ সালের ১৫ জুলাই সন্ধ্যায় তরিকুল ইসলাম (২১) নামে এক প্রতিবেশীকে কুপিয়ে মারাত্মক জখম করে রিফাত ফরাজী। একই বছর রিফাত বরগুনার হোমিও চিকিৎসক ডা. আলাউদ্দিন আহমেদের ডিকেপি রোডের বাসার ছাত্র মেসে গিয়ে ধারালো অস্ত্রের মুখে সব ছাত্রদের জিম্মি করে ১৪টি মোবাইল ছিনতাই করে পালিয়ে যান। এ ঘটনায় থানায় অভিযোগ করা হলে পুলিশ রিফাতের বাবা দুলাল ফরাজীকে আটক করে মোবাইলগুলো উদ্ধার করেন।
তবে পুলিশ বলছে, সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে রিফাতের খুনিদের শনাক্ত করা হয়েছে। এ ঘটনাটি পুলিশের সিসি ক্যামেরার আওতায় থাকলেও ঘটনাস্থলে সময়মতো পৌঁছাতে পারেনি পুলিশ।
পুলিশ বসে নেই: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
স্ত্রীর সামনে যুবককে কুপিয়ে হত্যাকা-ের সব আসামীকে অচিরেই গ্রেফতারের আশা দিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। এই ঘটনাকে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির নজির হিসেবে দেখতে নারাজ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একে বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে করছেন। বরগুনা পুলিশ হত্যাকান্ডের এক আসামীকে গ্রেফতারের কথা জানালেও চট্টগ্রামে পুলিশের এক অনুষ্ঠানে এসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দুজনকে আটকের খবর সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে চট্টগ্রাম নগরীর ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টারে বাংলাদেশ পুলিশ উইমেন অ্যাওয়ার্ড ২০১৯ অনুষ্ঠানে যোগ দেন। ওই অনুষ্ঠানেই সাংবাদিকরা বরগুনার আলোচিত ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন করেন মন্ত্রীকে। তিনি বলেন, “(হত্যাকান্ডটি) কেন ঘটেছে সেটা তদন্ত করেই আপনাদের ডিটেইল জানাতে পারব। “আমার কাছে এই মুহূর্তের খবর হল, দুজনকে আমাদের পুলিশ ধরে ফেলছেন। এবং বাকি যেই কয়জন এই নৃশংস হত্যাকা-ের সাথে জড়িত ছিল, তাদের সবাইকে আমরা ধরব। সবাইকে আইনের সামনে আমরা হাজির করে দেব।”
হামলার ২৪ ঘণ্টায়ও মূল আসামীকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ; তবে এই বাহিনীর চেষ্টায় কোনো ঘাটতি দেখছেন না স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। “আমাদের পুলিশ কিন্তু বসে নেই। জোর গলায় বলতে পারি, যত ঘটনাই ঘটুক.. দক্ষতা-সক্ষমতায় পিছিয়ে পড়া পুলিশ আমাদের নয় এখন। আপনি যদি ১০ বছর আগের পুলিশ আর এই পুলিশ চিন্তা করেন, তাহলে ভুল করবেন। আমাদের পুলিশ অনেক সক্ষম, অনেক দক্ষ এবং অনেক ইনফরমেটিভ।“এই যে নুসরাতের হত্যাকা-টা। এটা কি আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ধরে ফেলছে না? পিবিআই তদন্ত করে আসল যারা ক্রিমিনাল তাদের ধরে আইনের সম্মুখে দিয়েছে না। আগের পুলিশ আর এই পুলিশ এক নয়। এরা অন্তত সক্ষম, দক্ষ এবং যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারে।”
বরগুনার ঘটনাটি দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির নজির কি না- প্রশ্নে আসাদুজ্জামান কামাল বলেন, “আইনশৃঙ্খলার অবনতি হবে কেন? আমাদের পুলিশরা তো সঙ্গে সঙ্গেই কাজ করছেন। এই ধরনের দুয়েকটি ঘটনা তো…।”
খুনিদের গ্রেফতারে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ
রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় জড়িতদের শিগগির গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের একথা জানান।
তিনি বলেন, “এই ঘটনায় অলরেডি একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিদেরও গ্রেফতার করার প্রক্রিয়া চলছে। পুলিশ অত্যন্ত কঠোর অবস্থানে আছে।“যারা এই ঘটনার সাথে জড়িত তাদের যে কোনো মূল্যে গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় নিয়ে আসার জন্য প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন।”
এ বিষয়ে সাংবাদিকরা দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ওবায়দুল কাদের বলেন, “প্রকাশ্য দিবালোকে এটা একটা নৃশংস ঘটনা, একটা মর্মান্তিক ঘটনা। আমি যতটা পুলিশ সোর্সে জানতে পেরেছি এবং আমাদের মিডিয়ায়ও খবর এসেছে- বিষয়টি অনেকটা ব্যক্তিগত সম্পর্কের… প্রেমঘটিত একটা বিষয়। সেখান থেকে ব্যক্তিগত বিদ্বেষের প্রকাশ ঘটেছে খুব নগ্নভাবে।”