ক্রাইমর্বাতা রিপোর্ট : সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থ, দেশ থেকে টাকা পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন নিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থা এশিয়া-প্যাসিফিক গ্রুপ অন মানি লন্ডারিংয়ের (এপিজি) প্রশ্নের মুখে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এসবের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের পদক্ষেপের অগ্রগতি জানতে রোববার সফরে আসছে সংস্থার প্রতিনিধি দল।
সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থ ১ বছরে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা বেড়েছে বলে গেল সপ্তাহে তথ্য প্রকাশ পায়। আর জানুয়ারিতে প্রকাশ পায় দেশ থেকে সর্বশেষ ৫০ হাজার কোটি টাকা পাচারের তথ্য। ফলে শক্ত প্রশ্নই অপেক্ষা করছে সরকারের জন্য। সরকারও প্রতিনিধি দলটির কাছে তুলে ধরার জন্য ‘অ্যাকশন প্ল্যান’ (অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়নের বিরুদ্ধে অগ্রগতি প্রতিবেদন) তৈরি করেছে।
এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানান, দুই পন্থায় অর্থ পাচার হয়। এক ব্যাংক ব্যবস্থা, অন্যটি আমদানি-রফতানির আড়ালে। এর বাইরে বড় আকারে অর্থ পাচার হয় না। এখন তা বন্ধ করতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। বন্দরগুলোতে স্ক্যানার মেশিন বসানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি ওভার প্রাইসিং আর আন্ডার প্রাইসিং প্রতিরোধে পিএসআইর আদলে এনবিআরে একটি সেল খোলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এসব উদ্যোগের পর দেশ থেকে টাকা পাচার অনেক কমে আসবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, এপিজির প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশের প্রস্তুতির বিস্তারিত তুলে ধরা হবে। এজন্য সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়ের তথ্য নিয়ে অ্যাকশন প্ল্যান প্রস্তুত করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, এপিজির পরিচালক ডেভিট শ্যানন ও মোস্তফা আকবর ৭-৮ জুলাই ঢাকা সফর করবেন। ২০১৫-১৬ সালে বাংলাদেশের মিউচুয়াল ইভ্যালুয়েশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে যে অ্যাকশন প্ল্যান তৈরির নির্দেশ দেয়া হয় সেটি নিয়ে আলোচনা করবে দুই সদস্যের এ প্রতিনিধি দলটি।
এছাড়া দলটি বাংলাদেশ সরকারের গঠিত মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ সংক্রান্ত জাতীয় সমন্বয় কমিটির সঙ্গে বৈঠক করবে। এ কমিটির প্রধান অর্থমন্ত্রী। এছাড়া অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগ, আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটসহ বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করবে।
সূত্রমতে, প্রতিনিধি দলটি অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়নে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অগ্রগতি, অভ্যন্তরীণ সমন্বয়, ফলো-আপ অ্যাসেসমেন্ট ও মিউচ্যুয়াল ইভ্যালুয়েশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে স্ট্যাটেজিক ইমপ্লিমেন্ট প্ল্যান (এসআইপি) অগ্রগতি মূল্যায়ন করবে।
আগামী বছর এপিজির বৈঠকে এ রিপোর্ট তুলে ধরা হবে। এরপর বাংলাদেশের অবস্থান জানা যাবে। বাংলাদেশের অবস্থান যাতে ভালো হয় এ জন্যই ওই অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করা। সূত্র মতে, অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে সরকার ৩ বছর (২০১৮-২০২০) মেয়াদি একটি জাতীয় কৌশলপত্র তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। সেটিও তুলে ধরা হবে প্রতিনিধি দলের কাছে।
অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়নের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ১১টি মানদণ্ড রয়েছে। এটি বিবেচনায় কোনো দেশ জঙ্গি, সন্ত্রাসী অর্থায়ন ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ করতে না পারলে প্রথমে ওই দেশকে এপিজি ধূসর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করে। এরপরও পরিস্থিতি উন্নতি না হলে ওই দেশকে কালো তালিকায় নেয়া হয়। তেমনিটি হলে ওই দেশের সঙ্গে অন্য দেশগুলো ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের আগ্রহ হারায়।
সাধারণত প্রতি ৩ বছর অন্তর একটি দেশের ওপর এ মূল্যায়ন করা হয়। এর আগে ২০১৬ সালে বাংলাদেশের মূল্যায়ন করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় এপিজির প্রতিনিধি দলটি আসছে। ২০১৬-তে এপিজি মূল্যায়ন করেছিল- বিদেশে অর্থ পাচার বন্ধ ও দেশের ভেতর সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করতে পারেনি বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে শুধু প্রযুক্তিগত উদ্যোগে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। টাকা পাচার প্রতিরোধে কার্যকরী পদক্ষেপের সূচক প্রত্যাশা অনুযায়ী পূরণ হয়নি।
ওই সময় তিন ভাগে ৪০ শ্রেণীতে অর্থ পাচার প্রতিরোধ ও সন্ত্রাসে অর্থায়নের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ মূল্যায়ন করে এপিজি। প্রযুক্তিগত পদক্ষেপে (প্রথম ভাগ) ৫ শ্রেণীতে পর্যালোচনা করে সন্তোষজনক রেটিং দেয় সংস্থাটি। দ্বিতীয় ভাগে দেখা হয় জঙ্গি ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন এবং অর্থ পাচার প্রতিরোধে ‘দ্রুত পদক্ষেপে’র বিষয়। এক্ষেত্রে ১১টি শ্রেণীর ৫টিতে নিুমানের রেটিং, ১টি ভালো ও বাকি ৫টি মধ্য মানের রেটিং দেয়া হয়। তবে সার্বিক মূল্যায়নে বলা হয়, অবস্থা ভালো হয়নি।
সর্বশেষ ২১ শ্রেণীতে সফলতা নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়। এ পর্যায়ে রেটিং দেয়া হয় মাঝামাঝি। সার্বিক পর্যালোচনা শেষে এপিজির খসড়া মূল্যায়ন প্রতিবেদনে মন্তব্যে বলা হয়, অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়নে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করতে পারেনি বাংলাদেশ।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বাংলাদেশ থেকে অস্বাভাবিক হারে টাকা পাচার বেড়েছে।
২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে চার প্রক্রিয়ায় ৫৯০ কোটি ডলার (৫০ হাজার কোটি টাকা) পাচার হয়েছে। জিএফআইর তথ্যমতে, গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৫ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে, যা দেশের চলতি বছরের (২০১৮-১৯) জাতীয় বাজেটের চেয়েও বেশি। প্রতি বছর গড়ে পাচার হয়েছে প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকা।
টাকা পাচারে বিশ্বের শীর্ষ ৩০ দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশের নাম।
গত সপ্তাহে প্রকাশিত ‘ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড-২০১৮’ শীর্ষক বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালে দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা করা অর্থের পরিমাণ ছিল প্রায় ৬২ কোটি সুইস ফ্রাঁ। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ৫ হাজার ৩৫৯ কোটি টাকা। ২০১৭ সালে ছিল ৪৮ কোটি ১৩ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা ৪ হাজার ১৬০ কোটি টাকা। বাংলাদেশি মুদ্রায় বৃহস্পতিবার এক সুইস ফ্রাঁর বিনিময়মূল্য ছিল ৮৬ টাকা ৪৩ পয়সা।