সিইসি উচ্চ আদালতের রায় পড়ে দেখতে পারেন

প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদার মন্তব্য নির্বাচন বাতিলে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতার ওপর আলো ফেলেছে। কারণ দেশের সর্বোচ্চ আদালতের দেয়া অভিমতের সঙ্গে তার মন্তব্য সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
আপিল বিভাগ একাধিক রায় নিশ্চিত করে বলেছেন, নির্বাচন ‘ফেয়ার, জাস্টলি এবং অনেস্টলি’ হলো কিনা সেটা খতিয়ে দেখার দায় ইসির। ইসি যদি সন্তুষ্ট হয় যে, নির্বাচন অবাধ হয়নি, তাহলে ইসির ক্ষমতা আছে, গোটা নির্বাচন বাতিল করা। এবং নতুন করে নির্বাচন দেয়া।

গত ৩০শে ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনের ফল ঘোষণার ৬ মাস বিলম্বে প্রকাশিত হয়েছে কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফল। আর এতে দেখা যায়, ১০৩টি আসনের ২১৩টি কেন্দ্রে ভোট পড়েছে একশত ভাগ এবং ৯০ থেকে ৯৯ শতাংশ ভোট পড়েছে ১৪টি আসনের সাড়ে সাত হাজার কেন্দ্রে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা গত রোববার সাংবাদিকদের বলেছেন, শতভাগ ভোট পড়া স্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়।

তৎকালীন প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমান, বিচারপতি বিবি রায় চৌধুরী, বিচারপতি এএমএম রহমান ও বিচারপতি কাজী এবাদুল হক সমন্বয়ে গঠিত আপিল বিভাগ ২০০০ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি ইসির ক্ষমতা বিষয়ে একটি রায় দেন।
৫ বিএলসিতে ছাপা আপিল বিভাগের ওই রায়ে বলা হয়, ১৯৯৭ সালে সিদ্ধিরগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে মো. নজরুল ইসলাম ও নূর হোসেনের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। নূর হোসেন নির্বাচনী ফল বাতিল চেয়ে রিট করেন।

হাইকোর্ট তা নাকচ করলে নূর হোসেন আপিল বিভাগে যান।

হাইকোর্ট ডিভিশন এই যুক্তিতে নির্বাচনের ফল বাতিলের আবেদন নাকচ করেছিলেন যে, নির্বাচনের দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছে নির্বাচনের ফলাফল এবং ঘোষণার পরে। তাদের যুক্তি ছিল আপিল বিভাগের এমন ডিসিশন রয়েছে যে, নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পরে রিটে নির্বাচনের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ করা যাবে না। নির্বাচনের ট্রাইব্যুনাল হয়ে আসতে হবে। কিন্তু অ্যাপিলেট ডিভিশন বলেছে, এই ক্ষেত্রে নির্বাচনের পরে অভিযোগ আনা হয়েছে মর্মে যে কথা বলা হয়েছে, তা সত্য নয়। দুটি নির্বাচন কেন্দ্রে নির্দিষ্টভাবে নির্বাচনী অনিয়মের অভিযোগ ছিল এবং তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে। সুতরাং এই নির্বাচনের বিষয়ে ইলেকশন কমিশন পুনরায় নির্বাচনের সিদ্ধান্ত দিতে পারবে।

আপিল বিভাগ মত দেন যে, সাক্ষ্য-প্রমাণ দ্বারা যেহেতু এটা প্রমাণিত যে নির্বাচন কমিশন এ মর্মে সন্তুষ্ট যে, দুটি কেন্দ্রে নির্বাচন কারচুপি হয়েছে। এবং ভালো নির্বাচন হয়নি। নির্বাচন কমিশনের পক্ষে এই ক্ষমতা রয়েছে। কারণ তাকে দেখতে হবে যে নির্বাচন জাস্টলি, অনেস্টলি এবং ফেয়ারলি হয়েছে কিনা।

এফ এম শাহ আলম বনাম মুজিবুল হক মামলায় ৪১ ডিএলআর-এ বর্ণিত আপিল বিভাগের রায়ের বরাতে বলা হয়, নির্বাচন হয়ে গেছে বলে নির্বাচনের ফলাফল বাতিলে নির্বাচন কমিশনের কিছুই করণীয় নেই, এই যুক্তি দেয়া যাবে না। কারণ সামগ্রিক দায়িত্বশীলতা ইসির। একটি সত্যিকারের সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন সততার সঙ্গে করার দায়িত্ব শুধুমাত্র নির্বাচন কমিশনের। নির্বাচন কমিশন যদি তার এই ক্ষমতা নেই বলে দাবি করে তাহলে পেশিশক্তিকেই উৎসাহিত করা হয়।

প্রিজাইডিং অফিসার সকালে একটি কেন্দ্রে ভোটের ফলাফলের বিষয়ে এক ধরনের কথা বলেছেন, আবার সন্ধ্যায় বলেছেন, এখানে কোনো নির্বাচনই অনুষ্ঠিত হয়নি। কিছু ক্ষেত্রে এটাও প্রমাণিত হয়েছে যে প্রিজাইডিং অফিসার হুমকির মুখে নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণা করেছেন।

আপিল বিভাগ এই মন্তব্যও করেছে যে, নো ইলেকশন নো ডেমোক্রেসি।
নির্বাচনের প্রয়োজন রয়েছে কিন্তু একটা বিকৃত নির্বাচন অথবা ভোট বিহীন নির্বাচন গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে। নির্বাচন কমিশনের যে পুনঃনির্বাচন দেয়ার এবং ফলাফল বাতিল করে যে নির্বাচন দিতে পারে তা সুপ্রতিষ্ঠিত নীতি দ্বারা সমর্থিত। এটা কোনো নতুন উদ্ভাবন নয়।

৪৫ ডিএলআর এ বর্ণিত আলতাফ হোসেন বনাম আবুল কাশেম ৪১ ডিএলআর-এ বর্ণিত এফএম শাহ আলম বনাম মুজিবুল হক এবং ৪৩ ডিএলআরে বর্ণিত আবদুর রব মিয়া বনাম ফজলুর রহমান মামলায় আপিল বিভাগের দেয়া রায়গুলো পর্যালোচনা করে ওই রায়ে আপিল বিভাগ মন্তব্য করেন যে, এমন অনেক উপলক্ষ আসতে পারে, যখন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার উদ্ভব ঘটতে পারে। মাস্তান দখল করে নিতে পারে। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা প্রতিপক্ষের এজেন্টদের তাড়িয়ে দিতে পারে এবং তারপর তারা ব্যালটবক্সে ব্যালট পেপার ঢুকাতে পারে আর তারপর জবরদস্তি অথবা সততা কিনে নিয়ে প্রিজাইডিং অফিসারকে দিয়ে তাদের পক্ষে ফলাফল ঘোষণা করিয়ে নিতে পারে। আর সেই ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের নতুন নির্বাচন দেয়ার ক্ষমতা রয়েছে।

আপিল বিভাগের পর্যবেক্ষণে আরো উল্লেখ করা হয় যে, কোন একটি কেন্দ্রে নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হতে পারে এবং প্রিজাইডিং অফিসার কোনো একজন প্রার্থীর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ভুয়া প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশনই হচ্ছে, সেই সংস্থা যদি তার কাছে এই অভিযোগ গ্রহণযোগ্য মনে হয়, তাহলে তার পক্ষে হস্তক্ষেপ করাটা হবে সমীচীন।

ওই রায়ে বলা হয়, ১৯৯৮ সালে আবুল বাশার বনাম কামরুল হাসান মামলায় বলা হয়, এক পরাজিত প্রার্থী নির্বাচনে অনিয়মের দরখাস্ত করেছিলেন। কিন্তু তা নাকচ করা হয়। রিটার্নং অফিসার ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ করা হলে তারা তদন্ত করে বলেছিলেন, ভোট সঠিক হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওই পরাজিত প্রার্থীর পক্ষে বিএনপির মহাসচিব ইলেকশন কমিশনে অভিযোগটি পাঠান।

তখন ডেপুটি ইলেকশন কমিশনার বিষয়টি তদন্ত করেন এবং তদন্ত করে তিনি বলেন যে নির্বাচনে অনিয়ম হয়েছে। একটা কেন্দ্রে নির্বাচনী অনিয়ম হয়েছে এবং এই রিপোর্টের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন পুনরায় নির্বাচনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু তার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা হলে হাইকোর্ট বিভাগ নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের পক্ষেই মত দিয়েছিলেন।

২০১৭ সালে এই রায় হাইকোর্টের আরেকটি রায়ে সমর্থিত হয়। ওই রায়ের ৩৪ প্যারাগ্রাফ-এ লেখা হয়েছে, আমাদের আপিল বিভাগ একাধিক্রমে তিনটি মামলায় ফেয়ার ইলেকশন যদি না হয়, তাহলে নির্বাচন কমিশনের কর্তৃত্ব কি হবে তা উত্তমরূপে পরীক্ষা করেছেন।

আপিল বিভাগ বলেছে, কোনো দরখাস্তকারী যদি কোনো নির্বাচনী অনিয়ম সম্পর্কে অভিযোগ করেন, আর নির্বাচন কমিশন যদি সে বিষয়ে নীরব থাকে, নির্বাচনী অনিয়মের বিষয়ে প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রকাশিত সংবাদের প্রতি যদি ইসি তার চোখ বন্ধ করে রাখে, তাহলে সেটা হবে স্পষ্টরূপেই ‘এ কেস অফ মেলিস।’ আর সে কারণে তা রিটের আওতায় হস্তক্ষেপের যোগ্য হয়ে উঠবে।

২০১৭ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারি মোহাম্মদ আবু বকর সিদ্দিক বনাম বাংলাদেশ ও অন্যান্য মামলায় বিচারপতি এম মোয়াজ্জাম হোসেন এবং বিচারপতি আমির হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই রায় দিয়েছেন।
২০১৬ সালে নোয়াখালীর সেনবাগের কৃষ্ণপুর ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন প্রসঙ্গে মামলাটি আদালতে এসেছিল। এই মামলায় দরখাস্তকারীর পক্ষে আইনজীবী ছিলেন সিনিয়র আইনজীবী ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন।
নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনে এই মামলায় অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন নির্বাচনের ফল বাতিল করে পাঁচটি কেন্দ্রে পুনরায় নির্বাচন দাবি করেছিলেন। হুমায়ুন বলেছিলেন এটা বোধগম্য যে কিশোরপুর ইউনিয়নের কোথাও সত্যিকারের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি।

অ্যাটর্নি জেনারেল এর বিরোধিতা করে দাবি করেছিলেন এই নির্বাচন নিয়ে এখন প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ নেই। কারণ ফল ঘোষণা করা হয়েছে।

লক্ষণীয় হাইকোর্ট বিভাগ এই বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত না দিয়ে সিদ্ধান্তের জন্য ইসির কাছে পাঠিয়েছিলেন।

Check Also

সাতক্ষীরা সীমান্ত থেকে ১০ বোতল ভারতীয় মদ জব্দ

মুহাম্মদ হাফিজ, সাতক্ষীরা : সাতক্ষীরা সীমান্তে মাদক বিরোধী বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে ১০ বোতল ভারতীয় …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।