সাতক্ষীরাসহ ১২ জেলায় সক্রিয় ছিল ঘুষ-প্রতারক চক্র

পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগ

বিভাগীয় তদন্ত ও শাস্তির মুখোমুখি শতাধিক পুলিশ সদস্য

ক্রাইমবার্তা রিপোটঃ

পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অন্তত ১২ জেলায় সক্রিয় ছিল প্রতারক ও ঘুষ চক্রের সদস্যরা, যারা লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে নিয়োগপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে। আবার অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার আগেই অনেকে ধরা পড়েছে কোনো কোনো জেলায়। প্রতারক চক্রের এসব সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে ১৮টি। এসব মামলায় এরই মধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে ৪০ জনকে। নিয়োগ-বাণিজ্যের সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ের শতাধিক পুলিশ সদস্যের সংশ্নিষ্টতার অভিযোগ উঠেছে। তাৎক্ষণিকভাবে বদলি ও প্রত্যাহার করা হয় তাদের। প্রাথমিক তদন্তের পর অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হবে।

গত ২২ জুন থেকে ৯ হাজার ৬৮০ জন ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল (টিআরসি) নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়। এটি সম্পন্ন হয় ৯ জুলাই। এবার পুলিশ কনস্টেবল পদে মনোনীত হয়েছেন ছয় হাজার ৮০০ পুরুষ ও দুই হাজার ৮৮০ নারী।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে অতিরিক্ত আইজিপি (হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর সুশাসন প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারের জায়গা থেকে এবার পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করতে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। যে কোনো অনিয়ম খুঁজে বের করতে পৃথক গোয়েন্দা টিম ছিল জেলায় জেলায়। নূ্যনতম কোনো অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার করে ধরা হয়েছে তাদের। পুলিশের শতাধিক সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এখন তাদের বিরুদ্ধে প্রাথমিক তদন্ত শুরু হয়েছে। এরপর পরবর্তী প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নিয়োগ-বাণিজ্যে জড়িত থাকার সন্দেহাতীত প্রমাণ মিললে চাকরিচ্যুতির বিধান রয়েছে।’ পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগ-বাণিজ্যে জড়িত থাকার ঘটনায় যেসব জেলায় মামলা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে টাঙ্গাইল, গাজীপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, বগুড়া, খুলনা, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, নড়াইল, কুষ্টিয়া, রংপুর ও গাইবান্ধা। এই ১২ জেলায় দায়ের করা ১৮টি মামলায় ৪০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এর মধ্যে বগুড়া জেলায় পাঁচটি মামলা করা হয়। দুটি করে মামলা হয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও খুলনায়। অন্য জেলায় একটি করে মামলা হয়েছে। দণ্ডবিধির ৪০৬, ৪১৭ ও ৪২০, ১৭০ ও ১০৯, ৩৪ ধারায় এসব মামলা করা হয়। প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকলে সাধারণত এসব ধারায় মামলা করা হয়ে থাকে।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে আরও জানা গেছে, পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত করতে শুরু থেকে বেশ কিছু ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর অংশ হিসেবে সব জেলার পুলিশ সুপার ও রেঞ্জ ডিআইজিদের পুলিশ সদর দপ্তরে ডেকে করণীয় সম্পর্কে দেওয়া হয় দিকনির্দেশনা। যে কোনো দুর্নীতি ও অনিয়ম রোধে প্রয়োজনীয় সব উদ্যোগ গ্রহণের নির্দেশনা দেন নীতিনির্ধারকরা। এ ছাড়া ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমেও দেওয়া হয় কিছু নির্দেশনা। দালাল ও অসাধু চক্রের মাধ্যমে প্রতারণার শিকার না হতে চাকরিপ্রত্যাশীদের দেওয়া হয় পরামর্শ। গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয় সচেতনতামূলক সংবাদ। কনস্টেবল নিয়োগ কার্যক্রম শুরুর আগেই পুলিশ মহাপরিদর্শক সব রেঞ্জের ডিআইজি ও পুলিশ সুপারদের পুলিশ সদর দপ্তরে ডেকে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে কঠোর নির্দেশনা প্রদান করেন। ৬৪ জেলায় কয়েকটি স্তরে নজরদারি রাখা হয়। এসব টিমে দায়িত্ব পালন করে পুলিশ ইন্টারনাল ওভারসাইট, রেঞ্জ ডিআইজির নজরদারি কমিটি, পুলিশ সদর দপ্তরের একজন পুলিশ সুপার (এসপি) ও একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের সমন্বয়ে গঠিত ৬৪টি বিশেষ টিম।

১০৩ টাকায় যাতে পুলিশ কনস্টেবল পদে চাকরি পান- এ লক্ষ্যে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও কোনো কোনো জেলায় প্রতারক চক্রের সদস্যরা সক্রিয় ছিল। আবার পুলিশের অসাধু সদস্যরা কিছু কিছু এলাকায় ঘুষ-বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়ে, এমন অভিযোগও ওঠে। কোনো কোনো জেলায় রাজনৈতিক নেতারা তদবির করেন। তাদের চাপ ও তদবির সামলাতেও হিমশিম খেতে হয়।

কনস্টেবল নিয়োগ-বাণিজ্যে জড়িত থাকায় ২৪ জুন পুলিশ সদর দপ্তর থেকে বিশেষ অভিযান চালিয়ে মাদারীপুরের পুলিশ সুপার সুব্রত কুমার হালদারের দেহরক্ষী পুলিশ সদস্য নুরুজ্জামান সুমনকে ঘুষের টাকাসহ আটক করা হয়। পুলিশ লাইন্সের মেস ম্যানেজার জাহিদ হোসেন, টিএসআই গোলাম রহমান এবং পুলিশ হাসপাতালের স্বাস্থ্য সহকারী পিয়াস বালার কাছ থেকেও ঘুষের টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে প্রায় ৭২ লাখ টাকা জব্দ করা হয়েছিল। এ ঘটনায় তদন্তের মুখোমুখি হচ্ছেন মাদারীপুরের পুলিশ সুপার।

এ ছাড়া নিয়োগ-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বরখাস্ত করা হয়েছে কুড়িগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার কার্যালয়ের হিসাবরক্ষক আবদুল মান্নান ও উচ্চমান সহকারী ছকমল এবং রংপুর ডিএসবির এএসআই রুহুলকে। তাদের কাছ থেকে ঘুষের ২৩ লাখ টাকা জব্দ করা হয়। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রিপন কুমার মোদককে খাগড়াছড়ি ও এসআই আবু তালেবকে বরিশাল রেঞ্জে বদলি করা হয়। রংপুর ডিএসবি শাখার এএসআই রুহুলকে ১০ লাখ টাকাসহ আটক করা হয়েছিল কুড়িগ্রামে। এ ছাড়া পুলিশ সুপার কার্যালয়ের চালক সাইদুর রহমান সায়েম ও রেশন স্টোরের ওজনদার আনিছুর রহমানকে ডিআইজি অফিসে প্রত্যাহার করা হয়েছে। টাঙ্গাইলে কনস্টেবল পদে চাকরি দেওয়ার কথা বলে ১০ লাখ টাকা লেনদেনের অভিযোগে এসআই মোহাম্মদ আলী ও শাহানাতুল আরেফিন সুমি নামের দু’জন গ্রেফতার হয়। এ ছাড়া নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনৈতিক প্রভাব রাখতে গিয়ে ঝিনাইদহ পুলিশের কনস্টেবল আবদুল হাকিম সাময়িক সাসপেন্ড হন।

অভিযোগ আছে, পুলিশের নিয়োগকে কেন্দ্র করে একটি সংঘবদ্ধ গ্রুপ অতীতে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিত। পুলিশের কিছু অসাধু সদস্য, বহিরাগত দালাল, রাজনৈতিক নেতা ও প্রতারকরা এ চক্রে থাকত। নিয়োগ ঘিরে দীর্ঘদিনের সিন্ডিকেট ভাঙতে এবার নানা ধরনের কার্যক্রম হাতে নেয় পুলিশ। কোনো কোনো জেলায় এটা সফল হলেও কোথায়ও আবার শর্ষের মধ্যে ভূত ধরা পড়ে। কোনো কোনো জেলায় আবার ১০৩ টাকার চাকরি পেয়ে অনেকের চোখে দেখা যায় আনন্দাশ্রু।

Check Also

সাতক্ষীরায় ৪ গ্যালন ফরমালিন পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার

নিজস্ব প্রতিনিধি: সাতক্ষীরা থানা পুলিশ অভিযান চালিয়ে ৪ গ্যালন ফরমালিন পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার করেছে। তবে এসময় …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।