ক্রাইমবার্তা রিপোটঃ উত্তরাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন বানভাসি মানুষ। পানিবন্দি পরিবারগুলোর মধ্যে দেখা দিয়েছে খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি, স্যানিটেশনের অব্যবস্থা, গোখাদ্য সংকট। ত্রাণের জন্য হাহাকার করছে বন্যাদুর্গতরা। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা। কোথাও কোথাও পানি কমলেও বাড়ছে দুর্ভোগ। এদিকে জামালপুরের বকশীগঞ্জে বন্যার পানিতে ডুবে ৫ জন নিহত হয়েছে। বিস্তারিত আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো রিপোর্টে-
উত্তরাঞ্চল প্রতিনিধি জানান, গাইবান্ধার ব্রহ্মপুত্র ও ঘাঘট নদীর পানি কিছুটা কমলেও এখনও বিপদসীমার অনেক উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
ফলে জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। নদীর বাঁধ ভাঙা পানি এখনো নতুন নতুন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে। তবে বন্যাকবলিত এলাকার পানিবন্দি পরিবারগুলোর মধ্যে খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি সংকট, স্যানিটেশনের অব্যবস্থা, গবাদিপশুর খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, গাইবান্ধা ও গোবিন্দগঞ্জ পৌরসভা এবং ৪৯টি ইউনিয়নের ৩৮৩টি গ্রাম বন্যাকবলিত হয়ে পড়ায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৮৫ হাজার ৩২৮ জন। ৪৪ হাজার ৭৯২টি বসতবাড়ি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৮০টি আশ্রয় কেন্দ্রে ৭৪ হাজার ১০৪ জন অসহায় মানুষ আশ্রয় নিয়ে আছে। জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, এ পর্যন্ত জেলায় ১ হাজার ১৫০ টন চাল, ২০ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং ৬ হাজার শুকনো খাবারের প্যাকেট ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া গেছে। সেখান থেকে ইতিমধ্যে ৯৫০ টন চাল, ১০ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং ৫ হাজার ৬০০ শুকনো খাবার দুর্গত মানুষের মধ্যে বিতরণ কাজ চলছে।
এদিকে গাইবান্ধা সদর উপজেলার গোদারহাট, কুঠিপাড়া, কোনারপাড়া, ধুতিচোরা, বাগুড়িয়া ও কামারজানি এলাকার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি সরজমিনে পরিদর্শন ও বন্যা দুর্গত মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় শেষে গিদারী ইউনিয়নের গোরাইন গ্রামে বন্যার্ত পরিবারের মাঝে ত্রাণসামগ্রী (খাবারের কার্টুন, পানি বিশুদ্ধিকরণ ট্যাবলেট ও জ্যারিকেন) বিতরণ করেন জেলা প্রশাসক মো. আবদুল মতিন।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, রোববার ব্রহ্মপুত্রের পানি কিছুটা হ্রাস পেয়ে বিপদসীমার ১০১ সে.মি. এবং ঘাঘট নদীর পানি বিপদসীমার ৫৩ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এছাড়া করতোয়া নদীর পানি নতুন করে বৃদ্ধি না পেলেও এখনও বিপদসীমার ৩ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
চিলমারী (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, কুড়িগ্রামের চিলমারীতে পানি চারদিকেই থই থই পানি। বসতভিটায় বানের পানি নেই খাওয়ার পানি। প্রাণ বাঁচাতে মানুষ ঠাঁই নিয়েছেন, উঁচু সড়ক, বাঁধ রাস্তা, আশ্রয় কেন্দ্র কিংবা বাসাবাড়ির ছাদে। চারদিকে পানি আর পানি। তারপরও খাওয়ার মতো বিশুদ্ধ পানির জন্য চলছে হাহাকার। নেই স্যানিটেশন ব্যবস্থা। নেই থাকার জায়গা এর উপর আবার রয়েছে চরম খাদ্য সংকট। মানুষের মতো দুর্ভোগে পড়েছে গবাদিপশুও। বানভাসদের দুর্ভোগ এখন চরমে।
চৌহালী পানিবন্দি লাখো মানুষের বিড়ম্বনা
চৌহালী (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি: যমুনায় কিছুটা পানি কমতে শুরু করলেও সিরাজগঞ্জের চৌহালী ও এনায়েতপুর থানাজুড়ে বেড়েছে বন্যাদুর্ভোগ আক্রান্ত মানুষের হতাশা। গত ২৪ ঘণ্টায় নদীর পানি ২৫ সেন্টিমিটার কমে তা বিপদসীমার ৬৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যায় এ দুটি থানার ১০টি ইউনিয়নের অর্ধশতাধিক গ্রাম তলিয়ে যাওয়ায় লাখো মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। তাদের মধ্যে বিরাজ করছে হাহাকার। সদিয়া চাঁদপুর, স্থল, ঘোরজান, উমরপুর, খাসপুকুরিয়া, খাসকাউলিয়া, ইউনিয়নের অধিকাংশ এবং খুকনী, জালালপুর ইউনিয়নের যমুনা তীরবর্তী এলাকার ঘরবাড়ি ১ থেকে ৩ ফুট পানিতে তলিয়ে গেছে। এছাড়া নলকূপ তলিয়ে বিশুদ্ধ খাবার পানি ও খাদ্যের অভাব দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে অনেকেই এনায়েতপুর-পাঁচিল ওয়াপদা বাঁধে পলিথিন টাঙিয়ে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে। তারা এ বন্যায় দুর্বিষহ জীবন কাটালেও যথাযথ সহায়তা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেছেন। খোকশাবাড়িতে বাঁধে আশ্রয় নেয়া আবদুল আলীম, শের আলী জানান, আমরা বন্যায় কাজ হারিয়েছি। বাঁধে আশ্রয় নিলেও এখানে খেয়ে না খেয়ে চলছে আমাদের জীবন। এখন পর্যন্তও কেউ আমাদের খোঁজখবর নেয়নি।
ওসমানীনগরে বন্যার্তদের মধ্যে চাল বিতরণ
ওসমানীনগর (সিলেট) প্রতিনিধি জানান, সিলেটের ওসমানীনগরের বন্যাকবলিত সাদীপুর ইউনিয়নের দু’টি ওয়ার্ডে গরিব অসহায়দের মধ্যে চাল বিতরণ করা হয়েছে। গতকাল বিকালে সাদীপুর ইউনিয়নের বাংলাবাজার ও মোবারকপুর এলাকার ২ শতাধিক পরিবারের মধ্যে ১০ কেজি হারে চাল বিতরণ করা হয়। সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য শফিকুর রহমান চৌধুরী প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে ত্রাণের চাল বিতরণ করেন। এ সময় তিনি বন্যা আক্রান্ত লোকদের খোঁজ-খবর নেন। ত্রাণের চাল বিতরণে উপস্থিত ছিলেন- সাদীপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুর রব, আওয়ামী লীগ নেতা তফজ্জুল হোসেন, ফেরদৌস খান, মোস্তফা কামাল, ইসকন্দর আলী, শাহ ইসমাইল আলী, ওসমানীনগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের আহ্বায়ক চঞ্চল পাল, সিলেট জেলা যুবলীগ নেতা কিবরিয়া মিয়া, কয়ছর আহমদ, আজল মিয়া, আরজু মেম্বার, গণি মিয়া, ইমরান আহমদ, ইউপি সদস্য সোনা মিয়া গাজী, ইউপি সদস্য স্বপন মিয়া, উপজেলা ছাত্রলীগ নেতা নজরুল মিয়া প্রমুখ।
বকশীগঞ্জ (জামালপুর) প্রতিনিধি জানান, জামালপুরের বকশীগঞ্জে ভয়াবহ বন্যার পানিতে ডুবে আরো তিন শিশুসহ এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া নিখোঁজ হওয়া পান ব্যবসায়ীর মৃতদেহ উদ্ধার করেছে স্থানীয়রা।
গতকাল বাড়ির পাশে বন্যার পানিতে ভেলায় করে খেলতে গিয়ে দুই শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। এ সময় আহত হয়েছে আরো এক শিশু।
গতকাল দুপুর ২ টার দিকে বকশীগঞ্জ সদর ইউনিয়নের সূর্যনগর পূর্ব পাড়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গতকাল দুপুরে সূর্যনগর পূর্ব পাড়া গ্রামের শাহীন মিয়ার কন্যা ও হাসিনা গাজী উচ্চ বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণির ছাত্রী সজনী আক্তার (১১), শাহিনের সহোদর ভাই সলি মদ্দিনের কন্যা ও সূর্যনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩য় শ্রেণির ছাত্রী সাথী আক্তার (৮) ও মাসুদ মিয়ার কন্যা মৌসুমী আক্তার (৮) বাড়ির পাশে বন্যার পানিতে ভেলায় করে খেলতে যায়। ভেলায় খেলতে খেলতে হঠাৎ তারা ভেলাটি উল্টে পানিতে পড়ে গেলে সজনী আক্তার ও সাথী আক্তার মারা যায়। এ সময় পানিতে হাবুডুবু খেয়ে মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন মৌসুমী আক্তার।
পরে স্থানীয়রা আহত অবস্থায় মৌসুমীকে বকশীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে জামালপুর জেনারেল হাসপাতালে রেফার্ড করেন।
অপরদিকে মেরুরচর ইউনিয়নের রবিয়ারচর গ্রামের আবদুল শেখ (৭০) নামে এক বৃদ্ধের পানিতে ডুবে মৃত্যু হয়েছে। গতকাল বিকাল ৩টার দিকে তিনি তার ঘরের পেছনে বন্যার পানিতে গোসল করতে গিয়ে পানিতে পড়ে যান। কিছুক্ষণ পর তার লাশ পানিতে ভেসে উঠে।
এ ছাড়াও দুপুর ২টায় সাধুরপাড়া ইউনিয়নে কুতুবেরচর গ্রামে বন্যার পানিতে ডুবে ইয়াছিন মিয়ার ছেলে স্বাধীন মিয়া (৪) নামে আরো এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
এদিকে শুক্রবার থেকে নিখোঁজ হওয়া সুজন (২৫) নামে এক পান ব্যবসায়ীর মৃতদেহ উদ্ধার করেছে স্থানীয়রা। সুজন বকশীগঞ্জ পৌর এলাকায় সীমারপাড় গ্রামের শাহাজাহানের ছেলে। গত শুক্রবার বন্যার পানিতে গোসল করতে গিয়ে নিখোঁজ হয় সুজন। পরে ঘটনাস্থল থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে ফকিরপাড়া থেকে মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।
উল্লেখ্য, এবারের ভয়াবহ বন্যায় বকশীগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে পানিতে ডুবে, শিশু, বৃদ্ধ, কিশোরসহ ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়াও সাপের দংশনে আরো একজনের মৃত্যু হয়েছে।