রিফাতের আগে নয়নকে বিয়ে করেন মিন্নি, কাবিননামা প্রকাশ্যে

ক্রাইমর্বাতা রিপোট : বরগুনায় চাঞ্চল্যকর রিফাত শরীফ হত্যার রহস্যজট খুলছে।বেরিয়ে আসছে নৃশংস এই হত্যার নেপথ্য কারণগুলো। এই হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা সাব্বির আহমেদ ওরফে নয়ন বন্ডের সঙ্গে রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির সম্পর্কের গুঞ্জন আগে থেকেই ছিল। সেই সম্পর্কের সূত্র ধরেই দুজনের দ্বন্দ্বে খুন হন রিফাত।

এবার নয়ন বন্ড ও মিন্নির বিয়ের কাবিননামা প্রকাশ্যে এসেছে। যেটি তাদের বিয়ের প্রমাণ হিসেবে দাবি করছেন নয়ন বন্ডের পরিবার। তবে মিন্নির বাবার দাবি, এটি সাজানো নাটকেরই একটি বিশেষ দৃশ্যপট। মূলত মিন্নিকে ফাঁসাতে এসব গালগল্প তৈরি করা হচ্ছে।আর এসব নাটকের হোতা স্থানীয় সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর ছেলে সুনাম দেবনাথ। এই হত্যাকাণ্ডের নায়ক নয়ন বন্ড সুনামের লোক ছিলেন।

নয়ন ও মিন্নির বিয়ের রেজিস্ট্রি কাবিনের একটি কপি হাতে পেয়েছে যুগান্তর। এতে দেখা যায়, বরগুনা পৌরসভার ৪, ৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাজী আনিসুর রহমান ভূঁইয়া বিয়ের রেজিস্ট্রেশন করেন (রেজিস্ট্রেশন নম্বর ১৪৫/২০১৮)।

কাজীর দফতরে রক্ষিত বালাম বইয়ের ৯৬ নম্বর পৃষ্ঠায় পাত্র-পাত্রী ও সাক্ষীদের নামের ঘরে ছেলে পক্ষের ২ জন্য এবং মেয়ে পক্ষের ২ জন করে মোট চারজন সাক্ষীর নাম আছে। নয়নের পক্ষের দু’জন সাক্ষীর একজন হলেন রিফাত শরীফ হত্যা মামলার ২ নম্বর আসামি রিফাত ফরাজী।

আর মেয়ের পক্ষের সাক্ষীরা হলেন জান্নাতুল ফেরদৌস, পিতা জাহাঙ্গীর আলম। ঠিকানা আয়লা গুচ্ছগ্রাম। আরেকজন হলেন সাইফুল ইসলাম মুন্না, পিতা সহিদুল ইসলাম। ঠিকানা পশ্চিম কলেজ রোড।

বিয়ের কাজী আনিসুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, নয়ন বন্ড কয়েকজন বন্ধু-বান্ধবসহ তার কাজী অফিসে আসেন। তারা বিয়ের কথা বললে দু’পক্ষের অভিভাবক কোথায় জানতে চান। এ সময় নয়ন বলেন, তার বাবা বেঁচে নেই। মা ফোনে কথা বলবেন।

এরপর তার মাকে ফোন করে নয়ন বন্ড কাজীর সঙ্গে কথা বলতে বলেন। অপরদিকে মিন্নি বলেন, তার বাবা-মা আসতে পারছেন না। তার পক্ষে দু’জন সাক্ষী এনেছেন। এরপর কাজী বিয়ে পড়ান।

এই বিয়ে প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নয়নের মা সাহিদা বেগম যুগান্তরকে বলেন, ‘মিন্নি ও নয়ন কাজী অফিসে যাওয়ার পর কাজী মিন্নির চাচাকে ফোন করে বলেন, আপনার ভাতিজি এখানে বিয়ে করতে এসেছে। এরপর নানা জটিলতা তৈরি হয়। একপর্যায়ে ওইদিন আর কাজী অফিসে বিয়ে হয়নি।

তিনি বলেন, পরদিন ১৫ অক্টোবর ২০১৮ নয়ন বন্ডের বাড়িতেই তার সঙ্গে মিন্নির বিয়ে পড়ান কাজী। পরবর্তীতে রিফাত শরীফের সঙ্গে যখন মিন্নির দ্বিতীয় বিয়ে হয়, তখন নয়ন বন্ড জেলে। এক প্রশ্নের জবাবে সাহিদা বেগম বলেন, ‘নয়ন জেল থেকে বের হওয়ার পর মিন্নি আবার বাসায় আসতে শুরু করলে আমি নয়নকে বলি, এই তুই আরেকজনের বউকে নিয়ে ঘরে আস, তোর লজ্জা নাই? এর জবাবে নয়ন বলে, মা তুমি চুপ করো।’

পরবর্তীকালে রিফাত শরীফের সঙ্গে মিন্নির আনুষ্ঠানিক বিয়ে পড়ান বরগুনা সদরের কাজী এইচএম রহিম। কিন্তু এ বিষয়ে জানতে চাইলে নয়ন বন্ডের মা যুগান্তরকে বলেন, ওই বিয়ের বিষয়টি তারা জানতেন না। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার ছেলে যখন কাজী অফিসে গিয়ে মিন্নিকে বিয়ে করে তখন কাজী আমার সঙ্গে কথা বলেছিল।

এদিকে বিয়ের সাক্ষীদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের পাওয়া যায়নি। সূত্র বলছে, প্রভাবশালীদের চাপে সাক্ষীরা আত্মগোপনে চলে গেছে।

এই বিয়ের কাবিন প্রসঙ্গে মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হক কিশোর বলেন, এটা একটা সাজানো কাবিননামা। রিফাত খুনের পর তৈরি করা হয়েছে। এর কোনো ভিত্তি নেই।

প্রভাবশালীরা চাইলে কিনা করতে পারে। এমপি শম্ভুর বিরুদ্ধে কথা বলে পরিবারসহ আমি নিজেও জীবন নিয়ে সংশয়ের মধ্যে আছি। যে কোনোদিন আমিও নিহত হতে পারি। আমার ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলো স্কুলে পর্যন্ত যেতে পারছে না।

মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হক কিশোর যুগান্তরকে বলেন, নয়নের সঙ্গে মিন্নির বিয়ের বিষয়টি সাজানো নাটক ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ রিফাতের সঙ্গে মিন্নির বিয়ে গোপনে দেয়া হয়নি।

বিয়েতে কমপক্ষে এক থেকে দেড় হাজার লোককে দাওয়াত দেয়া হয়েছিল। স্থানীয় সাংবাদিক, রাজনীতিক থেকে শুরু করে সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ বিয়েতে এসেছিলেন। মিন্নির বাবা বলেন, এতগুলো মানুষ দাওয়াত খেতে এলো কই কেউই তো বলেনি নয়নের সঙ্গে তোমার মেয়ের বিয়ে হয়েছে, এখন আবার কেন বিয়ে দিচ্ছ।

রিফাতের বাবাও তো বলেননি আমার মেয়ের আগেই বিয়ে হয়েছে। তাছাড়া আমি তো রিফাতের সঙ্গে মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাইনি। রিফাতের পরিবারই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। কারণ রিফাত ও মিন্নি একে অপরকে পছন্দ করত। আমি প্রথমদিকে এই বিয়েতে রাজি ছিলাম না।

মিন্নির বাবা আরও বলেন, আসলে মিন্নিকে জেলে ঢোকানোর জন্য শম্ভুর ছেলে সুনাম দেবনাথ সর্বপ্রথম মিন্নির বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু করেন। নয়নের সঙ্গে মিন্নির বিয়ে হয়েছে বলে তিনি ফেসবুকে লেখেন। মিন্নিকে তিনি বিতর্কিত করতে চান। এর কারণ হল, মামলার এক নম্বর সাক্ষী মিন্নি। সে ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী।

সে যদি বাইরে থাকে তবে রিফাত হত্যার আসামিদের সবার বিরুদ্ধে সে সাক্ষী দেবে। তাহলে বিচারে তাদের শাস্তি নিশ্চিত। তাই যাতে মিন্নি সাক্ষী না দিতে পারে তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মিন্নিকে গ্রেফতার করে সরিয়ে দিলেই মামলা শেষ।

কারণ বিচার হয় সাক্ষীর ভিত্তিতে। আপনারা খোঁজ নিয়ে দেখেন, যারা রিফাতকে খুন করেছে তারা তো সবাই সুনাম দেবনাথের লোকজন। নয়ন বন্ড শম্ভুর লোক, এটা তো শহরের সবাই জানে।

প্রসঙ্গত বরগুনা সরকারি কলেজের মূল ফটকের সামনের রাস্তায় ২৬ জুন সকাল ১০টার দিকে স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির সামনে কুপিয়ে জখম করা হয় রিফাত শরীফকে। বিকাল ৪টায় বরিশালের শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়।

এ হত্যার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশব্যাপী তোলপাড় শুরু হয়। হত্যাকাণ্ডের পরের দিন রিফাত শরীফের বাবা আবদুল হালিম শরীফ বরগুনা থানায় ১২ জনকে আসামি করে মামলা করেন। এ ছাড়া সন্দেহভাজন অজ্ঞাতনামা আরও চার-পাঁচজনকে আসামি করা হয়। এ মামলার প্রধান আসামি নয়ন বন্ড ২ জুলাই পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। মামলার এজাহারভুক্ত ছয় আসামিসহ এ পর্যন্ত ১৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।এর মধ্যে ১৪ জনই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।

রিফাত হত্যা মামলার প্রধান সাক্ষী ও রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে গ্রেফতার ও রিমান্ডে গিয়ে তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়ার পর থেকে মামলা ভিন্ন দিকে মোড় নেয়।

১৬ জুলাই মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বরগুনার মাইঠা এলাকার বাবার বাসা থেকে মিন্নিকে জিজ্ঞাসাবাদ ও তার বক্তব্য রেকর্ড করতে বরগুনা পুলিশলাইনসে নিয়ে যায় পুলিশ। এর পর দীর্ঘ ১০ ঘণ্টার জিজ্ঞাসাবাদ শেষে রাত ৯টায় মিন্নিকে রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়।

পর দিন মিন্নিকে আদালতে হাজির করা হয়। আদালতে তার পক্ষে কোনো আইনজীবী ছিলেন না। আদালত মিন্নির পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর করেন আদালতের বিচারক মো. সিরাজুল ইসলাম গাজী।

পর দিন বৃহস্পতিবার বরগুনার পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন সংবাদ সম্মেলনে জানান, মিন্নি তার স্বামী রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। এ হত্যার পরিকল্পনার সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন।

গত শুক্রবার বিকালে মিন্নি একই আদালতে তার স্বামী রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। পরে আদালত তাকে জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

এদিকে মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হক কিশোরের দাবি, মিন্নির কাছ থেকে জোর করে জবানবন্দি নেয়া হয়েছে। তিনি এ হত্যা মামলার এক নম্বর সাক্ষীকে (মিন্নি) আসামি করা ও রিমান্ডে নেয়ার জন্য স্থানীয় সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুকে দায়ী করে আসছেন। শুক্রবার গণমাধ্যমকে তিনি বলেছিলেন, ‘সবকিছুই শম্ভু বাবুর খেলা। তার ছেলে সুনাম দেবনাথকে রক্ষা করার জন্য আমার মেয়েকে বলি দেয়া হচ্ছে।’ শম্ভুর ছেলে সুনামের বিরুদ্ধে কিশোরের অভিযোগ, তার জন্যই এতদিন মিন্নির পক্ষে আদালতে দাঁড়াননি আইনজীবীরা। এ নিয়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বহু সমালোচনার পর বরগুনা ও ঢাকার আইনজীবীদের একটি অংশ মিন্নির পক্ষে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন।

Check Also

সাতক্ষীরা পৌর ৪ নং ওয়ার্ড জামায়াতে ইসলামীর আমীরের শপথ

মাসুদ রানা, সাতক্ষীরা: বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সাতক্ষীরা শহর শাখার পৌর ৪ নং ওয়ার্ড জামায়াতে ইসলামীর …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।