* সবরকম পদক্ষেপ নেয়ার হুমকি পাকিস্তানের
* ইন্টারনেট ও ফোন নেটওয়ার্ক সচল হয়নি
ক্রাইমবার্তা ডেস্করিডোটঃ: ভারতের সংবিধানে অধিকৃত কাশ্মীরকে যে বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়েছিল, তা তুলে নেয়ার পর থেকে দেশের অন্যান্য জায়গার সঙ্গে অঞ্চলটির যোগাযোগ একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে।
গত রোববার সন্ধ্যা থেকে বন্ধ করা ইন্টারনেট ও টেলিফোন নেটওয়ার্ক এখনো সচল হয়নি; উপত্যকাটির বিভিন্ন সড়কে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাজার হাজার সদস্যের টহল অব্যাহত আছে।
বিবিসি বলছে, সংবিধানের ওই বিশেষ মর্যাদা বাতিলের ঘটনা কাশ্মীরজুড়ে তুমুল বিক্ষোভ ও প্রতিবাদের বিস্ফোরণ ঘটাবে বলে ধারণা করা হলেও মানুষ সেখানে কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে তার কোনো খবর মিলছে না।
স্থানীয় নেতারা এখনও আটকাবস্থাতেই আছেন।
১৯৪৭ এর পর থেকেই ভারত ও পাকিস্তান উভয়েই হিমালয় অঞ্চলের কাশ্মীরকে নিজেদের বলে দাবি করে এলেও নয়াদিল্লী ও ইসলামাবাদ এখন অঞ্চলটির আলাদা দুটি অংশের নিয়ন্ত্রক।
ভারতশাসিত অংশে দীর্ঘদিন ধরেই স্বাধীনতাকামী বিভিন্ন সংগঠনের তৎপরতাও দেখা গেছে, যাতে প্রাণ হারিয়েছে হাজার হাজার লোক।
শ্রীনগরে বিবিসির প্রতিনিধি আমির পীরজাদা গত সোমবার দিল্লীতে থাকা সহকর্মীদের সঙ্গে টেলিফোনে কাশ্মীরের পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন।
“রাজ্যের অন্য অংশে কী হচ্ছে কেউ জানে না। আমরা কারও সঙ্গে কথাও বলতে পারছি না। মানুষজন উদ্বিগ্ন- তারা জানে না কী ঘটছে; তারা জানে না কী ঘটতে যাচ্ছে,” বলেছেন তিনি।
ভারতের অন্যান্য অংশে থাকা কাশ্মীরিরাও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ না করতে পারার কথা জানিয়েছেন; বলেছেন উদ্বেগ আর আতঙ্কের কথা।
দিল্লীতে থাকা কাশ্মীরের এক শিক্ষার্থী জানান, তিনি পরিবারের সদস্যদের খোঁজ নিতে স্থানীয় থানাতেও ফোন দিয়েছেন; কিন্তু তাতেও লাভ হয়নি।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ভারতশাসিত কাশ্মীরের জনগণের অনেকেই এতদিন সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদের কারণেই ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত থাকার যৌক্তিকতা খুঁজে নিত।
কিন্তু বিজেপি সরকার আইনি বাধ্যবাধকতাসহ সংবিধানের এ বিশেষ মর্যাদা তুলে নিয়ে দিল্লীর সঙ্গে এ এলাকার সম্পর্ককে একেবারে খাদের কিনারায় নিয়ে গেছে।
৩৭০ অনুচ্ছেদ জম্মু ও কাশ্মীরকে অনেক ক্ষেত্রেই স্বায়ত্তশাসন দিয়েছিল; এ অনুচ্ছেদের ফলে কাশ্মীরিদের নিজস্ব সংবিধান, আলাদা পতাকা ও স্বতন্ত্র আইন বানানোর অধিকার ছিল। রাজ্যটির কেবল পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে।
ওই অনুচ্ছেদের বলেই কাশ্মীর স্থায়ী বাসিন্দা নির্ধারণ, সম্পত্তির মালিকানা ও মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত আলাদা আইন তৈরি করেছিল। সেসব আইনে ভারতের অন্য এলাকার বাসিন্দাদের কাশ্মীরের জমি-সম্পদ ক্রয় কিংবা এখানে স্থায়ীভাবে বসবাসে নিষেধাজ্ঞা ছিল।
পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত নিয়ে উত্তেজনা ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের তৎপরতার কারণে উপত্যকাটিতে এমনিতেই বিপুল পরিমাণ সেনা মোতায়েন থাকতো। গত সোমবার ভারতের রাজ্যসভায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ অনুচ্ছেদ ৩৭০ বাতিল করার পর সেখানে আরও সৈন্য পাঠানো হয়।
পর্যটক এবং হিন্দু তীর্থযাত্রীদের আগেই এলাকাটি ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়; স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখা হয়। এভাবে পরিকল্পনা বিষয়ে সামান্য ইঙ্গিত না দিয়েই ভারত সরকার তড়িঘড়ি করে ওই অনুচ্ছেদটি বাতিল করে দেয়।
পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে বিবেচনায় নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা গত কয়েক মাস ধরেই খাদ্য মজুদ করে রাখছিল বলে ওই এলাকার সাংবাদিকরা জানিয়েছেন।
রোববার রাতেই কাশ্মীরের দুই সাবেক মুখ্যমন্ত্রীকে গৃহবন্দি করা হয়; ইন্টারনেট ও টেলিফোন যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর থেকে ওই এলাকা কার্যত একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে; সেখানকার পরিস্থিতি কিংবা সেখানে কী ঘটছে কিছুই জানা যাচ্ছে না।
টেলিফোন ও ইন্টারনেট যোগাযোগ কখন চালু হবে এ বিষয়ে কোনো ইঙ্গিত না মিললেও ওই এলাকায় লোকজনকে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে বলে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
কাশ্মীরকে ফিলিস্তিন বানাতে চাইছে মোদি সরকার?
ভারতের সংবিধানে কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসনের যে নিশ্চয়তা ছিল, মোদি সরকার ৩৭০ ধারা বাতিল করার পর এর অন্তর্গত ৩৫-এ অনুচ্ছেদে বর্ণিত কাশ্মীরিদের বিশেষ সুবিধাও বাতিল হয়ে গেছে বলে মনে করা হচ্ছে। ‘৩৫-এ’ অনুযায়ী কাশ্মীরের বাসিন্দা নন এমন ভারতীয়দের সেখানে সম্পদের মালিক হওয়া ও চাকরি পাওয়ায় বাধা ছিল। মোদি সরকারের সিদ্ধান্তে সেই বাধা দূর হয়েছে। এখন চাইলেই যে কোনও ভারতীয় নাগরিক সেখান ভূমিসহ অন্যান্য সম্পদ কিনতে সক্ষম হবে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, এই অনুচ্ছেদে বর্ণিত কাশ্মীরিদের বিশেষ সুবিধা অকার্যকর করার মধ্য দিয়ে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীরের জনসংখ্যাতাত্ত্বিক চরিত্রে পরিবর্তন আনতে চাইছে বিজেপি। বিশ্লেষকদের মতে, মোদি সরকার আদতে কাশ্মীরে হিন্দু বসতি ও শিল্প গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায়কে হুমকির মুখে ঠেলে দিতে চাইছে। এই সিদ্ধান্তকে তাই ফিলিস্তিনি ভূখ-ের প্রশ্নে ইসরাইলি নীতির সঙ্গে তুলনা করছেন কেউ কেউ। তারা বলতে চাইছেন, কাশ্মীরকে ফিলিস্তিন বানানোর পাঁয়তারা করছে হিন্দুত্ববাদী সরকার।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন-এর এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, সাধারণত এমন সাংবিধানিক পরিবর্তনের জন্য রাজ্যের স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমঝোতার প্রয়োজন হয়। তবে জম্মু-কাশ্মীরে এখন কেন্দ্রীয় শাসন চলছে। গত জুনে মেহবুবা মুফতির পিডিসি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার থেকে নিজেদের সমর্থন প্রত্যাহার করে বিজেপি। আর তখনই রাজ্যটি সরাসরি কেন্দ্রের শাসনাধীন হয়। জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হ্যাপিমন জ্যাকব সিএনএনকে বলেছেন, এই কেন্দ্রীয় শাসন জারির মধ্য দিয়েই জম্মু-কাশ্মীরের সুরক্ষাকবচ হিসেবে সংবিধানে থাকা ৩৭০ ধারা বাতিলের পথ করে নিয়েছে বিজেপি সরকার।
জ্যাকব মনে করেন, যেভাবে প্রেসিডেন্সিয়াল ডিক্রির মধ্য দিয়ে ৩৭০ ধারার বিলোপ করা হয়েছে, তার আইনত ভিত্তি দুর্বল। তিনি বলেন, ‘আদালতে এই আদেশ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে, তবে আমার মনে হয় না বিজেপি সেটা নিয়ে চিন্তিত। যেনতেনভাবে তারা এই সিদ্ধান্ত বহাল রাখবে এবং এই বাস্তবতা দীর্ঘ হবে। এই দীর্ঘ সময়কে কাজে লাগিয়ে বিজেপি রাজ্যটাকে ব্যাপকভাবে বদলে ফেলার চেষ্টা করবে। এখন আইনত সেখানে কোনও বিরোধী নেই। কেবলমাত্র গভর্নর আছেন যিনি এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতার এখতিয়ার রাখেন। তবে তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিয়োজিত।’
৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের পাশাপাশি জম্মু-কাশ্মীরের প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে রাজ্য থেকে কেন্দ্রীয় শাসিত অঞ্চলে পরিণত করার বিল পাস করেছে বিজেপি সরকার। ভারতীয় বিধি অনুযায়ী, স্থানীয় সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারই গুরুত্বপূর্ণ কর্তৃপক্ষীয় ভূমিকা পালন করার এখতিয়ারভুক্ত। তবে কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে কেন্দ্রীয় সরকারই শাসনব্যবস্থার মূল নিয়ন্ত্রক। সোমবার কাশ্মীরকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করতে একটি বিল ভারতের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষে পাস হয় এবং শিগগিরই এটি নিম্নকক্ষে তোলা হবে। জ্যাকব বলেছেন, ‘একটি রাজ্যকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করার দৃষ্টান্ত নজিরবিহীন। তবে জম্মু-কাশ্মীরের রাজনীতির আমূল ও মৌলিক পরিবর্তন সত্যিই বিস্ময়কর। একবার একটি রাজ্য কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত হলে সেখানকার রাজ্যসভার আর সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো ক্ষমতা থাকে না।’
বিজেপি সরকারের এই পদক্ষেপ অনুযায়ী, জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের অংশ দূরবর্তী পার্বত্য অঞ্চল লাদাখ আলাদা হয়ে যাবে এবং কেন্দ্রীয় শাসিত পৃথক অঞ্চলে পরিণত হবে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের খবরে বলা হয়েছে, কাশ্মীরিদের একটা বড় অংশ মনে করছে, মোদি সরকারের এই সিদ্ধান্ত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীরের বিদ্যমান জনমিতির সুরক্ষাকে হুমকির মুখে ফেলবে। সরকারের এক সূত্রকে উদ্ধৃত করে গার্ডিয়ানের খবরে বলা হয়েছে, কাশ্মীরের বিদ্যমান ভূমির মালিকানার নীতি সেখানকার উন্নয়নের পথে যে প্রতিবন্ধকতা আকারে হাজির ছিল, কাশ্মীরের বিশেষ অধিকার বাতিলের মধ্য দিয়ে সেই পথ প্রশস্ত হবে। তবে লস অ্যাঞ্জেলস টাইমসের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, বিশেষ অধিকার বাতিল হলে তুষারে আচ্ছাদিত ভূস্বর্গে হিন্দু সেটেলারদের বসতি গড়ার পথ প্রশস্ত হবে, হ্রাস পাবে মুসলিম জনসংখ্যা। একে সমালোচকরা ফিলিস্তিনি ভূমিতে ইহুদি বসতি স্থাপনের অন্যায্যতার সঙ্গে তুলনা করছেন। মুসাদির আমিন নামের কাশ্মীরভিত্তিক একজন বিশ্লেষক ওই সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘এই সিদ্ধান্তের উদ্দেশ্য কাশ্মীরের জনসংখ্যাতাত্ত্বিক অবস্থাকে বদলে দেওয়ার প্রচেষ্টা যা কেবল সংঘাতকেই আরও ত্বরান্বিত করবে।’
রুশ বংশোদ্ভূত মার্কিন বিশ্লেষক অ্যান্ড্রু কারিবকো বলছেন, যেমন করে ইসরাইল ফিলিস্তিনি ভূমিতে অর্ধলক্ষ সেনা-সমাবেশ ঘটিয়েছে, কারফিউ জারির পাশাপাশি স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর ধারাবাহিক গ্রেফতার-নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে, যেমন করে সেখানকার স্বায়ত্তশাসন কেড়ে নেওয়া হয়েছে, গাজাকে পশ্চিমতীর থেকে পৃথক করে আলাদা প্রশাসনিক অঞ্চল বানানো হয়েছে, কাশ্মীরের ক্ষেত্রেও ভারত তাই করতে চলেছে। পশ্চিমতীরে যেমন করে অবৈধ ইসরায়েলি বসতি স্থাপনের বন্দোবস্ত করা হয়েছে, [৩৭০ ধারা বাতিলের মধ্য দিয়ে] তেমনি করে কাশ্মীরেও হিন্দুত্ববাদীরা অবৈধ বসতি স্থাপনের সুযোগ সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে। কারিবকো বলছেন, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক স্বীকৃত ওই বিতর্কিত ভূমির জনসংখ্যাগত চরিত্র বদলে দেওয়ার পাঁয়তারা চলছে।
কাশ্মীরীদের খাদের কিনারায় ঠেলে দেয়া হয়েছে -অ্যামনেস্টি
কাশ্মীরের মর্যাদা পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত রাজ্যটিতে সহিংসতা বাড়াতে পারে বলে ভারতকে সতর্ক করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। সোমবার লন্ডনভিত্তিক মানবাধিকার গ্রুপটির এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ভারতের পদক্ষেপ সেখানকার অস্থিরতার কারণ হতে পারে আর বিক্ষোভ ব্যাপক আকার ধারণ করতে পারে। গত কয়েক দিনের পরিস্থিতিতে কাশ্মীরিদের খাদের কিনারায় ঠেলে দেওয়া হয়েছে বলে মন্তব্য করা হয় ওই বিবৃতিতে।
সর্ব ভারতীয় অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রধান আকর পাটেল বলেন, ‘গত কয়েক দিন ধরে কাশ্মীর প্রত্যক্ষ করছে- অতিরিক্ত হাজার হাজার নিরাপত্তা সদস্য মোতায়েন, টেলিফোন ও ইন্টারনেট সুবিধা বন্ধ, শান্তিপূর্ণ সমাবেশে নিষেধাজ্ঞা- জম্মু কাশ্মীরের মানুষদের খাদের কিনারায় ঠেলে দিয়েছে’।
স্থানীয় জনগণের সঙ্গে কোনও ধরণের আলোচনা ছাড়াই পার্লামেন্টে ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করা হয়েছে উল্লেখ করে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, গুরুত্বপূর্ণ গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিবিদদের গৃহবন্দি করে পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে ফেলা হয়েছে। জম্মু কাশ্মীরের মানুষের সম্পৃক্ততা ছাড়া সেখানকার নিপীড়ন বন্ধ করা যাবে না বলেও মন্তব্য করেন আকর পাটেল।
ওই বিবৃতিতে তিনি বলেন, অনির্দিষ্ট সময় ধরে জম্মু কাশ্মীরের টেলিযোগাযোগ সেবা বন্ধ রাখা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এসব বন্ধ থাকার কারণে কাশ্মীরের জনগণের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানার, জানানোর সক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এগুলো বাকস্বাধীনতার অখন্ড অংশ।
জম্মু-কাশ্মীর নিয়ে মুখ খুলল আমেরিকা
ভারত-পাকিস্তান দু’দেশকেই নিয়ন্ত্রণরেখায় শান্তি বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছে আমেরিকা। সেই সঙ্গে জম্মু-কাশ্মীরে ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের বিষয়টির উপর নজর রাখছে বলেও তারা জানিয়েছে। সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে মার্কিন বিদেশ দফতরের মুখপাত্র মর্গ্যান অট্রাগাস বলেন, “দু’দেশকেই বলেছি নিয়ন্ত্রণরেখায় যেন শান্তি বজায় রাখে তারা।”
৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল এবং জম্মু-কাশ্মীরের প্রশাসনিক বিভাজন নিয়ে সোমবারই রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ সদস্যÑ চিন, আমেরিকা, রাশিয়া, ফ্রান্স এবং ব্রিটেনকে গোটা বিষয়টি জানিয়েছিল ভারত। তাদের কাছে স্পষ্ট করে দেওয়া হয়, বিষয়টি সংসদের বিবেচনাধীন এবং একেবারেই ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। কোনও আন্তর্জাতিক আইন ভাঙা হয়নি। সুশাসন, সামাজিক ন্যায় এবং জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখের আর্থিক উন্নয়নই এর মূল লক্ষ্য। ফলে গত সোমবার বিকেল পর্যন্ত কোনও দেশকেই এ ব্যাপারে মুখ খুলতে দেখা যায়নি।
যে মার্কিন প্রসিডেন্টের মুখে কাশ্মীর নিয়ে মধ্যস্থতার কথা শোনা গিয়েছিল, সেই ডোনাল্ড ট্রাম্পও নীরব। যদিও সোমবার রাতের দিকে আমেরিকার বিদেশ দফতর থেকে জম্মু-কাশ্মীর নিয়ে প্রতিক্রিয়ায় বলা হয়, গোটা পরিস্থিতির উপর নজর রাখছে তারা। জম্মু-কাশ্মীরের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন অট্রাগাস। তিনি বলেন, “জম্মু-কাশ্মীরে আটকের ঘটনা ঘটছে, এমন রিপোর্টও আসছে। বিষয়টা নিয়ে উদ্বিগ্ন আমরা।” কোনও ভাবেই যাতে সেখানে ব্যক্তি অধিকার খর্ব না হয় সে দিকটা নজর রাখতে বলা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন অট্রাগাস।
অন্য দিকে, রাষ্ট্রপুঞ্জও জম্মু-কাশ্মীরের গোটা বিষয়টির উপর নজর রাখছিল। ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলকে ঘিরে যে উত্তেজনার আবহ তৈরি হয়েছে তা নিয়ে ভারত-পাকিস্তান দু’দেশকেই সংযত থাকার পরামর্শ দিয়েছেন রাষ্ট্রপুঞ্জ প্রধান আন্তোনিয়ো গুতেরেস। ব্রিটেন, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়ার মতো কয়েকটি দেশ তাদের নাগরিকদের নিরাপত্তার স্বার্থে সতর্কবার্তা দিয়েছে। তাদের আশঙ্কা, কাশ্মীর উপত্যকা ফের অশান্ত হয়ে উঠতে পারে।
কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা প্রত্যাহার কলকাতায় বিক্ষোভ
কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা প্রত্যাহার এর বিরুদ্ধে সোমবার বিকেলে কলকাতা প্রেসক্লাবের সামনে বিক্ষোভ করলো ভাষা ও চেতনা সমিতি। এই বিক্ষোভে সামিল হয়েছিলেন ভাষা ও চেতনা সমিতির আহ্বায়ক ইমানুল হক ও বিশিষ্ট আইনজীবী, কলকাতার সাবেক মেয়র বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্যসহ জাতি ধর্ম নির্বিশেষে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ।
সাবেক মেয়র বিকাশ রঞ্জন বাবু বলেন, আজকে যে কাজটা ওরা করলেন তার প্রকৃতপক্ষে কাশ্মীরে বিচ্ছিন্নতাবাদকে নতুন করে জন্ম দিলেন। ওরা ভুলে গেলেন যে, কাশ্মীরের সঙ্গে ভারতবর্ষের সংযুক্তিকরণ যখন হয় তখন একটি চুক্তির ভিত্তিতে হয়। কাশ্মীর একটা স্বাধীন দেশ ছিল। ভারতের সঙ্গে তাদের সংযুক্তিকরণ করেন এই শর্তে যে তাদের কিছু কিছু বিশেষ সুবিধা রাখতে হবে। আজকে ধরুন সিকিম যে ভারতবর্ষের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, তখনও চুক্তি হয়েছে সিকিমকে কিছু বিশেষ সুবিধা দিতে হবে। সেই চুক্তি যদি ভঙ্গ করা হয় তাহলে কি ভারতবর্ষের প্রতি সেই সব ছোট ছোট রাজ্য যারা একসময় যুক্ত হয়েছিল তারা আস্থা রাখতে পারবে? তারা বিচ্ছিন্নতাবাদের জন্ম দেবে। এখন যদি কাশ্মীরি জনগণ বলেন ৩৭০ ধারা নেই তাহলে আমরা আর ভারতবর্ষের সঙ্গে থাকতে রাজি নই কেন? ভারতবর্ষের সঙ্গে আমাদের সংযুক্তির মূল ভিত্তি চলে গেছে। তাই তারা উৎসাহিত হবে। বিদেশী শত্রুরা তাদের উৎসাহিত করবে। প্রকৃতপক্ষে মোদি-অমিত শাহ ভারতবর্ষকে টুকরো টুকরো করার পরিকল্পনাটা সেরে ফেললেন। এটা আসলে প্রকৃতপক্ষে ভারতবর্ষকে টুকরো টুকরো করে দেওয়ার একটা নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে আর এস এস এগোচ্ছে তাদের হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। এক ভয়াবহ বিপদজনক জায়গায় আমরা দাঁড়িয়ে আছি।
কাশ্মীর ইস্যুতে সবরকম পদক্ষেপ নেয়ার হুঁশিয়ারি পাকিস্তানের
জম্মু ও কাশ্মীর নিয়ে ভারতের ৩৭০ ধারা বাতিলের অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত মেনে নেয়া হবে না বলে ‘হুমকি দিয়ে’ মুখ খুলেছে পাকিস্তান। কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা সংক্রান্ত ভারতীয় সংবিধানের ওই ধারা বাতিল করার পরপরই এ হুমকি দেয় ইমরান সরকার।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, কাশ্মীরের ব্যাপারে পাকিস্তান তার অবিচল প্রতিশ্রুতি আবারও নিশ্চিত করবে।
‘আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিতর্কিত অঞ্চলের অংশীদার হিসেবে ভারতের ওই অযৌক্তিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য সব ধরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।’
সোমবার রাজ্যসভায় পাশ হয়েছে ৩৭০ ধারা বাতিলের বিলটি। এতে জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখ আলাদা কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে পরিণত হল। আজ বুধবার এটি লোকসভায় পাশ হলেই রাজ্যের মর্যাদা হারিয়ে কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে পরিণত হতে যাচ্ছে কাশ্মীর।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘‘জম্মু ও কাশ্মীর নিয়ে ভারতের সরকারের নেয়া ওই পদক্ষেপকে পাকিস্তান নিন্দা জানিয়ে প্রত্যাখান করেছে। ওই অঞ্চল আন্তর্জাতিকভাবেই বিতর্কিত অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। তাই ওই অঞ্চল নিয়ে ভারত সরকারের একতরফা সিদ্ধান্ত মেনে নেয়া হবে না। জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলের দেয়া রেজুলেশনের কথা মনে করিয়ে দিয়ে বলা হয়, ভারত সরকারের ওই সিদ্ধান্ত কাশ্মীর ও পাকিস্তানের জনগণ কখনো গ্রহণ করবে না।’
কাশ্মীর ইস্যুতে বিশ্বের সমর্থন চাইছে পাকিস্তান, তুরস্ক-মালয়েশিয়ার ইতিবাচক আশ্বাস
কাশ্মীর ইস্যুতে ভারতের সিদ্ধান্ত আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা নষ্ট করবে বলে মনে করে পাকিস্তান। সোমবার ভারতের রাজ্যসভায় কাশ্মীরের সায়ত্তশাসন বাতিলের পর পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, দিল্লীর এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করতে সম্ভাব্য সব ব্যবস্থা নেবে ইসলামাবাদ। একই দিন বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধানের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ করেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। ভারতের সিদ্ধান্তকে অবৈধ আখ্যা দিয়ে কাশ্মীর ইস্যুতে তাদের সমর্থন প্রত্যাশা করেন তিনি। এতে সমর্থন দেওয়ার কথা জানিয়েছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেব এরদোয়ান ও মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ। পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম এক্সপ্রেস ট্রিবিউন এই খবর জানিয়েছে।
পরমাণু শক্তিধর দুই দেশ ভারত ও পাকিস্তান উভয়ই কাশ্মীরকে নিজেদের বলে দাবি করে। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা পাওয়ার পর দুই প্রতিবেশীর তিনটি যুদ্ধের মধ্যে দুটি সংঘটিত হয়েছে কাশ্মীর ইস্যুতে। এক সামরিক নিয়ন্ত্রণরেখা দিয়ে কাশ্মীরকে বিভক্ত করে রাখা হয়েছে। ভারতের শাসনে রয়েছে ৪৫ শতাংশ এলাকা আর পাকিস্তান শাসন করে ৩৫ শতাংশ অঞ্চল। আর বাকি অঞ্চল শাসন করে চীন।
কাশ্মীর নিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে পাকিস্তানের অভিযোগ
জম্মু-কাশ্মীরের সাংবিধানিক মর্যাদা বাতিলসহ উপত্যকায় সেনা বাড়ানো এবং কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রীদের গৃহবন্দি করা নিয়ে উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিষয়ে জাতিসংঘে ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়েছে পাকিস্তান।
জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসকে লেখা চিঠিতে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশি আনুষ্ঠানিকভাবে এ অভিযোগ জানান।
খবরে বলা হয়, জাতিসংঘ মহাসচিবকে লেখা চিঠিতে জম্মু-কাশ্মীরের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি ও সীমান্তে ভারতীয় বাহিনীর তৎপরতা সম্পর্কে অবহিত করেন পাক পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
চিঠিতে মাহমুদ কোরেশি বলেন, কাশ্মীরি জনগণের সাংবিধানিক অধিকার হরণ করে ভারত সরকার উপত্যকাটির নাগরিকদের ওপর ব্যাপক নির্যাতন চালাচ্ছে। এছাড়া ভারতীয় বাহিনী কাশ্মীর সীমান্তে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্ডার অ্যাকশন টিমের সদস্যদের টার্গেট করে গুলি চালাচ্ছে বলেও অভিযোগ করা হয়।
কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন ও বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে ভারত সরকার জাতিসংঘের নির্ধারিত নীতিমালা লঙ্ঘন করেছে বলেও পাকিস্তানের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে।
এদিকে সংবিধানের ৩৭০ ধারা তুলে দিয়ে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করায় পাকিস্তানে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে তলব করে কঠিন বার্তা দিয়েছে পাকিস্তান।
সোমবার ভারতীয় পার্লামেন্টের রাজ্যসভায় ৩৭০ ধারা বাতিল করায় পাকিস্তানে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে ডেকে প্রতিবাদ জানায় পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
এ সময় কাশ্মীরে যে কোনো ধরনের বাড়াবাড়ি থেকে বিরত থাকার জন্য রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে ভারতকে সতর্ক করে পাক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
ভারতের বাড়াবাড়ির কারণে উত্তেজনা সৃষ্টি হলে পাকিস্তান কঠিন পদক্ষেপ নেবে বলেও হুশিয়ারি করা হয়।
কাশ্মীরের উপর অধিকার হারিয়েছে ভারত: আজাদ কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী
ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করে ভারত অধিকৃত জম্মু-কাশ্মীরের উপর করে নয়া দিল্লী পাকাপাকিভাবেই তার অধিকার হারিয়ে বলে মন্তব্য করেছেন পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত আজাদ জম্মু-কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী রাজা ফারুক হায়দার।
গত সোমবার ভারতীয় রাজ্যসভায় কাশ্মীরের বিশেষ সুবিধা বাতিল ও রাজ্যকে দুইভাগ করার বিল পাসের পর ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেন, এর মাধ্যমে ভারত কাশ্মীরের উপর তাদের অধিকার হারালো। এ পরিস্থিতিতে আজাদ কাশ্মীরের আইনসভায় একটি বিশেষ অধিবেশনও ডাকা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
প্রধানমন্ত্রী রাজা ফারুক বলেন, ভারত আজ আনুষ্ঠানিকভাবে কাশ্মীর হারালো। আমরা কখনোই ভারতের অংশ ছিলাম না। কিন্তু ভারত আজ লাদাখ ও জম্মুসহ উপত্যকাও হারালো। কাশ্মীরের মানুষ জীবন বাঁচাতে যুদ্ধ করছে উল্লেখ করে তিনি আশংকা প্রকাশ করে বলেন, ভারতীয় সেনাবাহিনী কাশ্মীরে গণহত্যা চালাতে পারে। রাজা হায়দার বলেন, সরকার শুধু মাত্র ভারতীয় প্রোপাগান্ডার জবাবই দেবে না বরং কাশ্মীর নিয়ে তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিও বিশ্বের দরবারে তুলে ধরবে। ভারত এমন পরিস্থিতি তৈরি করে পাকিস্তানের সাথে একটি জটিল সম্পর্ক সৃষ্টি করছে।