৭৫ লাখ রুপিতে বিক্রি হয়েছিল কাশ্মীর

ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোর্টঃ   কাশ্মীরের জনগণের জীবনে ১৭৩ বছরের ব্যবধানে আরেকটি পরিবর্তন এলো। ১৮৪৬ সালে এই জাতিগোষ্ঠী বিক্রি হয়েছিল মাত্র ৭৫ লাখ রুপিতে। এই রুপি ভারতীয় রুপি নয়। ওই সময় পাঞ্জাবে প্রচলিত রুপির নাম ছিল নানকশাহী। বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজউদ্‌দৌলাকে যেভাবে একদল দেশীয় রাজাকারের সহায়তায় পরাস্ত করে বাঙালির স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আটকে দিয়েছিল, একশ’ বছরের ব্যবধানে তারা সেটাই ঘটিয়েছিল কাশ্মীরে।

১৮৪৬ সালের ১৬ই মার্চ একটি জাতি, একটি জনগোষ্ঠী। গরু যেভাবে বিক্রি হয় সেভাবেই বিক্রি করে দিয়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গোলাপ সিং এর কাছে। কাশ্মীরের মোট আয়তন, যা বিক্রি হয়েছিল, তা ছিল ৮৪ হাজার ৪৭১ বর্গ মাইল।

এবং মানুষ ছিল ২৫ লাখ।

জম্মুর বাসিন্দা ছিলেন গোলাপ সিং। তরুণ বয়সে মহারাজা রঞ্জিত সিং এর দরবারে যোগ দেন। এবং শিগগিরই তিনি সেই দরবারের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে নিজেকে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। শিখ মহারাজা রঞ্জিত সিংহ ১৮৩৯ সালে মারা যান। তার দরবার ছিল লাহোরে। কিন্তু লাহোর দরবার তার মৃত্যুর পর শিগগিরই অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জড়িয়ে পড়ে। এই অবস্থায় নিজেকে কিংডম এর রাজা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন দেখেন গুলাপ সিং। তিনি হাত মেলান ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তখন ওই এলাকা নিজেদের অধীনে আনার জন্য পলাশীর আম্রকাননের মতোই নানা ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে চলছিল। সেই সময়ে একজন গোলাপ সিং নিজকে বৃটিশ অনুগত হিসেবে প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন।
১৮৪১ সালের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে আফগানদের বিরুদ্ধে বৃটিশরা যুদ্ধ করেছিল। আর সেই যুদ্ধে বৃটিশদের পক্ষ অবলম্বন করেন তিনি। এরপর এলো তারই স্বজাতি শিখদের বিরুদ্ধে বৃটিশ যুদ্ধের দামামা। আর সেক্ষেত্রেও গুলাপকে দেখা গেল রাজাকারের ভূমিকায়।

১৮৪৫ সালের নভেম্বর মাস। বৃটিশদের মধ্যে যুদ্ধ হলো সোবরানে। পলাশীর যুদ্ধের মতোই এটা শিখদের জীবনে সোবরান যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। হয়তো সেকারণেই পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী গতকাল ভারতে বিজিপির দ্বারা কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা খর্ব করার বিরুদ্ধে সোচ্চার। কারণ তাদের ইতিহাসের সঙ্গে কাশ্মীরের সম্পর্ক আছে।
১৮৪৫ সালে শিখ মুক্তিযোদ্ধারা গুলাব সিংকে অনুরোধ করেছিলেন তাদেরকে আসন্ন যুদ্ধে সাহায্য করতে। কিন্তু গোলাব সিং কুটবুদ্ধির মানুষ। তিনি নানা ফন্দি-ফিকির করে তাদের সহযোগিতা থেকে বিরত থাকলেন। মীরজাফরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন।

উইলিয়াম এডওয়ার্ড লিখেছেন, গুলাব সিং সেনাবাহিনীকে অনুরোধ করেছিলেন যাতে তিনি তাদের সঙ্গে যোগ না দেয়ার আগ পর্যন্ত বৃটিশদের বিরুদ্ধে হামলা না চালায়। কিন্তু তিনি সেই যোগদান আর কখনো করেননি। নানা অজুহাতে তিনি সেটা এড়িয়ে চলেন। কারণ, তিনি জানতেন কালক্ষেপণ করলে বৃটিশরা শিখদের পরাস্ত করতে পারবে। এবং বাস্তবে তাই ঘটলো। আর সেজন্য গুলাব ব্যক্তিগতভাবে পুরস্কৃত হয়েছিলেন। তিনি তার বিশ্বাসঘাতকতার জন্য লাহোর দরবারের ক্ষমতা পেলেন আর সেটাই তাকে উত্তর ভারতে ডোগরা কিংডম প্রতিষ্ঠার সুযোগ এনে দিল।
বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শিখদেরকেই দায়ী করলো যুদ্ধ বাধানোর জন্য। আর যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ দাবি করলো দেড় কোটি রুপি।

তাদের পক্ষে সেটা দেয়া সম্ভব ছিল না। তখন লাহোরের দরবারের রাজা ছিলেন দুলীপ সিং। দুর্বল। তাই সহজেই তাকে অপসারণ করে বৃটিশরা লাহোর চুক্তির আওতায় গোলাপ সিংকে সার্বভৌম স্বাধীন সার্বভৌম নৃপতি হিসেবে ঘোষণা করা হলো। ১৮৪৬ সালের ৯ই মার্চ সই করা চুক্তির আওতায় নয়নাভিরাম কাশ্মীরের পাহাড়গুলো ছিল না। পরে তা পার্শ্বচুক্তি করে বৃটিশরা তার দখলদারিত্ব তুলে দেয়।

এর সাত দিন পরেই সেই কুখ্যাত কাশ্মীর বিক্রি চুক্তি হলো।
এ রকমের চুক্তির কথা ইতিহাসে কেউ কখনো শোনেনি যে, একটি জনগোষ্ঠীকে তার নদী-নালা খাল-বিল ক্ষেত-খামার সহ একজন মাত্র ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে দেয়া সম্ভব। এটি হয়তো পৃথিবীর ইতিহাসের একমাত্র কুখ্যাত চুক্তি যা দিয়ে একটা জাতি রাষ্ট্রকে বিক্রি করে দিয়েছিল বৃটিশ সরকার।

তার ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বহু ধরনের অভিযোগের কথা, বহু কাহিনীর কথা বিশ্বের দেশে দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। কিন্তু কাশ্মীরি চুক্তির মতো লজ্জাজনক বিক্রি আর কেউ কখনও শোনেনি ইতিহাসে।
কিন্তু বৃটিশ সরকার তাদের অতীতের কৃতকমের্র বহু কিছুর জন্য তারা ক্ষমা প্রার্থনা করলেও এই কাশ্মীর বিষয়ে তারা নীরব। ৭৫ লাখ রুপিতে বিক্রি করে দেয়ার জন্য তারা কোনোদিন অনুশোচনা করেনি।
ডোগরা শাসনে কাশ্মীরি জনগণের উপরে বিরাট নির্যাতন ও নিপীড়নের ইতিহাস সকলের কাছে সুবিদিত। কাশ্মীরের মুসলমানরা নিষ্ঠুরতার শিকার হয়েছিল। মুসলমানদের বিরুদ্ধে অন্যায় অত্যাচার নির্যাতন ছিল ডোগরা শাসনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

এরপর এলো ১৯৪৭ সালের দেশভাগ। দেশভাগের মূলমন্ত্র ছিল হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল ভারতে যাবে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলো পাকিস্তানে যাবে। আর সে কারণে খুব স্বাভাবিকভাবেই জম্মু-কাশ্মীরের মুসলমানরা পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন। কিন্তু এখানেও আবার ষড়যন্ত্রমূলকভাবে রাজা হরি সিং তখন জম্মু-কাশ্মীরের শাসক। তিনি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু এবং লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে যোগসাজশ করলেন। কাশ্মীরিরা না যেতে পারল পাকিস্তানে, না পেল আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার।

Check Also

তাবলীগ জামায়াতের সাদপন্থীদের নিষিদ্ধের দাবিতে সাতক্ষীরায় বিক্ষোভ-সমাবেশ

মুহাম্মদ হাফিজ, সাতক্ষীরা : তাবলীগ জামাতে সাদপন্থীদের বর্বোরিচত হামলার প্রতিবাদ ও সাতক্ষীরা জেলা আ.লীগের সহসভাপতি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।