ক্রাইমর্বাতা ডেস্ক রিপোট: ভারতীয় সংবিধান থেকে ৩৭০ ধারা রদের পর পাঁচ দিন পার হয়ে গেছে। তারও আগ থেকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে কাশ্মীরিদের। যোগাযোগহীন কোনো মধ্যযুগীয় বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো অবস্থা বিরাজ করছে সেখানে। নেই ইন্টারনেট বা মোবাইল সেবা। প্রায় সব ধরনের টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন। পাঁচ দিন পার হয়ে গেলেও অনেক কাশ্মীরির কাছে এই অবস্থার পেছনের কারণ এখনো অজানা। নেই কোনো টেলিভিশন সমপ্রচার বা রেডিও বুলেটিন। বন্ধ হয়ে আছে বেশিরভাগ পত্রিকাও।
দলে দলে অসংখ্য সেনা ঘুরে-ফিরছে, নজর রাখছে কাশ্মীরের খালি রাস্তায়।
জরুরি দরকার ছাড়া কাউকে সেখানে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না, বেরও হতে দেয়া হচ্ছে না। সংবাদ সংগ্রহ করতে পারছেন না সাংবাদিকরা। এমতাবস্থায় বৃহসপতিবার কাশ্মীর নিয়ে সরকারের সিদ্ধান্তের পক্ষে ভাষণ রেখেছেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ভাষণে কাশ্মীরিদের দুরবস্থার কথা স্বীকার করে অচিরেই পরিস্থিতি উন্নতির আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। তবে সে আশ্বাসও পৌঁছায়নি কাশ্মীরিদের কানে। সেখানকার পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে বিবিসির এক প্রতিবেদক লিখেছেন, পুরো অঞ্চল যেন মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হয়েছে। তবে এত কড়াকড়ির মধ্যেও ভারত সরকারের ওপর অসন্তোষ বাড়ছে কাশ্মীরের জনগণের। প্রতিদিন বিক্ষোভের মাত্রা বাড়ছে। বাড়ছে সহিংসতাও।
আটক হচ্ছেন শত শত মানুষ। বেশ কয়েকজনের মৃত্যুও হয়েছে।
প্রসঙ্গত, সোমবার সংবিধানের ৩৭০ ধারা রদ করে ভারত সরকার। এতে স্বায়ত্তশাসন ও বিশেষ মর্যাদা হারায় কাশ্মীর। ধারা রদের ঘোষণার আগ থেকেই সেখানে জঙ্গি হামলা হতে পারে- এমন সতর্কতা জারি করে সেনা মোতায়েন করা হয়। পরবর্তীতে জানা যায়, আদতে জঙ্গি হামলা নয়, ধারা রদের ঘোষণার পর বিক্ষোভ হতে পারে এমন আশঙ্কা থেকেই সেনা মোতায়েন করে ভারতীয় জনতা পার্টি নেতৃত্বাধীন সরকার। এরকম বিশ্বাসঘাতকতায় ক্ষুব্ধ হয়েছে কাশ্মীরের জনগণ।
এ যেন কোনো মৃত্যুপুরী
কাশ্মীরের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি নিয়ে সংবাদ সংগ্রহ করতে সেখানে গেছেন বিবিসি বাংলার প্রতিবেদক শুভজ্যোতি ঘোষ। সেখানে প্রবেশের প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর তিনি জানান, শ্রীনগরে পা রাখার পর ২৪ ঘণ্টারও বেশি পেরিয়ে গেছে, কিন্তু মনে হচ্ছে যেন মৃত্যু উপত্যকায় এসে পৌঁছেছি। রাস্তাঘাটে একশো গজ পরপরই সেনা চৌকি আর কাঁটাতারের ব্যারিকেড। রাস্তায় যত না সাধারণ মানুষ, তার চেয়ে বহুগুণ বেশি সেনা আর আধা সেনা। মানুষের ছোট ছোট কিছু জটলা। ৩৭০ ধারা এবং কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা রাতারাতি বিলুপ্ত হওয়া নিয়ে তারা বিক্ষুব্ধ। ঘোষ জানান, কাশ্মীরে তিনি আগেও সংবাদ সংগ্রহ করতে গেছেন। তবে কখনো এমন পরিস্থিতি দেখেননি। পরিস্থিতির বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, এ যেন কোনো মৃত্যুপুরি।
পুরো রাজ্যজুড়ে মোতায়েন রয়েছে অগণিত সেনা। টানা কারফিউ জারি করা হয়েছে অনির্দিষ্টকালের জন্য। বন্ধ রয়েছে সব দোকানপাট, স্কুল-কলেজ। কাশ্মীরিরা প্রাথমিকভাবে সেনা মোতায়েনের সময় অনেকেই আশঙ্কা করেছিলেন যুদ্ধ হতে পারে। তাই কয়েকদিনের খাবার মজুত করে রেখেছিলেন বলে স্থানীয় গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়। কিন্তু সে খাবারও শেষ হয়ে আসছে বলে জানান ঘোষ। তার মধ্যে ঈদের দিন ঘনিয়ে আসছে। কেউ কেউ সাহস করে কেনাকাটা করতে বের হচ্ছেন, কিন্তু বিক্রির জন্য কোনো দোকানপাট খোলা নেই। পুরো শহরজুড়ে একধরনের চাপা অস্থিরতা বিরাজ করছে। থমথমে পরিবেশে যেন, আতংক আর ক্ষোভ মিশে আছে।
বাড়ছে দুর্দশা, অসন্তোষ, বিক্ষোভ
ঘোষ জানান, সেখানকার বেশিরভাগ স্থানীয় নেতাকেই আটকে রাখা হয়েছে। সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ বা মেহবুবা মুফতির বাড়ির দিকে কাউকেই যেতে দেয়া হচ্ছে না। গভর্নর হাউজের চারপাশও পুরো নিরাপত্তা দিয়ে রাখা হয়েছে। কেউ কেউ ব্যাপক ধরপাকড় ও বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়ার দাবি করেছেন, তবে সে তথ্যের সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি বিবিসি প্রতিবেদকের পক্ষে। তিনি জানিয়েছেন, সেখানকার মানুষের মনে অসন্তোষ চরম আকার ধারণ করছে। হাসপাতাল কার্যত বন্ধ থাকায় গুরুতর অসুস্থ রোগী, অন্তঃসত্ত্বা নারীরা চিকিৎসা পাচ্ছেন না। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে পারছে না সাধারণ মানুষ। সকল ধরনের টেলিযোগাযোগ পরিষেবা বন্ধ। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে অনেকের। সরকারের প্রতি ক্ষোভ বেড়েই চলেছে। কয়েকজন স্থানীয়কে উদ্ধৃত করে ঘোষ বলেন, ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ পার্লামেন্টে বলেছেন, আশি শতাংশ কাশ্মীরি সরকারের সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত। যদি তাই হয়, তাহলে কেবল আট মিনিটের জন্য কারফিউ তুলে নিক, তারপর দেখুক কত হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে এর প্রতিবাদ জানায়।
তথ্য অসংকুলান ও সরকারের কট্টর আচরণ যেন প্রতিবাদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে তাদের।
সহিংস পদক্ষেপ সেনাদের, ছোড়া হয়েছে গুলিও
এদিকে, মঙ্গলবার থেকে শুরু হওয়া বিচ্ছিন্ন বিক্ষোভ ধীরে ধীরে জোরদার হচ্ছে কাশ্মীরে। বিভিন্ন জায়গায় নিরাপত্তা উপেক্ষা করে বিক্ষোভে নামছে মানুষ। ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, বুধবার পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় শুধু শ্রীনগরের ৩০টি জায়গায় কারফিউ অমান্য করে বিক্ষোভ হয়েছে। তাদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাসের পাশাপাশি ছররা (পেলেট) গুলিও। ছররা বুলেটের জখম নিয়ে শ্রীনগরের শের-ই-কাশ্মীর ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্সসে ভর্তি চার জন, তাদের মধ্যে তিন জনের বয়স ১৫ থেকে ১৮-র মধ্যে। বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে রাখতে কাশ্মীরের বিভিন্ন কারাগারে আটক প্রায় ৭০ জন সন্দেহভাজন জঙ্গি ও বিচ্ছিন্নতাবাদীকে আগ্রার জেলে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও হুরিয়তের নেতাদেরও অজ্ঞাত জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এর আগে সব মিলিয়ে পাঁচ শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছিল আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম। এ ছাড়া পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দাবি করেছিল, অন্তত ১২ কাশ্মীরির মৃত্যু হয়েছে। তবে কোনো তথ্যের সত্যতাই যাচাই করা সম্ভব হয়নি। ভারত সরকার এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
লাদাখের বিজেপি সাংসদ সেরিং নামগিয়াল সমপ্রতি লোকসভায় দাবি করেন, তার কেন্দ্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মোদি সরকারের পাশে রয়েছে। অথচ সেখানেও বৃহসপতিবার হরতাল পালিত হয়েছে। শুক্রবার ১৪৪ ধারার মধ্যেই দফায় দফায় বিক্ষোভ হয়েছে। বেশ কয়েকজনকে আটকও করা হয়েছে। কার্গিলের ন্যাশনাল কনফারেন্স নেতা কামার আলি আখুন বলেন, আমরা চাই লাদাখ, জম্মু ও কাশ্মীর মিলিয়ে একটাই রাজ্য থাকুক।
আংশিকভাবে চালু ইন্টারনেট ও মোবাইল সেবা
শুক্রবার কাশ্মীরে আংশিকভাবে ইন্টারনেট ও মোবাইল সেবা চালুর ঘোষণা দিয়েছে ভারত সরকার। পাশাপাশি ঈদ ও জুমা উপলক্ষে আরোপিত কারফিউ কিছুটা শিথিল করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোতে। বৃহসপতিবার দেয়া ভাষণে মোদি নিরাপত্তার কড়াকড়িতে মানুষের অসুবিধার কথা উল্লেখ করে জানান, ঈদে মানুষ যাতে অংশ নিতে পারেন সেজন্য সব ব্যবস্থা করা হবে। উপত্যকার বাইরে থাকা কাশ্মীরিরা যাতে ঘরে ফিরতে পারেন তারও সবরকম ব্যবস্থা করার আশ্বাস দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এরপরই শুক্রবার শ্বাসরুদ্ধ পরিস্থিতি খানিকটা হাল্কা করার উদ্যোগ নেয়ার দাবি করেছে প্রশাসন। তবে শুক্রবার জুমার নামাজের জন্যও খুলে দেয়া হয়নি শ্রীনগরের প্রধান জামা মসজিদের গেট। এই মসজিদে নামাজ পড়ার সুযোগ দেয়া না হলেও গলিতে গলিতে যেসব মসজিদ রয়েছে সেগুলোতে নামাজ পড়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে বলে প্রশাসন সূত্রে জানানো হয়েছে। রাজ্যের পুলিশ প্রধান দিলবাগ সিং সংবাদ সংস্থা এএফপিকে বলেছেন, মানুষের কাছাকাছি এলাকায় নামাজ পড়ার ক্ষেত্রে কোনোরকম বিধিনিষেধ নেই। তবে সকলকে নিজেদের এলাকার বাইরে যেতে নিষেধ করা হয়েছে।