ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোটঃ খুলনার নিউজপ্রিন্ট মিলের অস্তিত্ব বিলীন হতে বসেছে। ব্যাংকের কাছে মিলের জমি বন্ধক থাকার পরও একটি বিদ্যুৎ কোম্পানির কাছে মিলের ৫০ একর জমি বিক্রির চুক্তি হয়েছে। এরপরই শুরু হয়েছে লুটপাট ও দখলের মহোৎসব। কঠোর প্রহরার মধ্যে চলছে এসব কর্মকাণ্ড।
১৯৫৭ সালে ভেরব নদের তীরে খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলের যাত্রা শুরু হয়।
২০০২ সালের ৩০ নভেম্বর থেকে বন্ধ রয়েছে মিলের উৎপাদন। মিলের ৮৮.৬৭৫ একর জমি ও সব স্থাপনা সোনালী ব্যাংক খুলনা করপোরেট শাখায় দায়বদ্ধ রয়েছে। মিলের কাছে ব্যাংকের পাওনা ৩২২ কোটি টাকা।
বন্ধকী সম্পত্তি বিক্রি, হস্তান্তর ও অপসারণে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) ও মিল কর্তৃপক্ষ সেটি আমলেই নেয়নি। এমনকি ব্যাংকের পক্ষ থেকে স্থাপনা, ভবন বিক্রির টেন্ডার সংক্রান্ত কার্যক্রম স্থগিতের জন্য বিসিআইসি ও মিল কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হয়। তারপরও তা বন্ধ করা হয়নি। ফলে বন্ধক মুক্ত না করেই জমি বিক্রির প্রক্রিয়া এবং স্থাপনা অপসারণ ও গাছপালা কেটে বিক্রি করা হচ্ছে। এ ঘটনায় আইনি পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
নিউজপ্রিন্ট মিলে সরেজমিনে দেখা গেছে, মিলের প্রধান ফটক থেকে ডান দিকে আবাসিক ভবনের প্রবেশ মুখেই বসানো হয়েছে ‘নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেডের রূপসা ৮০০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ নির্মাণ’ প্রকল্প নামে একটি সাইনবোর্ড। আর ভেতরে মিলের মূল অংশ বাদে কর্মকর্তাদের আবাসিক এলাকা, কর্মচারী ও শ্রমিকদের কোয়ার্টার, হাসপাতাল, বিনোদন কেন্দ্রসহ অন্যান্য স্থাপনা ভেঙে ফেলা হয়েছে। কেটে ফেলা হয়েছে গাছপালা। বিদ্যুৎ কোম্পানির কাছ থেকে টেন্ডার প্রাপ্ত মেসার্স সুভাস দত্ত এন্টারপ্রাইজের কাছ থেকে একাধিক হাত বদল হওয়া সর্বশেষ ঠিকাদার শ্রমিক দিয়ে এসব স্থাপনা সরিয়ে নিচ্ছেন। মিল জুড়েই চলছে লুটপাটের মহাযজ্ঞ।
খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলে বিদ্যুৎ কোম্পানির সাইনবোর্ড
খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলে বিদ্যুৎ কোম্পানির সাইনবোর্ড
বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নিরাপত্তা প্রহরী, ঠিকাদারের লোকজন এবং ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র ও যুব সংগঠনের নেতাকর্মীদের প্রহরায় এসব কর্মযজ্ঞ চলছে বলে জানা গেছে। ফলে বাইরের থেকে কেউ সেখানে প্রবেশ করতে পারছেন না। এমনকি সাংবাদিকদের প্রবেশের ওপরও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে।
সোনালী ব্যাংক খুলনা করপোরেট শাখা সূত্রে জানা গেছে, নিউজপ্রিন্ট মিল চালু থাকা অবস্থায় কাঁচামাল সংগ্রহ করতে সোনালী ব্যাংক করপোরেট শাখা থেকে ১৯৯৮ সালে মিলের ৮৮.৬৭৫ একর জমি বন্ধক রেখে ৫৭ কোটি টাকা ঋণ নেয়। যা ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত অনারোপিত সুদসহ ৩৭৮ কোটি ৭৬ লাখ ২ হাজার ৬০২ টাকায় দাঁড়ায়। এর মধ্যে গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর নিউজপ্রিন্ট মিল কর্তৃপক্ষ ৫৫ কোটি ৯৫ লাখ ১৬ হাজার টাকা বকেয়া পরিশোধ করে। বর্তমানে ব্যাংকের বকেয়া টাকার পরিমাণ ৩২২ কোটি ৮০ লাখ ৮৬ হাজার ৬০২ টাকা। খুলনায় সোনালী ব্যাংকের সবচেয়ে বড় ঋণ খেলাপি নিউজপ্রিন্ট মিল।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ব্যাংকের কাছে বন্ধক থাকা সত্ত্বেও নিউজপ্রিন্ট মিলের ৫০ একর জমি নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির কাছে বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয় বিসিআইসি। জমি, স্থাপনা ও গাছপালার মূল্য নির্ধারণ হয় ৫৮৬ কোটি ৫২ লাখ টাকা।
বিষয়টি জানার পর সোনালী ব্যাংক প্রধান কার্যালয় থেকে বিসিআইসি ও নিউজপ্রিন্ট মিল কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হয়। চিঠিতে বন্ধক রাখা জমির ভবন ও গাছপালা বিক্রির জন্য ডাকা টেন্ডারের কার্যক্রম স্থগিত করতে অনুরোধ করা হয়।
সোনালী ব্যাংকের খুলনা করপোরেট শাখার ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মুন্সী জাহিদুর রশীদ বলেন, ‘বকেয়া পরিশোধ না করেই নিউজপ্রিন্ট মিল কর্তৃপক্ষ মিলের জমি ও স্থাপনা ভেঙে বিক্রির প্রক্রিয়া শুরু করেছে। বন্ধকী সম্পত্তি বিক্রিতে আইনগত প্রতিবন্ধকতার বিষয়টি জানিয়ে দেওয়ার জন্যই মিলের প্রধান ফটকে নোটিশ টানানো হয়েছে। আগেরও মিলের ভেতরে এমন দু’টি নোটিশ দেওয়া হয়। এখন প্রয়োজনে আইনের আশ্রয় নেওয়া হবে।’
নিউজপ্রিন্ট মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রদীপ কুমার মজুমদার বলেন, ‘জমি বিক্রির সিদ্ধান্ত আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নেওয়া। বিদ্যুৎকেন্দ্রকে এখনও মিলের জমি দলিল করে দেওয়া হয়নি। কারণ জমি সোনালী ব্যাংকের কাছে বন্ধক রয়েছে। দলিলও ব্যাংকের কাছে রয়েছে। বন্ধক না ছাড়ানো পর্যন্ত দলির করে দেওয়া সম্ভব হবে না।’
বিসিআইসির পরিকল্পনা বিভাগের জ্যেষ্ঠ মহাব্যবস্থাপক আবুল কাশেম বলেন, ‘মিলের জমি সোনালী ব্যাংকের কাছে বন্ধক রাখা। বিক্রির পর সেই টাকা দিয়ে জমি ছাড়ানো হবে ব্যাংকের কাছ থেকে।’