রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে দশ দফা সুপারিশ বিএনপির

স্টাফ রিপোর্টার: রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে সরকারকে ফের জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার আহবান জানিয়ে ১০ দফা সুপারিশ দিয়েছে বিএনপি। গতকাল বুধবার বিকেলে রোহিঙ্গা সমস্যার ওপর এক গোলটেবিল আলোচনায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই আহবান জানান। তিনি বলেন, আমরা জানি, এই সরকারের কোনো নৈতিক অবস্থান নেই, তারা অনির্বাচিত সরকার। সুতরাং তাদেরকে বিশ্বজনমত তৈরি করতে হলে সমগ্র জনগনকে সামনে নিয়েই এই অভাবটা পূরণ করতে হবে। তিনি বলেন, সরকারের নতজানু পররাষ্ট্র নীতির কারণেই রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হচ্ছে না।
গুলশানে লেক শোর হোটেলে বিএনপির উদ্যোগে ‘রোহিঙ্গা সংকট ও বাংলাদেশের ভূমিকা’ শীর্ষক এই গোলটেবিল আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিএনপির নেতৃবৃন্দসহ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, কানাডা, ফ্রান্স, অষ্ট্রেলিয়া, জাপান, ভারত, পাকিস্তান, নরওয়ে, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, আফগানিস্তান, তুরস্ক, জাতিসংঘ, ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল প্রভৃতি দেশের কুটনীতিকরা গোলটেবিল আলোচনায় অংশ নেন। তবে কুটনীতিকরা আলোচনায় কোনো বক্তব্য রাখেননি। তারা আলোকদের বক্তব্য নোট করেছেন।
আলোচনায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ওপর মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও পররাষ্ট্র কমিটির চেয়ারম্যান আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। এতে রোহিঙ্গাদের আগমনের প্রেক্ষাপট, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনামের প্রতিবেদন এবং রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে তাদের নাগরিকত্ব ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই করণীয় বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়।
অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ড. আবদুল মইন খান, গণস্বাস্থ্য সংস্থার ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা রিয়াজ রহমান, অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মাহবুবউল্লাহ, সাবেক রাষ্ট্রদূত সিরাজুল ইসলাম, সাবেক সচিব এএইচএম মোফাজ্জল করীম, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী ও অধ্যাপক সুকোমল বড়ুয়া প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, এই সেমিনারের মধ্য দিয়ে আমরা সরকারের কাছে পৌঁছাতে চাই, জনগনের কাছে পৌঁছাতে চাই, বিশ্বমানবতার কাছে পৌঁছাতে চাই। একই সঙ্গে আমরা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে, জাতিসংঘকে, আন্তর্জাতিক বিশ্বকে আহবান জানাচ্ছি, মানবিক যে অবস্থা তৈরি হয়েছে সেটাকে সমাধানের জন্য তারা তাদের ভুমিকা পালন করবে।
১০ দফা সুপারিশের মধ্যে আছে, জাতীয় ঐক্য সৃস্টি, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে তাদের নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা, নিজের মাতৃভুমিতে অবাধ চলাচলের নিশ্চিতকরণ, বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রসমূহকে নিয়ে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা, প্রত্যাবাসনের আগে ও পরে জাতিসংঘের তত্বাবধায়নের মিয়ানমারের পরিস্থিতি পরযবেক্ষনে সুযোগ রাখা, রোহিঙ্গা ইস্যুকে কেন্দ্র করে যাতে জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ সৃষ্টি না হতে পারে সে ব্যাপারে সরকারকে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া প্রভৃতি।
ওবায়দুল কাদের বক্তব্য সুইসাইডেল মন্তব্য করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবার পুরনো খেলা শুরু করেছেন, বিএনপিকে দায়ী করতে শুরু করেছেন এবং তিনি আমাকে দায়ী করেছেন যে, রোহিঙ্গা ইস্যু দিয়ে নাকী আমরা উস্কে দিচ্ছি রোহিঙ্গাদের। মির্জা ফখরুল বলেন, এটা সুইসাইডেল, এটা আত্মহননের কথা। আমরা মনে করি যে, এই ধরনের কথা-বার্তা শুধুমাত্র রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে, মিয়ানমারকে আরো শক্তিশালী করবে এবং সমস্যা আরো বৃদ্ধি করবে।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের স্থায়ীভাবে দেশে ফিরে জীবন-সম্পদ সম্ভ্রমে অখন্ড নিরাপত্তা ও পূর্ণ নাগরিক অধিকার নিয়ে নিজ মাতৃভুমিতে বসবাস করতে পারে সেই নিশ্চয়তা বিধান কল্পে বাংলাদেশসহ সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলোকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বলিষ্ঠ কুটনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবে। জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে এর কোনো বিকল্প নাই। ঐক্যবদ্ধ জাতিকে নিয়েই এই সমস্যা সমাধান করার জন্য এগিয়ে যেতে হবে।
সরকারের সমালোচনা করে মির্জা ফখরুল বলেন, আমি বলতে চাই, প্রধান যে বিষয়টা- রোহিঙ্গাদেরকে ফিরিয়ে নিতে হলে অবশ্যই তাদের নিরাপত্তা, নাগরিকত্ব ও তাদের প্রত্যাবাসনে পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। সেটা সরকার পারেনি। এই সরকারের ব্যর্থতা, তাদের অনভিজ্ঞতা, নতজানু পররাষ্ট্র নীতি তারা যে এমন জায়গায় নিয়ে গেছে যে, মিয়ানমারের ট্র্যাপের মধ্যে এই সরকার পড়ে গেছে। এখান থেকে তাদের বেরিয়ে আসতে হবে।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুটি এখন বাংলাদেশের জন্য সত্যিকার অর্থে বিপদজনক অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। আমরা প্রথম থেকেই বলে আসছিলাম যে, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান করতে হলে এককভাবে বাংলাদেশের পক্ষে ওটা করা সম্ভব হবে না। প্রথম থেকেই বলে আসছিলাম যে, একটা জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের করতে হবে।
রোহিঙ্গা শরনার্থীরা বাংলাদেশে আসার সময়ে খালেদা জিয়া যে বিবৃতি দিয়েছিলেন তা তুলে ধরেন বিএনপি মহাসচিব। তিনি বলেন, বেগম খালেদা জিয়াই সর্বপ্রথম রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার দাবি করেছিলেন। সরকার প্রথম দিকে সেটিকে আমলে নেয়নি। পরবর্তীতে বিভিন্ন চাপে পড়ে তারা সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছে। তিনি বলেন, আমরা বারবার বলেছি, রোহিঙ্গা ইস্যু সমাধান করতে হলে পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধি করে মিয়ানমারকে বাধ্য করতে হবে। কিন্তু এই সরকার সেটি করতে ব্যর্থ হয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, রোহিঙ্গাদের সসন্মানে দেশে ফেরার ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের নাগরিকত্ব, তাদের নিরাপত্তা, তাদের চলাচলের স্বাধীনতা, তাদের বাড়ি-ঘর-সম্পত্তির ফিরিয়ে দেয়ার গ্যারেন্টি চায়-এটা বাংলাদেশ সরকারকে শক্তিশালী ভুমিকা রাখতে হবে। এজন্য দেশে একটি জাতীয় ঐক্যমত্য সৃষ্টি করতে হবে, জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে আমাদের আন্তর্রজাতিক ক্ষেত্রে বন্ধু বৃদিব্ধ করে মিয়ারমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে। জাতীয় ঐক্য ছাড়া রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় বলে আমরা মনে করি।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গারা প্রথম যখন এসেছিলেন, তখন জিয়াউর রহমান সফলভাবে তাদের ফেরত পাঠিয়েছিলেন। খালেদা জিয়ার সময়েও তিনি ফেরত পাঠাতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু বর্তমার সরকার কিছুই করতে পারছে না। তিনি বলেন, ভারত এখনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে, কিন্তু তারা তা করছে না। তাদের অনেক বড় ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু আমাদের কূটনৈতিক দুর্বলতা রয়েছে। এটাই উপযুক্ত সময় রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে কাজ করার।
আলোচনা সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাহাবুব উল্লাহ বলেন, চীন, মিয়ানমার ও ভারত এই তিন দেশের মধ্যে কূটনৈটিক সম্পর্ক জোরদার করা ছাড়া রোহিঙ্গা সংকট সমাধান করা যাবে না। চীন ও মিয়ানমারের মধ্যে অনেক ভালো সম্পর্ক। চীনের অনেক বিনিয়োগ রয়েছে মিয়ানমারে। বিশ্বকে বুঝাতে বাংলাদেশ কিভাবে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
রাষ্ট্রপবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাংলাদেশর কৌশলগত সমস্যার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সমস্যাও আছে। তিনি বলেন, ২০১৭ সালের আগেও রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা নিয়ে এই সংকটটি বিদ্যমান ছিল। সেখানে জাতিগত নিধন পূর্ব থেকেই ছিল। পরে ২০১৭ সালে রোহিঙ্গার এই সংকটটি বাংলাদেশে চলে এসেছে। আমরা এখন যে সংকটটির মুখোমুখি হয়েছি এই সংকট ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা ছাড়া সমাধান করা সম্ভব হবে না।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ একটি চক্রে পড়ে গেছে, এটা কোন দ্বিপাক্ষিক সমস্যা নয়। এটা আন্তর্জাতিক সংকট। এই সংকট মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক ভূমিকা ছাড়া সমাধান সম্ভব হবে না। বাংলাদেশ শুধু একা নয়, এই সংকট সমাধানে আন্তজাতিকভাবেই সমাধান করতে হবে।
দলের সাংগঠনিক সম্পাদক শ্যামা ওবায়েদের পরিচালনায় গোলটেবিল আলোচনায় দলের স্থায়ী বিএনপির কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, বেগম সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, ভাইস চেয়ারম্যান কামাল ইবনে ইউসুফ, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, আবদুল মান্নান, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, রুহুল আলম চৌধুরী, জয়নাল আবেদীন, আবদুল আ্উয়াল মিন্টু, অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ হোসেন, আহমেদ আজম খান, নিতাই রায় চৌধুরী, অধ্যাপক সুকোমল বড়ুয়া, অধ্যাপক সিরাজউদ্দিন আহমেদ, ইসমাইল জবিউল্লাহ, সুজাউদ্দিন, আবদুল কাউয়ুম, তাহসিনা রশদী, বিজন সরকার, মাহবুব উদ্দিন খোকন, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, মাসুদ আহমেদ তালুকদার, ওবায়দুল ইসলাম, শিরিন সুলতানা, আসাদুজ্জামান আসাদ, এবিএম মোশাররফ হোসেন, জহিরউদ্দিন স্বপন, ফাহিমা মুন্নী, রুমিন ফারহানা, অনিন্দ্র্য ইসলাম অমিত, মীর হেলাল, ইশরাক হোসেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্ণর সালেহউদ্দিন আহমেদ, সাবেক রাষ্ট্রদূত ফজলে আকবর, শামীম আহমেদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

Check Also

ভোমরা বন্দরে চার মাসে ৪০০ কোটি টাকা আয়

দক্ষিণবঙ্গ সাতক্ষীরার আধুনিক নিরাপদ ও পরিবেশ বান্ধব বাণিজ্যিককেন্দ্র ভোমরা স্থল বন্দর। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।