ক্রাইমবার্তা রিপোটঃ ভারতশাসিত অবরুদ্ধ কাশ্মীরে বেসামরিকদের ওপর নির্যাতন চালানোর অভিযোগ উঠেছে নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে। স্থানীয়রা বলছেন, তাদের লাঠি দিয়ে পেটানো হচ্ছে, ইলেকট্রিক শক দেয়া হচ্ছে। বিবিসির এক বিশেষ প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। বেশ কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দারা তাদের শরীরে মারধরের চিহ্ন দেখিয়েছে বিবিসির প্রতিবেদককে। স্থানীয় কর্মকর্তাদের কাছে গ্রামবাসীর এসব অভিযোগের সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি। তবে ভারতীয় সেনাবাহিনী অভিযোগগুলো ভিত্তিহীন ও অপ্রমাণিত বলে আখ্যায়িত করেছে। আগস্টের প্রথম সপ্তাহে সংবিধানের ৩৭০ ধারা রদ করে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নিয়েছে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি নেতৃত্বাধীন সরকার। সেখানে মোতায়েন করা হয়েছে প্রায় আড়াই লাখ সেনা।
পুরো অঞ্চলটি অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাসহ প্রভাবশালী ব্যক্তিদের আটক করে রাখা হয়েছে। অনেককে রাজ্যের বাইরেও নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, সেখানে আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে এসব পদক্ষেপ প্রয়োজনীয়।
‘চিৎকার করায়, আমাদের মুখে কাদা ভরে দিয়েছে’
বিবিসির প্রতিবেদক সামির হাশমী কাশ্মীরের দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রায় ছয়টি গ্রাম ঘুরে দেখেছেন। সামপ্রতিক বছরগুলোয় সেখানে ভারত-বিরোধী জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সেখানকার বাসিন্দারা হাশমীকে জানান, প্রায়ই সেখানে গভীর রাতে অভিযান চালায় সেনারা। স্থানীয়দের মারধর ও নির্যাতন করে। মারধরে অসুস্থ হওয়া ব্যক্তিদের নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে চান না স্থানীয় চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা। তবে গ্রামবাসীরা বিবিসিকে তাদের ক্ষত দেখিয়েছেন। জানিয়েছেন, নিরাপত্তা বাহিনীরা মারধর করে আহত করেছেন তাদের।
একটি গ্রামের বাসিন্দারা বলেন, কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা রদ হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর সেনারা তাদের প্রত্যেকটি ঘরে ঢুকে তল্লাশি চালিয়েছে। সেখানকার এক পরিবারের দুই ভাই বলেন, সেনারা তাদের ঘুম থেকে তুলে বাইরে নিয়ে যায়। সেখানে আগ থেকে আরো প্রায় এক ডজন ব্যক্তি দাঁড়িয়ে ছিল। নিজেদের নাম না প্রকাশের শর্তে ওই দুই ভাই বলেন, তারা আমাদের মেরেছে। আমরা বারবার জিজ্ঞেস করছিলাম যে, আমরা কী করেছি? কিন্তু তারা আমাদের কোনো কথা শোনেনি। তারা কেবল আমাদের মারতে ব্যস্ত ছিল।
দুই ভাইয়ের একজন বলেন, তারা আমার শরীরের সবখানে মেরেছে। তারা আমাদের লাথি মেরেছে, লাঠি দিয়ে পিটিয়েছে, আমাদের ইলেকট্রিক শক দিয়েছে। আমাদের পায়ের পেছন দিকে লাঠি দিয়ে মেরেছে। আমরা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। তখন আমাদের ইলেকট্রিক শক দিয়েছে। লাঠি দিয়ে পেটানোর সময় আমরা চিৎকার করায়, আমাদের মুখে কাঁদা ভরে দিয়েছে।
এক ভাই বলেন, আমরা তাদের বলেছিলাম আমরা নির্দোষ। আমরা জিজ্ঞেস করেছিলাম, তারা এসব কেন করছে? কিন্তু তারা আমাদের কথা শোনেনি। আমি তাদের আমাদের মারতে মানা করেছিলাম। বলেছিলাম, আমাদের সরাসরি গুলি করে মেরু ফেলুন। আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে আমাকে তুলে নেয়ার প্রার্থনা করছিলাম। কেননা, ওই নির্যাতন অসহ্য ছিল।
‘আমি অস্ত্র হাতে তুলে নেবো, এসব সহ্য করতে পারবো না’
অপর এক তরুণ গ্রামবাসী জানান, নিরাপত্তা বাহিনী বারবার তাকে জিজ্ঞাসা করছিল, কারা পাথর ছুড়েছে তাদের নাম বলতে। উল্লেখ্য, ঘোষণার পরপরই কাশ্মীরে বিক্ষোভ দেখা দেয় ও নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর পাথর ছোড়েন বিক্ষোভকারীরা। ওই তরুণ সেনাদের বলেছিল, তিনি পাথর নিক্ষেপকারী সমপর্কে কিছু জানেন না। তখন সেনারা তাকে তার চশমা, কাপড় ও জুতা খুলে ফেলার নির্দেশ দেন।
নাম না প্রকাশের শর্তে ওই তরুণ বলেন, আমি কাপড় খোলার পর তারা আমাকে রড ও লাঠি দিয়ে প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে নির্দয়ভাবে মেরেছে। মার খেয়ে আমি যখন অজ্ঞান হয়ে পড়েছি, তখন আমায় ইলেকট্রিক শক দিয়েছে। তারা যদি ফের আমার ওপর এমন নির্যাতন চালায়, তাহলে সব করতে রাজি আছি। আমি অস্ত্র হাতে তুলে নেবো। আমি প্রতিদিন এসব সহ্য করতে পারবো না।
ওই তরুণ বলেন, সেনারা তাকে সতর্ক করেছিল যে, গ্রামের কেউ যদি বিক্ষোভে অংশ নেয় তাহলে তাদেরও একই অবস্থা হবে। একথা যেন পুরো গ্রামকে জানিয়ে দেয়া হয়। বিবিসির প্রতিবেদক ওই গ্রামের বাকি যাদের সঙ্গেই কথা বলেছেন তাদের সবাই বলেছে যে, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা গ্রামবাসীদের এমনভাবে ভয় দেখাতো যে কারোই বিক্ষোভ করার সাহস ছিল না।
এদিকে, বিবিসিকে দেয়া এক বিবৃতিতে গ্রামবাসীদের সকল অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর মুখপাত্র কর্নেল আমান আনন্দ বলেন, এ ধরনের কোনো অভিযোগ আমাদের নজরে পড়েনি। এই অভিযোগগুলো সম্ভবত ক্ষতিকর উদ্দেশ্য নিয়ে করা হচ্ছে। বেসামরিকদের প্রতিরক্ষা করতে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তবে এসব পদক্ষেপে কেউ হতাহত হয়নি।
‘আমাদের পশুর মতো মারে, তাদের কাছে আমরা মানুষ নই’
বিবিসির প্রতিবেদক জানান, তার সঙ্গে কথা বলা গ্রামের বাসিন্দারা বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর প্রতি সহানূভিতিশীল ছিল। তারা ওই জঙ্গিদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বর্ণনা করেছে। তিনি জানান, ওই অঞ্চলে সেনাবাহিনীর একটি ঘাঁটি রয়েছে। সেখান থেকে তারা জঙ্গি ও জঙ্গিবাদ সমর্থনকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে থাকে। নির্দোষ গ্রামবাসীরা প্রায়ই এসব অভিযানের শিকার হয়। এমন একটি গ্রামের এক তরুণ বাসিন্দা বিবিসিকে জানায়, সেনাবাহিনী তাকে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে তথ্য সরবরাহকারী হিসেবে কাজ করতে বলেছে। কাজ না করলে তাকে ফাঁসিয়ে দেয়ার হুমকি দিয়েছে। তিনি সেনাবাহিনীর প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় তাকে প্রচণ্ড মারধর করা হয়েছে। মারধর এতটাই তীব্র ছিল যে, কয়েক সপ্তাহ পার হয়ে যাওয়ার পরও পিঠ নিচে দিয়ে শুয়ে থাকতে পারেন না। তিনি বলেন, এমনটা চলতে থাকলে আমার হাতে ঘর ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর উপায় থাকবে না। তারা আমাদের পশুর মতো মারে। তাদের কাছে আমরা মানুষ নই।
অপর এক ব্যক্তি জানান, তাকে মাটিতে ফেলে বন্দুক, লাঠি, কেবল ও সম্ভবত লোহার রড দিয়ে মারধর করেছে ১৫-১৬ সেনা। তিনি বলেন, আমি প্রায় অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম। তারা আমার দাড়ি ধরে এত জোরে টেনেছে যে মনে হয়েছে, আমার দাঁত পড়ে যাবে।
অপর এক গ্রামের এক তরুণ বাসিন্দা জানায়, তার ভাই হিজবুল মুজাহিদিনে যোগ দিয়েছে। সমপ্রতি তার ভাই সমপর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করতে তাকে আটক করে সেনাবাহিনীর শিবিরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে এতটা মারধর করা হয় যে, তার পা ভেঙে যায়। তিনি বলেন, তারা আমার হাত-পা বেঁধে আমায় উল্টো করে ঝুলিয়ে দিয়েছিল। দুই ঘণ্টার বেশি সময় ধরে তারা আমাকে নির্মমভাবে মেরেছে।
তবে সেনাবাহিনী এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। বিবিসিকে দেয়া বিবৃতিতে তারা বলেছে, তারা একটি পেশাদার সংস্থা যারা মানবাধিকার বোঝে ও মেনে চলে। এসব অভিযোগ দ্রুততার সঙ্গে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
গত পাঁচ বছরে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ৩৭টি অভিযোগ করেছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। সেনাবাহিনী জানায়, ওই ৩৭টি অভিযোগের মধ্যে ২০টি অভিযোগই ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়েছে। ১৫টি অভিযোগ এখনো তদন্তাধীন আছে। মাত্র তিনটি অভিযোগে কিছু সত্যতা পাওয়া গেছে। যারা দোষী প্রমাণিত হয়েছে তাদের শাস্তি দেয়া হয়েছে।
তবে এ বছরে শুরুতে কাশ্মীরি মানবাধিকার সংগঠনগুলোর এক প্রতিবেদনে গত তিন দশক ধরে রাজ্যটিতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনটিতে কাশ্মীরে নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে ধরা হয়েছে। কাশ্মীরে ওইসব মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্ত করে দেখতে একটি কমিটি গঠনের আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন। ভারত সরকার অবশ্য ওই অভিযোগগুলো অস্বীকার করেছে।