প্রকাশ ঘোষ বিধান:শকুন আমাদের অতি পরিচিত পাখি। এক সময় বাংলাদেশের গ্রামগঞ্চে গরু, মহিষসহ গবাদি পশুর মৃতদেহ যেখানে ফেলা হতো সেখানে দলে দলে শকুন হাজির হতো। মৃত প্রাণি বা পচাগলা ও বর্জ্য শকুনের খাবার। মৃতদেহ পচে রোগ ছড়ানোর আগেই তা খেয়ে সাবাড় করে দিতো। তাই শকুন প্রকৃতির পরিচ্ছন্নতা কর্মি হিসাবে পরিচিত। কিন্তু এখন আর আগের মত শকুন দেখা যায় না। ভালচার ডে ডট ও আরজির মতে প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম শনিবার পালিত হয় শকুন সচেতনতা দিবস। বিলুপ্ত প্রায় এ শকুনকে বাঁচাতে মানুষের মাঝে সচেতনতা বাড়ানোই শকুন সচেতনতা দিবসের উদ্দেশ্য।
শকুন মড়াখেকো মাংসাশী পাখি। তাই অনেকেই তাকে ভাল চোখে দেখে না। শকুনের প্রতি নাক সিটকানো মনভাবের কারণে পাখিটির বংশ হারিয়ে যাচ্ছে। শকুন অনেকের কাছে অলুক্ষণের প্রতীক হিসাবে পরিচিত। কিন্তু শকুন একটি উপকারি পাখি। শকুন কমে যাওয়ায় দেশে এ্যানথ্রাক্স, জলাতাঙ্গ ও অন্যান্য জুনোটিক রোগের সংক্রামন ঘটছে। শকুন মৃত প্রাণির মাংস খেয়ে বেঁচে থাকে। হাজার বছর ধরে শকুন প্রকৃতি থেকে মৃতদেহ সরানোর কাজ করে আসছে। তাই প্রকৃতির ঝাড়–দার পাখি হিসেবে শকুন পরিচিত। শকুনের কারণে মানুষ নিজের অজান্তেই নানান রোগ ব্যাধি থেকে রেহাই পেয়ে যায়। কিন্তু প্রকৃতিকে পরিষ্কার রাখার কাজে নিয়োজিত থাকলেও শকুন শব্দটি যেন অপায়া, সাথে জড়িয়ে আছে নেতিবাচকতা। বিশ্বজুড়ে আশঙ্কাজনক হারে শকুন কমছে। তীক্ষ দৃষ্টির অধিকারী শিকারী পাখি শকুন। প্রকৃতির পরিচ্ছন্নতা কর্মী হিসাবে পরিচিত এই শকুন বর্তমানে পৃথিবীর মহাবিপন্ন প্রাণির তালিকায় রয়েছে।
পৃথিবীতে সর্বমোট ২৩ প্রজাতির শকুন রয়েছে। তবে গবেষকদের মতে সারা বিশ্বে সর্বমোট ১৮ প্রজাতির শকুন দেখা যায়। এর মধ্যে পশ্চিম গোলার্ধে ৭ প্রজাতি এবং পূর্ব গোলার্ধে ১১ প্রজাতির শকুন দেখা যায় (ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়া)। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ বাংলাদেশে ৬ প্রজাতির শকুন দেখা মিলতো। এর মধ্যে ৪ প্রজাতির দেশীয় আর ২ প্রজাতির পরিযায়ী। শকুন বা বাংলা শকুন ছাড়াও ছিল রাজ শকুন, গ্রীফন শকুন বা ইউরেশীয় শকুন, হিমালয়ী শকুন, সরুঠোটা শকুন, কালা শকুন ও ধলা শকুন। বাংলা শকুনের বৈজ্ঞানিক নাম জেপস বেঙ্গালেনসিস। গলা লম্বা, লোমহীন মাথা ও গলা, গা ধূসর। পশ্চোদশের পালক সাদা, পা কালো, ডানা, পিঠ ও লেজ কালছে বাদামী। সাধারণত লোকচক্ষুর আড়ালে পাড়াহের চুড়া, বট, তাল, নারিকের, শিমুল প্রভূতি উচু বিশালাকার গাছে এরা বাসা বাঁধে। একই বাসা ঠিকঠাক করে বছরের পর বছর এরা ব্যবহার করে। এরা ১-৩টি ডিম পাড়ে। সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত শকুনের প্রজননকাল। ৪৫-৫০ দিনে ডিম ফোটে।
আমাদের দেশে বাংলা শকুন দ্রুত বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আমাদের সংস্কৃতিতে শকুন কোন আনন্দদায়ক বা দৃষ্টিনন্দন পাখি নয়। বাড়িতে বা আশেপাশে কেউ শকুনের উপস্থিতি প্রত্যাশা করেন না। আমাদের অজ্ঞতা অবহেলার কারণে এবং শকুনের আবাস্থল ধ্বংসের ফলে বাংলা শকুন আগামী ৫ বছরের মধ্যে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। শকুন কমছে বলেই পশুর এ্যানথ্রাক্স, যক্ষা, জলাতঙ্ক, খুরা রোগসহ বিভিন্ন রোগ বালাই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ থেকে মানুষও আক্রান্ত হচ্ছে। স্বাধীনতার পূর্বে আমাদের দেশে ৫০ হাজার শকুন ছিল। বর্তমানে এর সংখ্যা ৩ শত এর নিচে। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় হয়তো বাংলা শকুন দেশ থেকে হারিয়ে যাবে।
নির্মল প্রকৃতি ও আমাদের সু-স্বাস্থ্যের জন্য শকুনের অবদান বেশি। পশু পাখির মৃত দেহ স্বল্প সময়ে খেয়ে প্রকৃতিকে পরিস্কার ও রোগ মুক্ত রাখার জন্য শকুনের চেয়ে অন্যকোন উপযুক্ত প্রাণি পৃথিবীতে নেই। গরু, মহিষ প্রভূতি শক্ত ও মোটা চামড়ার প্রাণি মারা গেলে লোকলয়ের কোন প্রাণি সাথে সাথে খেতে পারে না। একটু পঁচন ধরলে কুকুর, শিয়াল বা অন্য প্রাণী তা ভক্ষণ করে। পঁচে যাওয়া মৃতদেহ অনেক ধরণের ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস এর উৎপত্তি হয়। কুকুর, শিয়াল বা অন্য প্রাণি এসব খেয়ে এ্যানথ্রাক্স ও বিভিন্ন ভাইরাসে আক্রান্ত হয় এবং মানুষ ও প্রকৃতিকে আক্রান্ত করে। অথচ শকুনের পরিপাক যন্ত্রে এ্যানথ্রাক্স সহ সকল ধরণের জিবানু ধ্বংস হয়ে যায়। এ্যানথ্রাক্স একটি জুনোসিস রোগ যা বন্যপ্রাণী এবং গবাদি পশুর মধ্যে বিস্তার লাখ করে থাকে। শকুন বিলুপ্তির কারণে পরিবেশগত সমস্যা দেখা দিয়েছে। শকুন না থাকার কারণে গবাদি পশুর মৃতদেহ থেকে বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধি যেমন-এ্যানথ্রাক্স, খুরা রোগ, হগ, বুটুলিয়ান, কলেরা ইত্যাদি দ্বারা গবাদি পশু ও মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে।
আমাদের দেশে দ্রুত শকুন কমে যাওয়ার প্রধান কারণ পশু চিকিৎসায় ব্যথানাশক ডাইক্লোফেনাক সোডিয়াম (ডাইক্লোফেন) ও কিটোপ্রোফেন এর ব্যবহার। মার্কিন গবেষক ড. লি-সে ওক ২০০৩ সালে প্রমাণ করেন যে ডাইক্লোফেনাক পশু প্রয়োগ করা হয়েছে। এমন গরু ও ছাগলের মৃতদেহ ভক্ষন করলে শকুনের কিডনী নষ্ট হয়ে ২৪ ঘন্টার মধ্যে মারা যায়। সে কারণে ভারত ও পাকিস্তান ২০০৬ সালে এবং নেপাল ২০০৯ সালে ডাইক্লোফেনাক বন্ধ করে মেলোক্সিক্যাম সহ বিকল্প ঔষধ ব্যবহার শুরু করেছে। বাংলাদেশ সরকার ২০১০ সালে গবাদি পশুর চিকিৎসায় ডাইক্লোফেনাক সোডিয়াম উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। তবে ডাইক্লোফেনাক নিষিদ্ধ করা হলেও কেটোপ্রোফনের ব্যবহার মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
সারা পৃথিবী জুড়ে শকুনের অবস্থা খুব নাজুক। গবেষকরা জানিয়েছে, পৃথিবীতে শতকারা ৯০ ভাগ শকুনই এখন আর নেই। এর জন্য পরিবেশের ভারসাম্যহীনতার পাশাপাশি এ্যানথ্রাক্স, যক্ষা, ক্যান্সার, পানি বাহিত রোগ সহ বিভিন্ন রোগ ব্যাধি বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিগত ৩ বছরে বাংলাদেশের শতকারা ৯৯ ভাগ শকুন মারাগেছে। অবশিষ্ট ১ ভাগও মৃত্যুর মুখে পতিত হচ্ছে। আইইউসিএন- এর সহযোগী সংগঠন বার্ড লিস্ট অর্গানাইজেসন উল্লেখ করেছে, কীটনাশক ও সারের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে পানির দূষণ, খাদ্য সংকট, কবিরাজী ঔষধ তৈরীতে শকুনের অঙ্গ-প্রতঙ্গের ব্যবহার, বিমান-ট্রেনের সংঘর্ষ, ঘুড়ির সুতার সাথে জড়িয়ে পড়া ইউরিক এসিডের প্রভাবে বিভিন্ন রোগ, বাসস্থানের অভাব প্রভূতি কারণে শকুন বিলুপ্ত হচ্ছে।
পরিবেশ ও বনমন্ত্রাণালয় ২০১৪ সালে ১শ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের দেশের ২টি অঞ্চলকে শকুন নিরাপদ এলাকা ঘোষণা করেছে। শকুন নিরাপদ এলাকা- ১ এর কেন্দ্রবিন্দু মৌলভী বাজার ও হবিগঞ্চ জেলার বনাঞ্চল এবং শকুন নিরাপদ এলাকা-২ এর কেন্দ্রবিন্দু সুন্দরবনের খুলনা জেলা সংলগ্ন বনাঞ্চল। ভারতের এরকম ৫টি ও নেপালের ২টি এলাকা শকুনের জন্য নিরাপদ এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে। শকুনের জন্য দেশের যে কয়টি শকুন আছে তাদের বেশিরভাগ সুন্দরবন এলাকায় এবং কয়েকটি দল হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে রেমা কালেঙ্গা এলাকায় রয়েছে। শকুন সংরক্ষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পার্ক গাজীপুরে একটি শকুন পুনর্বাসন কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে আহত ও উদ্ধারকৃত শকুনের চিকিৎসা ও সংরক্ষণ করা হচ্ছে। নির্মল পরিবেশ ও সুস্থ্য প্রকৃতির জন্য মহাবিপন্ন বাংলা শকুন রক্ষা করা আমাদের সকলের নৈতিক দায়িত্ব। অনেক দেরিতে হলেও জানাগেছে, শকুন অশুভ কোন পাখি নয়, তারা মানুষের বন্ধু। শকুনের প্রজনন স্থল, বিশ্রামস্থল, বাসা ও বিচরণ এলাকার বড় গাছ সংরক্ষণ করতে হবে। শকুন সংরক্ষণে গুরুত্ব সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে ছড়িয়ে দিতে সচেতনতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ ও উদ্বুদ্ধ করতে পারলে শকুন সুরক্ষা পদক্ষেপ সার্থক হবে। লেখক: সাংবাদিক