মাছের ঘেরের পাড়ে শসা চাষঃ পাল্টে দিচ্ছে রূপসার গ্রামের চিত্র

মোঃ আবদুর রহমান:
রূপসা উপজেলার একটি গ্রাম আনন্দনগর। এগ্রামে রয়েছে ছোট-বড় অনেক মাছের ঘের। একদা এসব ঘেরের পাড়ে কোনো ফসল চাষ করা হত না। পতিত অবস্থায় পড়ে থাকতো। এখন এসব মাছের ঘেরের পাড়ে শসা চাষে এ গ্রামের কৃষকের জীবনে এসেছে আর্থিক স্বচ্ছলতা, হয়েছেন স্বাবলম্বী। শসা চাষ করে ভাগ্যের চাকা ঘুরানোর পাশাপাশি, বেকার সমস্যার সমাধানের পথ খুঁজে পেয়েছেন অনেকে।
সরেজমিন আনন্দনগর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, রাস্তার পাশে বিস্তীর্ণ বিল জুড়ে শুধুই সবুজে ঘেরা শসা খেত। ঘেরের পাড়ে সারি সারি মাচায় ঝুলছে শসা আর শসা। এ গ্রামের শসা চাষি মুরাদ লস্কর জানান, এবছর তিনি ৫০ শতক ঘেরের পাড়ের জমিতে টাকি নামের হাইব্রিড জাতের শসা চাষ করেছেন। তিনি শ্রাবণ মাসের মাঝামাঝি সময়ে ঘেরের পাড়ে দুই হাত দূরে দূরে গর্ত/ মাদা করে শসা বীজ বপণ করেন। বীজ বপণের দেড় মাস পর থেকে শসা সংগ্রহ শুরু করেছেন। গ্রামের আড়তে পাইকারী বিক্রেতার কাছে তিনি প্রতিমণ শসা ৬শ’ টাকা দরে বিক্রি করেছেন। তার এই ৫০ শতক ঘেরের পাড়ের জমিতে শসা চাষ করতে ৭০-৮০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। তিনি এ পর্যন্ত ২৫ হাজার টাকার শসা বিক্রি করেছেন। ঘেরের পাড়ের এ জমি থেকে আরও দেড় লাখ টাকার শসা বিক্রি করতে পারবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করছেন।
একই গ্রামের কৃষক জুম্মান লস্কর। তিনিও এবছর ঘেরের এক বিঘা (৩৩ শতক) জমিতে গ্রীণ লাইন জাতের শসা চাষ করেছেন। এতে তাঁর খরচ হয়েছে ২৫ হাজার টাকা। তিনি এ পর্যন্ত ১৫ হাজার টাকার শসা বিক্রি করেছেন এবং আরও ৩০ হাজার টাকার শসা বিক্রি করতে পারবেন বলে জানান। মুরাদ লস্কর ও জুম্মান লস্কর ছাড়াও আনন্দনগর গ্রামের চাঁন মিয়া, সানু লস্কর, ইমতিয়াজ লস্কর, আবু সালেহ, লাবলু লস্কর, বনি আমিন, আব্দুর রহমান গাজী ও জাবের লস্করসহ প্রায় শতাধিক কৃষক মাছের ঘেরের পাড়ে হাইব্রিড জাতের শসা চাষ করে আর্থিকভাবে লাভবান হয়ে স্বাবলম্বী হয়েছেন। কৃষকরা জানান, ধানের তুলনায় শসা চাষে ২/৩ গুন বেশি লাভ হয়। অল্প পুঁজিতে লাভ বেশি হওয়ায় ঘেরের পাড়ে শসা চাষ এলাকায় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
এলাকার কৃষকরা আরও জানান, মাছের ঘেরের পাড়ে শসা চাষ করে ধান ও মাছের পাশাপাশি জমি থেকে একটা বাড়তি ফসল পাওয়া যায়। এতে পারিবারিক চাহিদা মিটিয়ে অতিরিক্ত শসা বিক্রি করে আর্থিক দিক দিয়ে লাভবান হওয়া যায়। ঘেরের পাড়ের মাটি বেশ উর্বর। এতে চাষকৃত শসা গাছ চারদিক থেকেই সূর্যের আলো পায়। এতে গাছের বৃদ্ধি ও ফলন ভালো হয়। সাধারণত মাছের ঘেরের পাড় উঁচু হয়। তাই বৃষ্টি বা সেচের পানি দ্রুত সরে যায়। একারণে বর্ষাকালে ঘেরের পাড়ে খুব সহজে শসা চাষ করা যায়। ঘেরের মধ্যে মাচায় শসা করায় বাড়তি জায়গা লাগে না। ঘেরের পাশে পানি থাকায় শসা গাছে পানি সেচ দিতে সুবিধা হয়। তাছাড়া ঘেরের পাড়ের শসা গাছের পরিচর্যা করতেও সুবিধা হয়। বসতবাড়ি কিংবা মাঠের চেয়ে ঘেরের পাড়ে শসা চাষ করে অধিক ফলন পাওয়া যায়। অন্য ফসলের তুলনায় কয়েকগুন বেশি লাভ হওয়ায় ঘেরের পাড়ে শসা চাষের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন এখানকার কৃষকেরা। ঘেরে শুধুমাত্র মাছ ও বোরো ধান চাষ করে একসময় যাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে কষ্টে দিন কাটত, ঘেরের পাড়ে শসা ও অন্যান্য শাক-সবজি চাষে এখন তাদের মুখে হাসি ফুটেছে। ঘেরের পাড়ে শসার পাশপাশি আগাম শীতকালীন টমেটো চাষও শুরু করেছেন অনেকে।
রূপসা কৃষি অফিসের সূত্রে জানা যায়, এ উপজেলার দুর্জনীমহল, ডোমরা, ভবানীপুর, জাবুসা, আমদাবাদ, দেবীপুর, নৈহাটী, সামন্তসেনা, তিলক, খাজাডাঙ্গা, স্বল্পবাহিরদিয়া, আলাইপুর, পুটিমারি, আনন্দনগর, পিঠাভোগ, গোয়ালবাড়িচর, সিন্দুরডাঙ্গা, নারিকেলী চাঁদপুর, ডোবা, বলটি, নতুনদিয়া, ধোপাখোলা, গোয়াড়া, শিয়ালী, চাঁদপুর ও বামনডাঙ্গা গ্রামের মাছের ঘেরের পাড়ে প্রায় ৪শ’ হেক্টর জমিতে এবছর শসা চাষ হয়েছে। তবে ঘাটভোগ ইউনিয়নের গ্রামগুলোতে সবচেয়ে বেশি জমিতে শসা চাষ হয়েছে। ঘেরের পাড়ে শসা চাষ করে কম সময়ে অধিক ফলন ও ভালো দাম পেয়ে এসব গ্রামের কৃষকরা দারুন খুশি। মূলত: ঘেরের পাড়ে শসা চাষ পাল্টে দিচ্ছে রূপসা উপজেলার অন্তত পঁিচশ গ্রামের চিত্র।
তবে মাছের ঘেরের পাড়ে শসা চাষের অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হলো পোকা-মাকড় ও রোগ-বালাইয়ের আক্রমণ। পোকার মধ্যে থ্রিপস পোকা ও মাকড় এবং রোগের মধ্যে ডাউনি মিলডিউ শসার ক্ষতি করে। এছাড়া শসা গাছের পাতা ও ফলে অনুখাদ্য বোরণ ও ম্যাগনেশিয়ামের অভাব দেখা যায়। শুধু তাই নয় জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে অত্যাধিক তাপমাত্রা ও খরার কারণে শসা চাষ ব্যাহত হয়। থ্রিপস পোকা দমনের জন্য ডেনিম ফিট-৫০ ডাব্লিউজি (১০ লিটার পানিতে ১.৫ মি. লি.), মাকড়ের জন্য ভারটিমেক-০১৮ইসি (১০ লিটার পানি ১৫ মি.লি.), আর ডাউনি মিলডিউ রোগ প্রতিকারের জন্য রিডোমিল গোল্ড এমজেড-৬৮ ডব্লিউজি (১০ লিটার পানিতে ৫০ গ্রাম) ব্যবহার করা হয়। বোরণ ও ম্যাগনেশিয়ামের ঘাটতি পূরণের জন্য যথাক্রমে সলুবর বোরণ (১০ লিটার পানিতে ১০ গ্রাম) ও ম্যাগমা (হেক্টর প্রতি ১৫ কেজি) ব্যবহার করা হয়। আর খরা মোকাবিলায় ঘেরের পাশ থেকে শসা গাছে পানি সেচ দেয়া হয়।
ঘেরের পাড়ে উৎপাদিত শসা বাজারজাতকরণের লক্ষ্যে প্রতিটি গ্রামে গড়ে উঠেছে শসা কেনা-বেচার মওসুমি আড়ত। কৃষকেরা খেত থেকে শসা তুলে এনে আড়তে বিক্রি করছেন। শসা চাষে মহিলা ও বেকার যুবকসহ স্কুল-কলেজের ছাত্রদেরও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। স্থানীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে ট্রাকযোগে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় চলে যাচ্ছে এখানকার শসা। স্থানীয় বাজারের ক্রেতারা টাটকা ও তাজা শসা কিনতে পেরে খুশি।
রূপসা উপজেলা কৃষি অফিসার মোঃ ফরিদুজ্জামান বলেন, অন্যান্য ফসলের তুলনায় মাছের ঘেরের পাড়ে শসা চাষ লাভজনক হওয়ায় এ উপজেলায় দিন দিন শসা চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘেরের পাড়ে কম খরচে শসা চাষ করে লাভবান হওয়ার জন্য এ উপজেলার প্রতিটি ব্লকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাগন চাষিদের পাশে থেকে সার্বক্ষণিক পরামর্শ দিয়ে চলেছেন। এছাড়া উপজেলা কৃষি অফিস থেকে এসব কৃষকদের প্রশিক্ষণসহ সার্বিক সহযোগিতা করা হচ্ছে। ফলশ্র“তিতে এবছর কৃষকেরা ঘেরের পাড়ে শসা চাষ করে আশাতীত ফলন পেয়ে লাভবান হয়েছেন। এতে কৃষকের মধ্যে ঘেরের পাড়ে শসা চাষে ব্যাপক আগ্রহ ও উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে। তারা আগামীতে মাছের ঘেরের পাড়ে আরও বেশি করে শসা চাষ করবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। আর এতে আর্থিক স্বচ্ছলতার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থার মাধ্যমে বেকার সমস্যার সমাধান হবে এবং দেশের কৃষি নির্ভর অর্থনীতির চাকা আরো গতিশীল হবে। দেশ হবে সমৃদ্ধ। লেখক: উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা উপজেলা কৃষি অফিস রূপসা, খুলনা।

Check Also

ডিসেম্বরের ২১ দিনে রেমিট্যান্স এল ২ বিলিয়ন ডলার

চলতি ডিসেম্বর মাসের প্রথম ২১ দিনে দেশে বৈধ পথে ২০০ কোটি  মার্কিন (২ বিলিয়ন) ডলারের …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।