ক্রাইমবার্তা রির্পোট:: কপোতাক্ষ পাড়ের রামনাথপুর, হাবিবনগর, দরগাহমহল, মালতসহ পার্শবর্তী আরও কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দাদের দিন চলছে ভাঙন আতংকে। এক সময়ের খরস্রোতা কপোতাক্ষ নদ কাটার ফলে চিত্র পরিবর্তন হতে চলেছে ওইসব গ্রামের। নদটির মূল মানচিত্র বদলে এখন ভিন্ন জায়গা থেকে যাওয়ায় ভাঙ্গণ এমন পর্যায়ে গেছে যে, অনেকে বছরে তিনবার ঘর সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন অন্যত্র। যার যার ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী মানত এবং বিভিন্ন কর্মসূচিও পালন করেছেন। কোন কিছুতেই যেন ওইসব এলাকার ভাঙ্গন রোধ করতে পারছে না। বছরের ৫/৬ মাস সেখানকার অধিকাংশ পুরুষকে থাকতে হয় সাগরে মাছ ধরার কাজে। এসময় একদিকে সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে স্বামী-সন্তানদের জন্য যেমন নারীরা থাকেন আতংকে আবার সাগরে বসেও নদী ভাঙ্গনের দুশ্চিন্তায় থাকতে হয় ওইসব জেলেদের। সব মিলিয়ে এক চরম সংকটের দিকে ধাবিত হতে হচ্ছে কপোতাক্ষ তীরের ওই অংশের বাসিন্দাদের।
সরেজমিনে পরিদর্শনকালে কথা হয় রামনাথপুরের মহিতোষ, অনাথ বিশ্বাস, অসীম কুমার মন্ডলসহ অনেকের সাথে। তারা জানান, প্রতি বছর অক্টোবর থেকে মার্চ এই ছয় মাসই তারা থাকেন বঙ্গোপসাগরে। মাছ ধরেন সুন্দরবন সংলগ্ন আলোরকোল, দুবলার চরসহ বিভিন্ন স্থানে। কেউ কেউ আবার সাগর থেকে ফিরেও আসেন না। অনেকে ছয় মাস পর বাড়ি ফিরে ভাঙ্গনে সব হারিয়ে গেছে এমনটিও দেখতে পান। সব মিলিয়ে সবদিকেই ঝুঁকির মধ্যে দিন যাপন করতে হচ্ছে সেখানকার বাসিন্দাদের।
স্থানীয় অসীম কুমার মন্ডল জানালেন, পাঁচ মাস সাগরে আর বাকী সাত মাস স্থানীয় ছোট নদীতে মাছ ধরে সংসার চালানোই তার মূল পেশা। কখনও সাগরে গেলে ফিরে আসার আশাও থাকে ক্ষীণ। তার পরেও মহাজনদের কাছ থেকে দাদন নিয়ে প্রতি বছরই তারা গিয়ে থাকেন সাগরে। মাছ ধরে শুটকি করে সেগুলো বিক্রি করে আয় করেন অর্থ। কিন্তু সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে তাদের যে ঝুঁকির মধ্যে থাকতে হয় চড়া সুদের মহাজনরা সে ঝুঁকির হাত থেকে রক্ষায় তেমন কোন পদক্ষেপই এ পর্যন্ত নেননি। সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া জেলেদের দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষায় একটি বেসরকারি সংস্থা দিয়েছে লাইফ জ্যাকেট, বয়া, টর্চ লাইট, মোবাইল, কম্পাস, ওষুধের বক্স এবং সিগনাল শোনার জন্য রেডিও। এখন দুর্যোগ হলেও তারা নিরাপদে সরে আসতে পারে সতর্ক সংকেত পেয়ে। কখনও নৌকা/ট্রলার ডুবে গেলেও বয়ায় ভাসিয়ে রাখতে সক্ষম হচ্ছে। নিজেরাও লাইফ জ্যাকেট পরে পানিতে ভেসে থাকতে পারছেন। আবার লাইফ জ্যাকেটের সাথে রয়েছে একটি করে বাঁশি। যার মাধ্যমে দূরের কোন বড় যানকে তারা ডাকারও সুযোগ পাচ্ছেন। এভাবেই তাদের পেশায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে ওই সংস্থাটি। কিন্তু নদী ভাঙ্গন রোধ কল্পে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে নেয়া হয়নি তেমন কোন পদক্ষেপ। ফলে নারী-শিশুদের নিয়ে সেখানকার মানুষের দিন চলছে আতংকে। কোন কোন দিন রাতে ঘুমিয়ে পড়লে ঘুমের ঘরেও নদীর ভাঙ্গনের কবলে পড়তে হয় সেখানকার মানুষদের। এ অবস্থায় তারা কপোতাক্ষের মানচিত্র ঠিক রেখে নির্দিষ্ট স্থান থেকে কাটার আহবান জানান।
দীনবন্ধু বিশ্বাস নামের এক বাসিন্দা জানান, কপোতাক্ষের ভাঙ্গনের শিকার হয়ে অনেকেই এখন দেশছাড়া হয়েছেন। ৮৮’র ঝড়ে নিরাপদ বিশ্বাস নামের এক ব্যক্তিকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তার ছেলে বিকাশ বিশ্বাস বলেন, তিনি এখন নদীতে কাকড়া ধরে জীবিকা নির্বাহ করছেন। তার বাবা নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে তার মা পরের বাড়িতে কাজ করে তাদেরকে মানুষ করেছেন। অনেক কষ্টে চলেছে তাদের দিন। এখন আবার নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়তে হচ্ছে তাদেরকে।
পরিতোষ বিশ্বাস বললেন, নদী ভাঙ্গনের ফলে কেউ কেউ পার্শবর্তী দেশ ভারতেও পাড়ি জমিয়েছেন।
নদী ভাঙ্গনের করুণ কাহিনী বর্ণনা করতে গিয়ে দীনবন্ধু বিশ্বাসের স্ত্রী কালীদাসী বিশ্বাস বলেন, অনেক সময় রান্না করতে করতে উনুনও ভেঙ্গে পড়ে নদীতে। নদী ভাঙ্গনের শব্দে অনেক সময় ঘুম ভাঙ্গে। বিয়ের পর এ পর্যন্ত চার বার ঘর পাল্টাতে হয়েছে বলে জানালেন মিনতি রানী বিশ্বাস।
জয়ন্তী বিশ্বাস বললেন, তাদের এখন একটাই দাবি যেন পুরনো নদীটি কেটে নতুন সৃষ্ট নদী ভরাট করে তাদের বাসস্থান নিশ্চিত করা হয়।
নদী ভাঙ্গনের কবল থেকে রক্ষা পেতে গরু কেটে রক্ত দেয়া হয়েছে ধর্মীয় বিশ^াস থেকে। এমনটি জানিয়ে শাস্তি বিশ্বাস বললেন, এর পরেও নদী ভাঙ্গন কমেনি।
নদী ভাঙ্গন সম্পর্কে ১ নম্বর হরিঢালী ইউপি চেয়ারম্যান আবু জাফর সিদ্দিকী রাজু বলেন, সাম্প্রতিক ভাঙ্গনের ফলে অনেক এলাকার মানচিত্র বদলেছে। ছোটবেলায় যে রাস্তা আর বাড়িঘর তিনি নিজে দেখেছেন সেসব আজ শুধুই স্মৃতি। বিষয়টি অনেকটা অমানবিক। এজন্য অনেকবার ইউনিয়ন পরিষদে মিটিং করে রেজুলেশন করা হয়েছে। স্থানীয় সংসদ সদস্যকেও জানানো হয়েছে। বর্তমান সংসদ সদস্য মো. আকতারুজ্জামান বাবু এ ব্যাপারে অনেক আন্তরিক। কপোতাক্ষের মূল স্থান থেকে অন্যদিক থেকে প্রবাহিত হওয়ায় এমনটি হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এজন্য বাঁক সোজা করতে হবে। পানি উন্নয়ন বোর্ড বালুভর্তি বস্তা ফেলে ভাঙ্গন রোধের চেষ্টা করছে ঠিকই কিন্তু আশানুরূপ ফল হচ্ছে না।
সম্প্রতি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত পানি সম্মেলনে জনসাধারণের প্রশ্নের জবাবে খুলনা-৬ আসনের সংসদ সদস্য মো. আকতারুজ্জামান বাবু বলেন, নদী ভাঙ্গন এবং প্রভাবশালীদের হাত থেকে সরকারি সম্পত্তি রক্ষায় তিনি প্রয়োজনে জাতীয় সংসদেও কথা বলবেন।
তিনি বলেন, নদী ভাঙ্গন রোধের জন্য তিনি পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলেছেন। দ্রুততার সাথে কিভাবে নদী ভাঙ্গন রোধ করা যায় সে চেষ্টা চলছে। তবে স্থায়ীভাবে নদী ভাঙ্গন রোধ করতে হলে টেকসই বেড়িবাঁধ ও টেকসই পাইলিং প্রয়োজন। এজন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা হাতে নেয়া হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
Check Also
সাতক্ষীরায় ৪ গ্যালন ফরমালিন পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার
নিজস্ব প্রতিনিধি: সাতক্ষীরা থানা পুলিশ অভিযান চালিয়ে ৪ গ্যালন ফরমালিন পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার করেছে। তবে এসময় …