তুরস্কে পাঁচ বছরের যে ঘটনা মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে

ক্রাইমবার্তা রিপোটঃ বিবিসি : “ইস্তান্বুল কখনো তোমাকে ছাড়বে না,-এর সৌন্দর্য্য পিছু টানবে তোমাকে,” এখানে যখন আমি আমার জীবটাকে গুছিয়ে নিচ্ছিলাম তখন আমার এক বন্ধু আমাকে এই কথাটি বলেছিল।

পাঁচ বছর পর এখন চলে যাওয়ার সময় এসেছে, আর আমি মনে করছি, ২০১৪ সালে লন্ডনের এক জ্যেষ্ঠ সম্পাদক মুখে একটি হাসি নিয়ে আমাকে সেদিন কী বলেছিল: “আহ, হ্যাঁ, তুরস্ক…আলোচনায় আসতে হলেও যাকে কিছুটা বেগ পেতে হয়।”

তাহলে বসফরাসের তীরে সেই অবসন্ন সন্ধ্যাগুলোর কী হবে, যা মিনারের আড়ালে সূর্য্য ডোবা দেখে কেটে গেছে?

এর পরিবর্তে, আমি দেশটির আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে অশান্ত সময়গুলোর একটি নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছিলাম: সন্ত্রাসী হামলা-কয়েক ডজন, অভিবাসন সংকট, রক্তাক্ত ও ব্যর্থ সেনা অভ্যূত্থান, এর পরের শুদ্ধি অভিযান, কুর্দি জঙ্গিদের সাথে সংঘর্ষ, আর সিরিয়া থেকে বাড়তি পাওনা তো ছিলই। এই তালিকা আরো লম্বা।

বিংশ শতাব্দির শুরুর দিকে যেসব বই প্রকাশিত হতো, সেগুলো তুরস্ক এবং এর নেতা রেচেপ তায়েপ এরদোয়ানকে নিয়ে আশার কথায় পূর্ণ ছিল।

মনে হচ্ছিল যেন, ৯/১১ এর পরে বিশ্বে গণতন্ত্র এবং ইসলামকে রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছিল তুরস্ক, যখন পশ্চিমারা মধ্যপ্রাচ্যে তাদের অংশীদারের খোঁজে ছিল।

তিনি এখানে সামরিক পদযাত্রা বন্ধ করে দেন, অর্থনীতিতে সংস্কার আনেন, এছাড়া যে ধর্মীয় তুর্কিরা দীর্ঘকাল ধরে অসাম্প্রদায়িক সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে বঞ্চনার শিকার হয়ে আসছিল তাদের ক্ষমতাবান করেন। এবং তুরস্ককে ইইউ সদস্যপদের প্রার্থী করেন।

কী পরিবর্তন হয়েছিল?

কখন মি. এরদোয়ান এবং তুরস্কের এই চেহারা পরিবর্তন হয়েছিল তা নিখুঁতভাবে শনাক্ত করাটা কঠিন।

সম্ভবত, ইস্তান্বুল শহরের দুর্লভ সবুজের ছোঁয়ায় ঘেরা গেজি পার্কে তার মতের বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত ২০১৩ সালের গণ এবং সরকারি বিরোধী বিক্ষোভও হতে পারে।

অথবা সম্ভবত তাঁর আরেক প্রতিদ্বন্দ্বী ইসলামি গোষ্ঠী যা সমাজের প্রতিটি স্তরে প্রবেশ করেছিল- সেই গুলেনপন্থীদের মধ্যে বিভক্তি এবং যাকে তিনি ২০১৬ সালের জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত অভ্যুত্থান চেষ্টার জন্য দায়ী করেছেন।

অথবা এটাও হতে পারে যে, বিশ্বটাই আসলে বদলে গেছে। ইউরোপ আরো সংকীর্ণ হচ্ছিল, জাতীয়তাবাদ বাড়ছিল এবং যুক্তরাজ্যে, ব্রেক্সিট বিতর্কের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছিলে তুরস্ক, গণ অভিবাসনের জন্য যার সংশ্লিষ্টতা ছিল।

আশাহীন একটি তুরস্কে স্থানান্তরিত হচ্ছিলাম আমি; যেখানে ক্রমবর্ধমান মেরুকরণ অনুভূত হত।

কুর্দি বিদ্রোহী

২০১৫ সালে কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) জঙ্গিদের সাথে তুর্কি রাষ্ট্রের যুদ্ধ শুরু হয়। একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন যাতে পরের দশকগুলোতে ৪০ হাজার প্রাণহানি হয়েছিল।

কুর্দি সংখ্যাগরিষ্ঠ দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় তুরস্কের সড়ক বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল, বালাক্লাভা এলাকায় উগ্র তরুণদের পাহারায় বসানো হয়েছিলো যাদের ভাইয়েরা পার্বত্য এলাকায় পিকেকে- যা যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয় ইউনিয়ন এবং তুরস্কের চিহ্নিত জঙ্গি সংগঠন তাদের পক্ষে লড়ছিলো।

দিয়ারবাকির, যেটি কিনা ওই এলাকার মূল শহর, ট্যাংক এবং ভারী অস্ত্রধারী পুলিশের মাঝখান দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম আমি, স্বয়ংক্রিয় বন্দুকের গুলি আর শেলের শব্দ শুনছিলাম।

এমিনি কাগির্গার সেই স্থির চাহনির কথা মনে করতে পারি আমি যার ১০ বচর বয়সি সন্তান কেমিলি তার বাড়ির কাছে পুলিশি অভিযানে নিহত হয়েছিলোম।

এমিনি আমাকে সেই ফ্রিজটি দেখিয়েছিল যেখানে সে তার মেয়ের মরদেহ দুদিন ধরে রেখে দিয়েছিলো যাতে পচন না ধরে।

ভুলব না তুরস্কের পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সেই সব শোকাতুর স্বজনদের চিৎকার, যারা রাস্তার পাশে পিকেকে’র পেতে রাখা বোমার বিস্ফোরণে প্রাণ হারিয়েছিল।

সেখানে ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠী সন্ত্রাসী হামলা চালাতো। তাদের টার্গেটের মধ্যে ছিলো ইস্তান্বুল বিমানবন্দর। ওই হত্যাকান্ড শেষ হওয়ার পর আমি সেখানে গিয়েছিলাম।

যুদ্ধ-বিধ্বস্ত সিরিয়া থেকে আইএস যোদ্ধারা তুরস্কে রাজনৈতিক জন সমাবেশ, পর্যটক এলাকা এবং ২০১৬ সালের নববর্ষ উপলক্ষ্যে ইস্তান্বুল নাইটক্লাব গুলো উড়িয়ে দিতে এসেছিলো।

আমার সময়ে সবচেয়ে হৃদয় বিদারক সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম আলি আলসাহোর। তিনি ছিলেন, ইউরোপে পাড়ি জমাতে চাওয়া হাজারো সিরীয় শরনার্থীদের একজন যারা তুরস্কে পৌছেছিলেন।

একটি কাঠের নৌকার জন্য মানব পাচারকারীদের অতিরিক্ত অর্থ দিয়েছিলেন তিনি। যা ছিল রাবারের ডিঙ্গি নৌকার চেয়ে কিছুটা নিরাপদ।

নৌকায় ওঠার মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যেই এতে পানি ভরে যায়। তার স্ত্রী এবং সাত সন্তানের সবাই ডুবে যায়, যাদের মধ্যে সবার ছোটটির বয়স ছিলো মাত্র ২০ দিন।

শরনার্থীদের মধ্যে এ ধরণের আরও অনেক গল্প ছিল। প্রায় ৪০ লাখ শরনার্থী তুরস্কে বাস করে। যা অন্যান্য দেশের চেয়ে অনেক বেশি।

এতো উদারতার পরও, এখানে আরো অনেক মানসিক বিকার ছিল।আর এটি হয়েছিলো জাতীয়তাবাদী পরিচয়ের কারণে যা প্রথম তৈরি করেছিলেন কামাল আতাতুর্ক, যিনি আধুনিক রাষ্ট্রের স্থপতি।

“এক, দুই, তিন, তুর্কিরা দীর্ঘজীবি হোক,” যা শিশুরা গণনা শেখার সময় বলে থাকতো। এটা চলতে থাকলো: “চার, পাঁচ, ছয়, পোল্যান্ড ধ্বংস হোক। সাত, আট, নয়, জার্মানরা শুয়োর। দশ, এগারো, বার, ব্রিটিশরা শেয়াল।” তিনি বলেন।

গুগলে “এরদোগান বন্ধ করেছে…” লিখে খুঁজলে পাওয়া যায় ন্যাটো, ইসরায়েল, ইউরোপ, “কথিত কিছু বুদ্ধিজীবি” এবং অবশ্যই বিবিসি।

আমি তুরস্কের একটি সংবাদপত্রের প্রথম পাতা সংরক্ষণ করেছি যেখানে আমাকে বলা হয়েছে “একজন ব্রিটিশ বিশ্বাসঘাতক যাকে আটক এবং প্রত্যাবাসন করা উচিত”। বিরোধি দলের সক্রিয় কর্মীদের সাক্ষাৎকার নেয়ার কারণে এমনটা বলা হয়।

ভিন্নমত পোষণকারীদের কিভাবে

দমন করেছে এরদোগান

যখন ২০১৬ সালে বিদ্রোহী সেনারা ক্ষমতা নেয়ার চেষ্টা করেছিলো, তখন সন্দেহ তাৎক্ষণিকভাবে বাহিনীর অন্যদের উপর পরে।

সেনা অভ্যুত্থান যাতে ২৬০ জন মানুষ প্র্রাণ হারায়, সেটি ছিলো মূলত একটি সন্ধিক্ষণ। এটি আসলে এরদোয়ানের ভীত আরো শক্তিশালী করেছিলো। সে প্রায় আড়াই লাখ মানুষের উপরন দমন-পীড়ন চালিয়েছিলো তাদেরকে কারাদন্ড, বরখাস্ত কিংবা বহিষ্কার করে।

আমি ৮২ বছর বয়সি এক নিউরো-সাইকোলজিস্টের কথা কখনো ভুলবো না। তাকে সন্ত্রাসীদের সমর্থক আখ্যা দিয়ে তার ভাতা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল।

“১৯৭১ সালের সেনা অভ্যুত্থানের পর তুরস্ক ছাড়ি আমি আর আমার স্বামী,” তিন বলেন। “তখন সীমাহীন নিপীড়ন চালানো হতো, আমাদের মতো বামপন্থীদের ধরে কারাগারে রেখে আঙুলের নখ উপরে ফেলা হতো।” তিনি থামেন, বসফরাসের দিকে তাকিয়ে আবার বলতে শুরু করেন। “কিন্তু আজকের অবস্থা আরো খারাপ, কারণ তখন অন্তত বিচার ব্যবস্থাকে বিশ্বাস করতে পারতাম আমরা।”

সাংবাদিক কিংবা মানবাধিকার কর্মী যারা তাদের বন্ধু ছিলো, যাদেরকে আটকে রাখা হয়েছে কিংবা গুরুতর অভিযোগ দিয়ে ফেরার করে রাখা হয়েছে তাদের সাথে দেখা করা খুবই কঠিন।

২০১৪ সালে আমার পৌঁছানোর পর এক পার্টিতে, তুরস্কের এক নারী মেলিস উষ্ণ হেসে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল: “তো আপনি এখানে নতুন, হু?”

“একটা কথা আমাদের সম্পর্কে আপনাকে জানতে হবে। আর তা হলো আমরা জঙ্গি মানুষ। সেটা ধর্মীয়, ধর্মনিরপেক্ষ, সামরিক, আতাতুর্ক-প্রেমী, এরদোয়ান-প্রেমী কিংবা আমরা যেভাবে পার্টি করছি সেটাও হতে পারে- আমরা এটা ১১০% করি।”

সে কথাগুলো সত্য হয়েছিল। বিশাল চরিত্র, শক্তিশালী আত্মা, শক্তিশালী প্রকৃতির একটি দেশ এটি। এই দেশ এবং আমি, এই উত্তেজনাপূর্ণ এবং আকর্ষণীয় পাঁচ বছরের কারণে স্মরণীয় হয়ে থাকবো।

Check Also

যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার

নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।