ক্রাইমর্বাতা রিপোর্ট সাতক্ষীরা: পাটকেলঘাটার খলিষখালী ইউনিয়নে জলাবদ্ধ ৭টি খালের শ্রেণি পরিবর্তন করে কৃষি ও পরিত্যক্ত চাষযোগ্য জমি দেখিয়ে স্থায়ীভাবে বন্দোবস্ত দেয়া হয়েছে। ফলে প্রায় দুই শতাধিক বিঘা জমি সরকারের বেহাত হয়ে গেছে। ভূমিহীন নামধারী ব্যক্তিদের অনুকূলে দেয়া স্থায়ী বন্দোবস্তের এ বিপুল পরিমাণ সম্পত্তির বেশির ভাগই হাত বদল হয়ে চলে গেছে প্রভাবশালীদের দখলে।
বর্ষামৌসুমে একদিকে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে। অন্যদিকে জলাবদ্ধ এসব খালগুলোতে বেড়ি বাঁধ দিয়ে মৎস্য চাষ করায় খালের আশেপাশের জমির পানি সরানোর ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেছে। এ ঘটনায় খলিষখালী ইউনিয়নের দক্ষিণাঞ্চলের বিল এলাকার চাষীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। তারা ইজারা বাতিল করে জলাবদ্ধ খালগুলোতে পানি প্রবাহ স্বাভাবিক রাখার দাবী জানিয়েছেন।
সরেজমিনে গেছে, তালা উপজেলার খলিষখালী ইউনিয়নের খলিষখালী মৌজার দুধলিয়া গ্রামের বিলের কয়েক হাজার বিঘার জমির পানি নিষ্কাশনের একমাত্র খাল যা তেয়াশিয়া নদীর সাথে সংযুক্ত। এই খালটি জলাবদ্ধ খাল। কিন্তু কয়েক বছর আগে স্থানীয় ভূমি কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে জলাবদ্ধ খালটি কাগজ কলমে দেখানো হয়েছে চরভরাটি পরিত্যক্ত জমি। জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে শতাধিক বিঘা এই খালটি স্থায়ী বন্দোবস্ত দেয়া হয়েছে প্রভাবশালীদের নামে। ফলে খালের আশেপাশের কয়েক হাজার বিঘা জমির পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা বাঁধাপ্রাপ্ত হয়।
একই সাথে কাশিয়াডাঙ্গা ও খলিষখালী মৌজার কাশিয়াডাঙ্গা বিলের জলাবদ্ধ খালটির এইকভাবে শ্রেণি পরিবর্তন করে প্রভাবশালীদের কাছে স্থায়ী বন্দোবস্ত দেয়া হয়েছে।
গাছা মৌজার খড়িয়াডাঙ্গা খালটি কয়েক শ’ বিঘা আয়তনের। যা শ্রেণি পরিবর্তন করা হয়েছে। ভূমি কর্মকর্তাদের আর্থিক সুবিধা দিয়ে জলাবদ্ধ খালটি ভরাট দেখিয়ে চাষাবাদের জন্য ইজারা দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে বর্ষা মৌসুমে টিকারামপুর মৌজা ও খলিষখালী মৌজার টিকারামপুর খালটি ইজারা দেয়ায় খালের উপর নির্ভরশীল কয়েক হাজার বিঘা জমির পানি নিষ্কাশন বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে। সুকতিয়া মৌজার সুকতিয়া খালটি ইজারা দেয়ায় একই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
পারকৈখালীর হন্যেমারী খালটিতে এখনও বুকসমান পানি। সেটিও ভরাট খাল দেখিয়ে জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা হয়েছে। দেখানো হয়েছে ভরাট খাল। সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, এখনও বুকসমান পানি। সেখানে হচ্ছে মৎস্য চাষ। আশপাশের পানি জমির পানি নিষ্কাশন হয় না। ধুকুড়িয়া খালটি বর্তমানে একই অবস্থা। প্রভাবশালীরা খালটি ইজারা নিয়ে সেখানে খন্ডখন্ড করে বেড়িবাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করছে। ফলে কৈখালী, পাকশিয়া, মঙ্গলানন্দকাটি, বারানগর, টিকারামপুর বিলের পানি নিষ্কাশন হচ্ছে না। বারানগরের ঘন্টার খালটি বর্তমান পানিনিষ্কাশন একেবারেই বন্ধ রয়েছে।
কৈখালী গ্রামের ইউপি সদস্য তপন কুমার বাছাড় জানান, কৈখালী, বারানগর, ধুকুড়িয়া যে খালটি ভরাটখাল দেখানো হয়েছে সেই খালটিতে এখন বুক সমান পানি। খালটিতে খন্ডখন্ড বাঁধদিয়ে সেখানে মাছ চাষ করা হচ্ছে। ফলে এলাকার চাষীরা বর্তমানে বোরো আবাদ করতে বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে আশে পাশের জমির পানি নিষ্কাশন করতে না পেরে। বোরো আবাদ ক্ষতির মুখে পড়া কয়েক হাজার চাষী বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে।
বরানগর গ্রামের কালিপদ মন্ডল ওরপে ঘন্টা মন্ডল (৬৫) জানান, ছোট বেলা থেকে দেখে আসছি বারানগর খালটি বড় একটি খাল ছিল। ওই খাল দিয়ে আশে পাশের ১০টি গ্রামের পানি নিষ্কাশন হতো। ধান চাষ ও মাছ চাষ সবই হতো। কিন্তু দুর্নীতিবাজ ভূমি কর্মকর্তা জলাবদ্ধ এই খালটির শ্রেণি পরিবর্তন করে ভরাট খাল দেখিয়ে প্রভাবশারীদের কাছে স্থায়ী বন্দোবস্ত দিয়েছে। এখন খালটিতে খন্ডখন্ড করে সেখানে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করা হচ্ছে।
সুকতিয়া গ্রামের ইউপি সদস্য গনেশ চন্দ্র বর্মন জানান, তার এলাকার টিকারামপুর, সুকতিয়া, দলুয়া, দুধলিয়া গ্রামের কয়েক হাজার বিঘা জমির পানি নিষ্কাশনের দুটি খাল একটি দুধলিয়া খাল ও টিকারামপুর ও সুকতিয়া খাল একসময় পানিতে টইটুম্বর ছিল। এলাকার বিল এলাকার মানুষ সেখানে জাল দিয়ে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতো। কিন্তু এসব ¯্রােতধারা খালের শ্রেণি পরিবর্তন করে দুর্নীতিবাজ ভূমি কর্মকর্তারা ভরাট খাল দেখিয়ে বন্দোবস্ত দিয়েছে। পরে তা বিক্রি হয়ে প্রভাবশালীদের দখলে চলে গেছে। ইজারা কোন নীতিমালা মানা হয়নি। সম্পূর্ণ নিয়মনীতি উপেক্ষা করে খালগুলো স্থায়ী বন্দোবস্ত দেয়া হয়েছে।
খলিষখালী ভুমি অফিসের কর্মকর্তা অরুন কুমার পাল জানান, তিনি কর্মস্থলে নতুন এসেছেন। ভূমির শ্রেণি পরিবর্তন করে খালগুলো ভরাট দেখিয়ে ইজারা দেয়া হলে তা অবশ্যই বাতিল করতে তিনি উর্দ্ধতন কর্তপক্ষের সাথে কথা বলবেন।
খলিষখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোজাফ্ফর রহমান জানান, তিনি জলাবদ্ধতা নিরসনে ইতোমধ্যে তালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসনের সাথে কথা বলেছেন। ভূমির শ্রেণি পরিবর্তন করে পানি প্রবাহের খালগুলো ভরাট খাল দেখিয়ে স্থায়ী বন্দোবস্ত দেয়া হয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেন। তিনি খালের ইজারা বাতিলসহ খালগুলো খনন করে পানি প্রবাহ নিশ্চিত করতে জেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
তালা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ঘোষ সনৎ কুমার জানান, কোনভাবেই জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে জলাবদ্ধ খালকে কৃষি জমি হিসেবে দেখানো আইন সঙ্গত হয়নি। এর ফলে জলবদ্ধখালগুলোতে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করে কোনভাবেই পানি প্রবাহ বন্ধ করা যাবে না। তিনি জনগণকে সাথে নিয়ে জলাবদ্ধতা সৃষ্টিকারী সব খালের বাঁধ অপসারণের জন্য সহযোগিতা করবেন বলে জানান।
এ বিষয়ে তালা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) খন্দকার রবিউল ইসলাম জানান, জমির শ্রেণি পরবর্তন করে ইজারা দেয়া হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বিষয়টি তদন্ত করে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার কথা উল্লেখ করেন।