ক্রাইমবার্তা রিপোটঃ :: ক্ষমতায় টিকে থাকতে সরকার ভারতের সাথে জাতীয় স্বার্থ বিরোধী চুক্তি করেছে বলে অভিযোগ করে এর বিরুদ্ধে গণঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছে বিএনপি। গতকাল শনিবার বিকেলে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে আয়োজিত এক সমাবেশে বিএনপির শীর্ষ নেতারা এই আহ্বান জানান। বক্তারা বলেছেন, অবৈধ আওয়ামী লীগ সরকার খাদে পড়ে গেছে। সরকারের পতন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। এ ধরনের সরকার জনগণ কখনো বরদাশত করে না। আবরারের রক্ত সরকার পতনের বীজ বপন করে গেছে।
এদিকে দীর্ঘদিন পর বিএনপি পুলিশের অনুমতি ছাড়াই রাজধানীতে সমাবেশ করেছে। এই ঘটনায় পুলিশ দলটির অর্ধশতাধিক নেতার্মীকে গ্রেফতার করেছে বলে জানা গেছে।
নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে দেশবিরোধী চুক্তি বাতিল ও বাংলাদেশ প্রক্শৌল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যার প্রতিবাদে দুইদিনের কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। আজ রোববার হবে সারাদেশে জেলা সদরে। কার্যালয়ের সামনে ফুটপাতে বসে এই সমাবেশ শুরু হয় বেলা দেড়টায়, শেষ হয় সাড়ে চারটায়। সমাবেশে খালেদা জিয়া ও আবরার ফাহাদের ছবির পাশাপাশি ‘দেশবিরোধী’ চুক্তি বাতিলের দাবি সম্বলিত প্ল্যাকার্ডও দেখা গেছে নেতা-কর্মীদের হাতে হাতে। কাকরাইলের নাইটেঙ্গল রেস্তোরাঁ থেকে শুরু করে ফকিরের পুল মোড় পর্যন্ত দীর্ঘ সড়কে হাজার হাজার নেতা-কর্মীর উপস্থিতিতে বিকাল চারটায় সমাবেশ জনসমুদ্রে রূপ নেয়। নয়া পল্টনের সড়কের ওপর এই সমাবেশ হলেও সড়কের একপাশে একটি গাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা রাখা হয়। এই চলাচল সচল রাখতে জনস্রোতকে সরিয়ে যানচলাচলের ব্যবস্থা করতে মির্জা আব্বাসকে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ব্যবস্থা নিতে দেখা গেছে।
এই সমাবেশের মধ্যদিয়ে বিএনপি রাজধানীতে দীর্ঘ প্রায় চার বছর পর কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করলো। সর্বশেষ ২০১৬ সালের ৫ জানুয়ারি এই নয়াপল্টনেই বিএনপি গণতন্ত্র পূণরুদ্ধারে সমাবেশ করেছিল। সেই সমাবেশে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। বর্তমানে তিনি কারাবন্দী।
সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদ্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ফেনীর নদীর পানি সরবারহ, চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র বন্দর ব্যবহার, বঙ্গোপসাগরের উপকূলে পর্যবেক্ষণে যৌথ রাডার স্থাপন, আমদানিকৃত এলজিপি রপ্তানি করা- এই চারটি বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ বিরোধী বলে আমরা মনে করি। এই চারটি চুক্তির একটিও বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থে নয়, জাতীয় স্বার্থে নয়। আপনাদের নতজানু পররাষ্ট্র নীতি এবং ভারত তোষণের নীতি হিসেবে আপনারা এসকল চুক্তি করে এসেছেন। উদ্দেশ্য একটাই গায়ের জোরে ক্ষমতায় থাকার জন্যে দেশের গণতন্ত্রকে আপনারা হত্যা করেছেন, ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন ২৯ তারিখ রাতে ভোট ডাকাতি করেছেন, এই ডাকাতির সরকার আজকে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য আমাদের স্বার্থ বিকিয়ে দিচ্ছেন।
ড. খন্দকার মোশাররফ বলেন, ‘‘এদেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের অধিকার আছে এসব চুক্তির প্রতিবাদ করার। আমরা বলতে চাই, আমরা এই প্রতিবাদ আর সমাবেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকব না। দেশের জনগণ এক সাগর রক্তের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন করেছিলো, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ক্ষুণœ হতে পারে, সম্প্রসারণবাদ, আধিপত্যবাদ বাংলাদেশকে গ্রাস করতে পারে। এমন অবস্থায় বাংলাদেশের মানুষ বসে থাকবে না।
সরকারের ভারতপ্রীতি নীতির কঠোর সমালোচনা করে খন্দকার মোশাররফ বলেন, ২০০১ সালে আজকের প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, গ্যাস ভারতকে না দেয়ার কারণে আমি ক্ষমতায় আসতে পারি নাই। আজকে জনগণের মধ্যে প্রশ্ন এসেছে, দেশের আমদানি করা এলপিজি ভারতকে দিয়ে ২০০১ সালের গ্যাস না দেয়ার আপনি খেসারত দিচ্ছেন কিনা। আপনারা দেখেছেন, এই চুক্তি কত বড় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিরোধী চুক্তি এবং আমাদের দেশে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার এক চুক্তি-এর প্রতিবাদ বুয়েটের মেধাবী ছাত্র সেটার প্রতিবাদ করে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলো। তার জন্য আজকে তাকে প্রাণ দিতে হয়েছে। আমি বলতে চাই, আবরারের এই স্ট্যাটাস এদেশের জনগনের মনের কথা, এদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার পক্ষের কথা, আবরারের একথা এদেশে আধিপাত্যবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কথা।
সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, আপনারা শুধু আবরারকে হত্যা করে নাই, তাকে হত্যা করে আপনারা বাংলাদেশের জনগনের স্বার্থকে হত্যা করেছেন, আপনারা এদেশে আধিপত্যবাদকে বিস্তার করার জন্য আবরারকে হত্যা করেছেন। আজকে সারা বাংলাদেশের মানুষ, ছাত্র সমাজ ফুঁসে উঠেছে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে। আজকে যারা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে চুক্তি করে, আজকে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতন্ত্রকে যারা হত্যা করেন, এদেশে যারা চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ, ক্যাসিনোবাজ, সন্ত্রাস-নৈরাজ্য সৃষ্টি করে যারা ক্ষমতায় থাকতে চান। আমরা বিশ্বাস করে এই আবরার রক্ত দিয়ে আপনাদের পতনের আন্দোলন সূত্রপাত করে গেছে, বীজ বপন করে গেছে। বাংলাদেশের জনগণ, দেশপ্রেমিক, ছাত্রসমাজ তারা ঐক্যবদ্ধ হবে, তার রক্ত বৃথা যেতে দেবে না। ইনলাল্লাহ এই সরকার বেশিদিন টিকতে পারবে না।
গণতন্ত্র পুণঃপ্রতিষ্ঠা করতে কারাবন্দি খালেদা জিয়ার মুক্তির প্রয়োজন উল্লেখ করে তিনি বলেন, গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা ও দেশনেত্রীর মুক্তির জন্য আগামী দিনে যেসমস্ত কর্মসূচি আসবে আপনারা সাহসের সাথে আজকের মতো তা সফল কর সকলে ঐক্যবদ্ধ থাকবেন। আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকলে এদেশের জনগনকে আমরা ঐক্যবদ্ধ করতে পারবো এবং ইস্পাত কঠিন গণঐক্য ছাড়া এই ফ্যাসিবাদের পতন হবে না। ইনশাল্লাহ সেই ফ্যাসিবাদের পতন হবেই।
স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, এই সরকার দুর্নীতিতে ডুবে গেছে। তারা এমন ফাঁদে পড়েছে, সেই ফাঁদ থেকে তাদের কোনো নিস্কৃতি নাই, এই ফাঁদ থেকে তারা উঠে আসতে পারবে না। আমি মনে করি, এই সরকারের পতন এখন সময়ে ব্যাপার। এই দেশের মানুষ কখনো এই ধরনের সরকারকে বরদাশ করতে পারে না।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, আজকের খবরের কাগজে দেখলাম, এমন কোনো হল নাই, ডরমেটরি নাই বাংলাদেশে তাদের টর্চার সেল নাই।আজকে এই আবরারের হত্যাকান্ড সারা দেশের মানুষকে অবাক করেছে, মর্মাহত করেছে। একজন আবরার হত্যা করে কোনো লাভ হবে না, তার মতো শত শত আবরারের জন্ম দেবে। ভারতের সাথে সম্পাদিত চুক্তিরও সমালোচনা করেন সাবেক আইনমন্ত্রী।
তিনি বলেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে, তিনি বাংলাদেশের কোনো স্বার্থ বিক্রি করেন নাই। কিন্তু দেশের মানুষ বোকা নয়, তারা জানে আপনি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে বিক্রি করে এসেছেন ভারতে গিয়ে। এর পরিবর্তে আপনি বাংলাদেশের মানুষের জন্য কিছুই আনতে পারেন নাই। এই ব্যর্থতায় এই সরকারের জন্য কালিমা হয়ে থাকবে ইতিহাসে। আজকে আন্দোলনের সময় এসেছে, আপনারা প্রস্তুতি গ্রহন করেন। এই সরকারকে আর ক্ষমতায় থাকতে দেয়া যেতে পারে না। জোর করে ক্ষমতায় থাকতে চাইলে জনগন বিএনপি ও বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন সৃষ্টি করে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনবে।
স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, দুই দেশের মধ্যে বিনিময়ে চুক্তি হবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী একতরফা দান করে দিয়ে আসলেন। আমি অত্যন্ত গর্বিত আমার দেশের প্রধানমন্ত্রী দান করতে জানেন। আবার অত্যন্ত লজ্জিত আমি দেখলাম ভারতের বিমানবন্দরে লাল কার্পেট নাই, এক প্রতিমন্ত্রী তাকে(শেখ হাসিনা) অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন। আমি লজ্জা পেয়েছি, জাতি লজ্জা পেয়েছে, দেশ লজ্জা পেয়েছে। সেখানে শেখ হাসিনা ওয়াজেদ আপনি দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে গেছেন, সেখানে আমাদের ইজ্জতে লেগেছে, আমাদের মানহানী হয়েছে। আমি মনে করি এই ধরনের নতজানু পররাষ্ট্র নীতি যদি সরকারের থাকে সেই সরকার কোনো দিন প্রতিষ্ঠা আদায় করতে পারবে না, দেয়া ছাড়া। আপনি যা করতে যাচ্ছেন- চেষ্টা করতে পারেন। আমি মনে করি, আবরারের মতো লক্ষ-কোটি আবরার জন্ম নেবে আপনার অপকর্ম বাংলাদেশে সফল হতে দেবে না।
মহানগর দক্ষিনের সভাপতি যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী খান সোহেলের সভাপতিত্বে ও উত্তর-দক্ষিনের দুই সাধারণ সম্পাদক কাজী আবুল বাশার ও আহসান উল্লাহর পরিচালনায় সমাবেশে বিএনপির আবুল খায়ের ভুঁইয়া, রুহুল কবির রিজভী, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, ফজলুল হক মিলন, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, আজিজুল বারী হেলাল, আবদুস সালাম আজাদ, আমিরুল ইসলাম খান আলিম, অঙ্গসংগঠনের আফরোজা আব্বাস, সাইফুল আলম নিরব, শফিউল বারী বাবু, মুন্সি বজলুল বাসিত আনজু, সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু, সাদেক আহমেদ খান, আবদুল কাদের ভুঁইয়া জুয়েল, মোরতাজুল করিম বাদরু, হাসান জাফির তুহিন, হেলেন জেরিন খান, ফজলুর রহমান খোকন, ইকবাল হোসেন শ্যামল বক্তব্য রাখেন।
বিএনপির সমাবেশকে ঘিরে সকাল থেকেই নয়াপল্টন এলাকায় বিপুল সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সরব উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। সমাবেশের অনুমতির জন্য দলটির কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানীর নেতৃত্বে তিন সদস্যর প্রতিনিধি দল সকালে ও দুপুরে ডিএমপি কমিশনারের কার্যালয়ে যান। কিন্তু ব্যস্ততার কারণ দেখিয়ে ডিএমপি কমিশনার বিএনপির প্রতিনিধিদলের সঙ্গে দেখা দেননি বলে অভিযোগ করেন দলটির সহ সাংগঠনিক সম্পাদক এ্যাডভোকেট আবদুস সালাম আজাদ।
এদিকে, সমাবেশের জন্য ডিএমপির অনুমতি না দেয়ায় বিএনপির নেতাকর্মী ও পুলিশের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। সমাবেশকে কেন্দ্র করে সকাল থেকেই বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী নয়াপল্টনে উপস্থিত হন। তারা পুলিশী বাধা উপেক্ষা করেই দলীয় কার্যালয়ের সামনের রাস্তায় অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন শ্লোগান দিতে থাকেন। পুলিশও বিএনপিকে সমাবেশ না করতে দেয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকে। এই উত্তেজনার মধ্যেই বিএনপি সমাবেশের কার্যক্রম শুরু করে। এ সময় বিপুল সংখ্যক পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা পুরো সমাবেশকে কার্যত ঘিরে ফেলে। নেতাকর্মীরাও নির্ভিকতার পরিচয় দিয়ে অবস্থান থেকে না সড়ে শ্লোগানে শ্লোগানে পুরো এলাকা মুখরিত করে রাখেন। সমাবেশের সভাপতি মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সভাপতি হাবিব উন নবী খান সোহেল অভিযোগ করেন, সমাবেশে আসার সময় ও সমাবেশস্থল থেকে পুলিশ কমপক্ষে ৫০জন নেতাকর্মীকে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তিনি হুঁশিয়ারী দিয়ে বলেন, সমাবেশ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের আটক নেতাকর্মীদের ছেড়ে দিতে হবে। না হলে উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য তাদেরকেই দায় বহন করতে হবে।
Check Also
তাবলীগ জামায়াতের সাদপন্থীদের নিষিদ্ধের দাবিতে সাতক্ষীরায় বিক্ষোভ-সমাবেশ
মুহাম্মদ হাফিজ, সাতক্ষীরা : তাবলীগ জামাতে সাদপন্থীদের বর্বোরিচত হামলার প্রতিবাদ ও সাতক্ষীরা জেলা আ.লীগের সহসভাপতি …