ক্রাইমবার্তা রিপোটঃ যশোর সংবাদদাতা : যশোরে গত ৫ বছরে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের হাতে ৩ জন ছাত্রসহ ৬ জন নির্মমভাবে খুন হয়েছেন। নৃসংশভাবে এদের হত্যা করা হয়। এদের মধ্যে ৩ জনকে পিটিয়ে হত্যা করেছে ওই সন্ত্রাসীরা। কামরুজ্জামান বাবু ওরফে শুকুর আলী নামে একজন যুবলীগ কর্মীও ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হয়েছেন। তাকে পিটিয়ে ও প্লাস দিয়ে হাতের নখ উপড়ে নিষ্ঠুর ও নৃসংশভাবে হত্যা করা হয়। এসব হত্যাকা-ের ঘটনায় নিহতদের পরিবার আজও বিচার পায়নি। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফায়াদ খুনের ঘটনায় যখন সারাদেশে নিন্দা প্রতিবাদের ঝড় চলছে ঠিক তখন বিচার না পাওয়া যশোরে নিহতদের স্বজনেরা ডুকরে কেঁদে উঠছেন।
২০১৪ সালের ১৪ জুলাই ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (যবিপ্রবি) পরিবেশ বিজ্ঞান অনুষদের ছাত্র কাজী নাইমুল ইসলাম রিয়াদ। ছাত্রলীগের ইফতারে যোগ দিতে অস্বীকার করায় তাকে প্রকাশ্যে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। পরদিন ১৫ জুলাই সন্ধ্যায় নিহতের মামা রফিকুল ইসলাম রাজু বাদী হয়ে ১২ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরও ২-৩ জনের বিরুদ্ধে কোতয়ালি থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় আসামীরা হলেন, তৎকালীন জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন বিপুল, যবিপ্রবি ছাত্রলীগ শাখা সভাপতি সুব্রত বিশ্বাস ও সাধারণ সম্পাদক এসএম শামীম হাসান, যবিপ্রবি’র প্রথম বর্ষের (পরিবেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগ) ছাত্র ফয়সাল তানভীর, শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র আজিজুল ইসলাম, যশোর শহরের কাজীপাড়া বিমান অফিস মোড় এলাকার বোকড়ার ছেলে সজীব, কাজীপাড়াস্থ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পেছন এলাকার রওশন ইকবাল শাহী, মিশনপাড়ার মজনু মিয়ার ছেলে ছালছাবিল আহমেদ জিশান, পুরাতন কসবা কাজীপাড়ার আব্দুল খালেকের ছেলে কাজল, ঝুমঝুমপুর চান্দের মোড়ের চান কসাইয়ের ছেলে জাভেদ, খুলনার বাবু খান রোডের হাফিজুর রহমানের দু’ছেলে মফিজুর রহমান ও মোস্তাক হোসেন। পরবর্তীতে মামলার তদন্ত সংস্থা সিআইডি আনোয়ার হোসেন বিপুলকে বাদ দিয়ে ১১ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। বর্তমানে চাঞ্চল্যকর রিয়াদ মামলাটি আদালতে বিচারাধীন। কিন্তু নিহতের পিতা খুলনার বাসিন্দা কাজী মনিরুল ইসলাম যশোর আদালতে ওই মামলা সংক্রান্ত বিষয়ে এলে তাকে অপহরণের চেষ্টা চালিয়েছিলেন আসামী পক্ষীয়রা। যে কারণে তিনি সন্তান হত্যার বিচারের জন্য আর যশোরে আসতে সাহস পাননা।
ওই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ২০১৫ সালের ২৩ নবেম্বর যশোর সরকারি এম এম কলেজের দু’জন মেধাবী শিক্ষার্থী হাবিবুল্লাহ হুসাইন ও কামরুল হাসানকে পিটিয়ে হত্যা করেন ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা। শিবির সন্দেহে মেস থেকে ধরে কলেজের আসাদ হলের ‘টর্চার কক্ষে’ নিয়ে তাদের নৃসংশভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ ছাড়া ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা ওইদিন রেলগেটে মুক্তিযোদ্ধা হাসান উদ্দিনের ভাড়া দেয়া ছাত্রদের একটি মেসে তা-ব চালান। তারা এ সময় মামুন নামে এম এম কলেজের আরেক ছাত্রকে ধরে নিয়ে নির্মমভাবে পিটিয়ে আহত করেন। এ ঘটনায় নিহতদের পরিবার মামলা করতে চাইলেও কোতয়ালি থানার পুলিশ তাদের অভিযোগও পর্যন্ত নেয়নি। বরং পুলিশ জড়িতদের রক্ষা করতে নিজেরা বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামাদের আসামী করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করে। পরবর্তীতে ২০১৭ সালে মামলাটির ফাইনাল রিপোর্ট দিয়ে দেয়া হয়। অথচ নিহতদের স্বজনদের পক্ষ থেকে ছাত্রলীগের নেতা ছালছাবিল আহমেদ জিসান, তৌহিদসহ কয়েকজনকে আসামী করে আদালতে মামলা করলেও তার কোন হদিস আর পাওয়া যাচ্ছেনা। আদালত এ অভিযোগ বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিল করতে বললেও সেটি কোতয়ালি থানায় যাওয়ার পর রহস্যজনক কারণে গায়েব হয়ে যায়।
২০১৬ সালের নবেম্বরে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের পৈশাচিক ও নিষ্ঠুর নির্যাতনে খুন হন যুবলীগ কর্মী কামরুজ্জামান বাবু ওরফে শুকুর আলী। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ৩ নভেম্বর সার্কিট হাউস পাড়ার বাড়ি থেকে তাকে ধরে এম এম কলেজের আসাদ হলে নিয়ে হত্যা করা হয়। নিহতের পিতা মতিয়ার রহমান মতি তসবির মহলের কর্মচারী। ওই সময় তিনি সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ‘শুকুর আলী তার একমাত্র ছেলে। শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকায় তিনি (শুকুর) বেশিরভাগ সময় বাড়িতেই থাকতেন। গত ৬ নবেম্বর বিকেল ৫ টার দিকে প্রায় ৪০ জন যুবক তার বাড়িতে গিয়ে শুকুর আলীকে ধরে নিয়ে যায়। তারা তাকে এম এম কলেজের আসাদ হলে নিয়ে নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন চালায়। তার পায়ের নোখ প্লাস দিয়ে উঠিয়ে ফেলা হয়। কিরিচ ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে তার দুই পায়ে। পিঠেও নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন চালানো হয়। ছেলেকে রক্ষা করতে এগিয়ে গেলে ছাত্রলীগের শাহী নামে একজন তাকে লাঠি দিয়ে হাতে আঘাত করেন। আর নুরুল ইসলাম নামে অপর একজন লাথি মেরে তাকে পাশের পুকুরে ফেলে দেন।’
এদিকে যুবলীগ কর্মী কামরুজ্জামান বাবু ওরফে শুকুর আলী হত্যাকা-ের প্রায় ৩ বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু আজও তার পরিবার এ হত্যার বিচার পায়নি। এ বিষয়ে মতিয়ার রহমান মতি জানান, কোতয়ালি থানার পুলিশ তার মামলা নেয়নি। তবে পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা করেছিলো। মামলাটি বর্তমানে সিআইডি পুলিশ তদন্ত করছে বলে তিনি জানতে পেরেছেন। কিন্তু সন্ত্রাসীদের ভয়ে তিনি মামলার খোঁজখবরও নিতে পারেন না।
২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে যশোর সরকারি সিটি কলেজের ছাত্রবাসে জুতা বিক্রির পাওনা টাকা আনতে গিয়ে গণপিটুনিতে নিহত হন ভারতীয় নাগরিক আইয়ুব আলী। তিনি ভারতের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার হেলেঞ্চা (সাবেক বয়রা থানা) থানার কুলানন্দপুর গ্রামের মৃত বাহার আলীর ছেলে। সিটি কলেজের কয়েকজন ছাত্রের কাছে তিনি জুতা বিক্রি করেছিলেন। ৩ ফেব্রুয়ারি তিনি সেখানে টাকা আনতে গেলে তাকে জঙ্গী আখ্যা দিয়ে মারধর করা হয়। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৫ ফেব্রুয়ারি তিনি মারা যান। মূলত সিটি কলেজের ছাত্রাবাসটি ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতা নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। অভিযোগ রয়েছে তার ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরাই তাকে হত্যা করেন।
সর্বশেষ চলতি বছরের মার্চে যশোর শহরের বিমান অফিস এলাকায় দাবিকৃত ২ লাখ টাকা চাঁদা না পেয়ে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা ওয়েল্ডিং মিস্ত্রি নয়ন চৌধুরী সাজুকে পিটিয়ে হত্যা করেন। তিনি মিশন পাড়ার জয়নাল চৌধুরী স্বপনের ছেলে। তৎকালীন জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছালছাবিল আহমেদ জিসান জয়নাল চৌধুরী স্বপনের কাছে মোবাইল ফোনে ২ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছিলেন। কিন্তু তিনি চাঁদা দিতে অপরাগতা প্রকাশ করলে তার দুই ছেলের যে কোন একজনকে খুন করার হুমকি দিয়েছিলেন ছাত্রলীগ নেতা ছালছাবিল আহমেদ জিসান। ১৩ মার্চ রাতে ছোট ছেলে সাজুকে বিমান অফিস এলাকায় পেয়ে কাঠের রুল দিয়ে পিটিয়ে এবং শরীরের উপর উঠে তাকে নির্যাতন চালানো হয় জিসানের নেতৃত্বে। পরদিন ১৪ মার্চ সন্ধ্যায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান সাজু। এ ঘটনায় নিহতের বড় ভাই রতন চৌধুরী রাজু বাদী হয়ে ছাত্রলীগ নেতা ছালছাবিল আহমেদ জিসানসহ ৪ জনকে আসামী করে কোতয়ালি থানায় একটি মামলা করেন। অপর আসামীরা হলেন-সদর উপজেলার হামিদপুরের খায়রুলের ছেলে পাভেল, শেেহরর ছোট খোকনের ছেলে রাব্বি ও খোকনের ছেলে রনি। বর্তমানে মামলাটি তদন্ত করছে ডিবি পুলিশ। কিন্তু ডিবি পুলিশ এখনো পর্যন্ত এজাহারভুক্ত কোন আসামীকে আটক করতে পারেনি। এ বিষয়ে ডিবি পুলিশের ওসি মারুফ আহম্মদ জানান, আসামীদের আটকের জন্য তারা নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
Check Also
পঁচিশেই নির্বাচন চায় বিএনপি ও সমমনারা
দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে থাকা মিত্র দলগুলোর …