১১ দফা দাবিতে হঠাৎ ক্রিকেটারদের ধর্মঘট

স্পোর্টস রিপোর্টার : ১১ দফা দাবিতে হঠাৎ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে ক্রিকেটাররা। এই দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সব ধরনের ক্রিকেট কর্মকাণ্ড থেকে সরে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন সাকিব-তামিমরা। গতকাল দুপুর পৌনে ৩টার দিকে বিসিবি একাডেমির সামনে এসে জড়ো হন ক্রিকেটাররা। এরপর মিডিয়ার সামনে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরেন সাকিব আল হাসানরা। সেখানে ক্রিকেটাররা ১১ দফা দাবি তুলে ধরেন এবং জানিয়ে দেন যে, দাবি না মানা পর্যন্ত সব ধরনের ক্রিকেট কর্মকাণ্ড তারা বর্জন করবেন। হঠাৎ ক্রিকেটারদের এমন প্রতিবাদে সরগরম হয়ে উঠেছে ক্রিকেটাঙ্গন। দাবি না মানলে সব ধরনের ক্রিকেট বয়কটের হুমকি তাদের। এবার বেতন ভাতা বৃদ্ধিসহ নানা দাবিতে একজোট হয়েছেন সবাই। এই আন্দোলনে উপস্থিত হয়েছেন সাকিব, তামিম, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহসহ দেশের শীর্ষস্থানীয় ক্রিকেটাররা। তবে মাশরাফি বিন মর্তুজা এখনও যোগ দেননি। ক্রিকেটারদের এই  ঘোষণার পর আগামী ২৪ অক্টোবর শুরু হতে যাওয়া জাতীয় ক্রিকেট লিগের তৃতীয় রাউন্ড এবং ২৫ অক্টোবর শুরু হতে যাওয়া জাতীয় দলের ক্যাম্প কার্যত অনিশ্চয়তার মুখে পড়ল। ক্রিকেটারদের মুখপাত্র হিসেবে ধর্মঘটের ঘোষণা দিয়েছেন সাকিব আল হাসান। এরপর একে নিজেদের দাবিগুলো তুলে ধরেছেন তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, নাঈম ইসলাম, এনামুল হক জুনিয়র, এনামুল হক বিজয়, তাসকিন আহমেদ, জুনায়েদ সিদ্দিকরা। এ আন্দোলনের মুখপাত্র জাতীয় দলের টেস্ট ও টি- টোয়েন্টি অধিনায়ক সাকিব আল হাসান বলেন, ‘এই ধর্মঘটে জাতীয় দল, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটারসহ সবাই এই ধর্মঘটের অন্তর্ভূক্ত, এবং সেটা আজকে থেকে। জাতীয় লিগ থেকে শুরু করে প্রথম শ্রেনির ক্রিকেট বলেন, জাতীয় দলের প্রস্তুতি বলেন, আত্মর্জাতিক ক্রিকেট বলেন সবগুলোই এর অত্মর্ভূক্ত।’ সাকিব আরও বলেন,‘আলোচনা সাপেক্ষেই অবশ্যই সবকিছুর সমাধান হবে। দাবিগুলো যখন মানা হবে তখন আমরা আমাদের স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফিরে যাবো। যেহেতু অনূর্ধ্ব-১৯ দলের সামনে বিশ্বকাপ আছে, তাই তাদেরকে এই ধর্মঘটের আওতায় রাখা হচ্ছে না। আর দেশের নারী ক্রিকেটাররাও চাইলে তাদের সঙ্গে ধর্মঘটে যোগ দিতে পারেন।’ তবে বোর্ডের সঙ্গে আলোচনার মাধম্যেই সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা সাকিবের। তবে দাবি মানতে হবেই, সেটিও জানিয়ে রাখলেন। সাকিব বলেন, ‘আলোচনা সাপেক্ষে অবশ্যই সবকিছুর সমাধান হবে। দাবিগুলো যখন মানা হবে তখন আমরা স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফিরে যাব। আমরাও সবাই চাই ক্রিকেটের উন্নতি  হোক। এখানে ক্রিকেটারদের কেউ তিন-চার বছর খেলবে, কেউ দশ বছর আছে। যারা ভবিষ্যতে আসবে, তাদের জন্য আমরা একটা ভালো পরিবেশ রেখে যেতে চাই যেখান থেকে বাংলাদেশের ক্রিকেট সামনে এগিয়ে যাবে।’
ক্রিকেটারদের ১১ দফা দাবিগুলো :
প্রথম দফা : কোয়াব বিলুপ্ত করতে হবে: কোয়াব বিলুপ্তির ব্যাপারে প্রথম দাবি পেশ করেছেন নাঈম ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রথম দাবি, কোয়াব (ক্রিকেটার ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ) বিলুপ্ত করতে হবে। বর্তমানে এ কোনও কার্যক্রম চোখে পড়ে না। কোয়াব ক্রিকেটারদের প্রতিনিধি হলেও তাদের কখনোই আমরা পাশে পাই না। কোয়াবের প্রেসিডেন্ট এবং সেক্রেটারিকে পদত্যাগ করতে হবে। কোয়াবের  প্রেসিডেন্ট এবং সেক্রেটারি কে হবেন তা ক্রিকেটাররা নির্বাচন করবে।’
দ্বিতীয় দফা: প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে দলবদল: প্লেয়ার ড্রাফট পদ্ধতিতে দলবদল নিয়ে কথা বলেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। তিনি বলেন, ‘প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগ নিয়ে সব ক্রিকেটারই অসন্তুষ্ট। কারণ এখানে পারিশ্রমিক নির্ধারণ করে দেওয়া হচ্ছে। খেলোয়াড়রা আগে বাছাই করতে পারতো, কে কোন দলে খেলবে, পারিশ্রমিক কেমন হবে। আমাদের দাবি হলো, আগের নিয়ম মেনে যেন প্রিমিয়ার লিগ হয়।’
তৃতীয় দফা : বিপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজি ভিত্তিক ফর্মুলায় ফিরে যেতে হবে:
বঙ্গবন্ধুর নামে বিপিএলের সপ্তম আসরে ফ্র্যাঞ্চাইজিদের আধিপত্য থাকবে না। কিন্তু ক্রিকেটাররা আগামী আসর থেকে আগের নিয়মে ফিরে যেতে চান। এ নিয়ে মুশফিকুর রহিম বলেন, ‘আমাদের তৃতীয় দাবি বিপিএল নিয়ে। আমরা জানি, এ বছর বিপিএল অন্যরকম হচ্ছে। সেটা অবশ্যই রেসপেক্ট করি। আমাদের প্রধান দাবি হলো, আগের নিয়মের বিপিএল যেন আগামী বছর থেকে হয়। বিদেশি খেলোয়াড়দের সঙ্গে স্থানীয় খেলোয়াড়রদের পারিশ্রমিকে অনেক পার্থক্য থাকে। আগামীতে যেন এ ব্যাপারে সামঞ্জস্য থাকে।  স্থানীয় ক্রিকেটাররা যেন ভালো পারিশ্রমিক পায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্বে অনেক ফ্র্যাঞ্জাইজি লিগ হয়। সেখানে খেলোয়াড়রা তাদের ড্রাফট  বেছে নিতে পারে। বাংলাদেশে খেলোয়াড়দের গ্রেড নির্বাচনের সুযোগ দেওয়া উচিত।’
চতুর্থ দফা: প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটারদের ম্যাচ ফি বৃদ্ধি:
এ বিষয়ে বাংলাদেশের টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক সাকিবের বলেন, ‘আমরা মনে করি প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ম্যাচ ফি অন্তত এক লাখ টাকা হওয়া উচিত। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটারদের বেতন পঞ্চাশ ভাগ এবং খেলোয়াড়দের প্রাককটিস ফ্যাসিলিটিজ বাড়াতে হবে। আমরা চাই না প্রতিটি ট্রেনিং সেশন  যেন ঢাকায় হয়। যার যার বিভাগে ক্রিকেটাররা যেন অনুশীলন করতে পারে।’
পঞ্চম দফা:  প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি:
এই দাবিও তুলে ধরেছেন সাকিব। তিনি বলেছেন, ‘প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অনেক ছোট ছোট ইস্যু আছে। এখানে প্রথম হচ্ছে বল। আমরা যে বল দিয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলি সেটা মানসম্মত নয়। ক্রিকেটারদের দৈনিক ভাতা ১৫০০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ভ্রমণ খরচ ২৫০০ টাকা থেকে বাড়াতে হবে। বিভাগ ভিত্তিক যাতায়াতের জন্য বিমান ভ্রমণের ব্যবস্থা করতে হবে। যে  হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করা হবে সেখানে জিম এবং সুইমিং পুল থাকা বাধ্যতামূলক। মাঠে যেতে ক্রিকেটারদের জন্য এসি বাসের ব্যবস্থা করতে হবে।’
ষষ্ঠ দফা: চুক্তি ভিত্তিক ক্রিকেটারের সংখ্যা বৃদ্ধি:
এ বিষয়ে এনামুল হক জুনিয়র বলেছেন, ‘জাতীয় দলে চুক্তিভুক্ত ক্রিকেটারের সংখ্যা বাড়াতে হবে। চুক্তিভুক্ত ক্রিকেটারের সংখ্যা ৩০ জন করতে হবে। পাশাপাশি বেতন বাড়াতে হবে।’
সপ্তম দফা : ক্রিকেট সংশ্লিষ্টদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি:
ক্রিকেটারদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি নিয়ে কথা বলেন তামি ইকবাল। তিনি বলেন, ‘গ্রাউন্ডসম্যান-কোচ-আম্পায়ার সবার বেতন বাড়াতে হবে। একজন গ্রাউন্ডসম্যান সারাদিন মাঠে কাজ করে মাস শেষে মাত্র ৫ হাজার টাকা বেতন পান। একজন বিদেশি কোচ যে বেতন পান স্থানীয় ২০ জন কোচও হয়তো তা পান না। আম্পায়ারদের জীবনের নিরাপত্তা দিতে হবে। ফিজিও, ট্রেনারদের ক্ষেত্রেও একই কথা বলবো আমরা।’
অষ্টম দফা: নতুন টি-টোয়েন্টি লিগ চালু :
এনামুল হক বিজয় বলেন, ‘আমরা দুটো চার দিনের টুর্নামেন্ট খেলি-বিসিএল এবং এনসিএল। কিন্তু প্রিমিয়ার লিগের ওয়ানডে ভার্সনে আমরা মাত্র একটি টুর্নামেন্ট খেলি (ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ)। তাই আরেকটি টুর্নামেন্ট বাড়ানো উচিত। বিপিএল ছাড়া আর কোনো টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট হয় না। বিপিএলের আগে একটি টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট হওয়া জরুরি।’
নবম দফা: ফিক্সড ক্যালেন্ডার:
নুরুল হাসান সোহান বলেন, ‘ঘরোয়া আসরের ক্ষেত্রে আমাদের একটি ফিক্সড ক্যালেন্ডার থাকতে হবে। যার ফলে আমরা সারা বছরের প্রস্তুতি নিতে পারবো।’
দশম দফা: বকেয়া পাওনা:
জুনায়েদ সিদ্দিক বলেন, ‘বিপিএল-প্রিমিয়ার লিগের টাকা আমরা যেন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পাই। এখনও ব্রাদার্স ইউনিয়নের ক্রিকেটাররা ৪০ ভাগ টাকা পায়নি। এটা খুব দৃষ্টিকটু।’
এগারতম দফা: ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে খেলা আটকানো যাবে না:
ফরহাদ রেজা বলেন, ‘ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের জন্য একটি নিয়ম বেঁধে দেওয়া আছে যে কেউ দুটির বেশি খেলতে পারবে না। জাতীয় দলে খেলার বাইরে আমরা যদি ফ্রি থাকি তাহলে যেন দেশের বাইরে আরও বেশি খেলতে যেতে পারি।’

Check Also

বিএনপি নেতাকর্মীদের জড়িয়ে হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে দেবহাটায় মানববন্ধন

দেবহাটা প্রতিনিধি: স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার দোসর এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও ভূমিদস্যুদের গ্রেফতার এবং বিএনপির …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।